প্রথম চাকরিটা ছাড়ার ১০ দিন পরে দ্বিতীয় গোলামিটা নিয়ে ঠিক চার দিনের মাথায়,বা ফাঁকিবাজিটা ধরলে,ঠিক সাড়ে তিন দিনের মাথায় কারার ঐ লৌহ কপাট ভাঙার স্টাইলে সেটাও ছেড়ে দিয়ে দু'দিন হল বাসায় বসে ঝিমিয়ে যাচ্ছি রাণীক্ষেত রোগাক্রান্ত মুরগীর মত। একটা ভাবনা ছিল যে সময় কেটে যাবে মন্দ না,যেহেতু বাপের হোটেল এখনো আছে এবং পিতামাতা তাদের হোটেলে অন্য কোন অতিথির অভাবেই আমাকে সাদরে আবারো আমন্ত্রণ করেছেন,কাজেই নানারকম সৃষ্টিশীল(যদিও সৃষ্টিশীল ব্যাপারটা কি সে সম্পর্কে আমার ধারণা নেই,বলতে হয় তাই বলা) কাজ করে দিন গুজরান করা যাবে যতক্ষণ না আর কেউ চাকরগিরির মুলা ঝুলিয়ে সামনে নিয়ে না আসে। মুলা,তা সে চাকরি করারই হোক আর ছাড়ারই হোক,সেটা যে বারবারই আমাকে খেতে হবে তাও বেশ জানি কারণ গাধার সাথে নিজের তেমন কোন তফাৎ যেমন নিজে পাইনি তেমনি শ্রদ্ধেয় গুরুজন বা বন্ধুবৎসল বন্ধুকুলও পায়নি,কাজেই পরপর দু'বার মুলা চিবিয়ে ফেলে দেয়ার পরেও কেউ যে বিশেষ চিন্তিত হয়েছে সেটা বলছি না।
দেখা গেল,ঘটনা এত সোজা না। রসায়ন বইতে পড়া সেই আদর্শ গ্যাসের মত,যে ইহাকেই আদর্শ গ্যাস বলে তবে বাস্তবে ইহার কোন অস্তিত্ব নাই বরং প্রমাণের সুবিধার্থে ইহাকে এইরূপ ধরে নেয়া হয়,অলস সময়ও সেভাবেই আদর্শ গ্যাস থেকে বাস্তব গ্যাস(নাকি আদর্শ মুলা থেকে বাস্তব মুলা?) এ ঘুরে গেছে।
আমি বেকার,তারমানে এই না যে বন্ধুমহলও বেকার,আড্ডা দেয়ার চিন্তা বাদ,সারাদিন খাটাখাটনি করে যারা বাসায় ফেরে তারা আমাকে দেখলে খুশি হবে এমন ভাবার কারণ নেই। ভাবলাম লেখার চেষ্টা করি,ভুলেই গিয়েছিলাম আমি লেখক না,কাজেই কীবোর্ড ধরে তো মাথায় খেলে না,বিরক্ত হয়ে ঠিক করলাম অন্যের আইডিয়া মেরে দিই,আর কিছু না পাই অনেকে যেমন ব্লগে লেখে সেরকম ডায়েরি লিখি,মানুষজন পড়ে কিছু গালি তো দেবে,তা-ই সই,সেজন্যই এই অখাদ্যের অবতারণা।
দিনলিপি লিখতে তো বসে গেলাম,এবং তারপরই আবিষ্কার করলাম,আসলে লেখার মত কিছু নেই। সারাদিনে এমন কিছু আমার জীবনে ঘটে না যা নিয়ে কিছু লেখা যেতে পারে,নিজেকে যা-ই আমরা ভাবি আসলেই হয়তো আমরা কেউ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নই যার কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে,যার থাকা বা না থাকায় কোন কিছু থমকে যাবে,শেষ বিচারে সবাই শূন্য হাতে চলে যাব যেমন গেছে আর সবাই,মাঝে শুধু বড় বড় কিছু কথা আর আস্ফালন। কিশোর কবি
সুকান্ত যদিও ঠিক সেভাবে দেখেননি,আর কিছু না হোক যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে প্রাণপণে পৃথিবীর জজ্ঞ্জাল সরানোর প্রতিজ্ঞা করে গেছেন,কিন্তু আমার নিজের হাতেই এত আবর্জনা যে ভয় হয় জজ্ঞ্জাল সরাতে গিয়ে পৃথিবীকে না আরো নোংরা করে ফেলি।
কাজেই সে চেষ্টা বাদ,ভাবি বরং সারাদিনে কতটা ধুলো পৃথিবীতে জমা করলাম। আগের অফিসে বলে আসিনি যে আমি ভেগে যাচ্ছি,কেন ভেগে যাচ্ছি সেটা সামনাসামনি ব্যাখ্যা করা মুশকিল,দ্বারে দ্বারে গিয়ে কন্ট্রাক্ট ভিক্ষা করতে যে খুব গায়ে লাগে সেটা বললে আমাকে পাগলা গারদে পাঠানো হতে পারে। ফোন করেছিল,আজকে আমি কোথায় জানতে চেয়ে,যদিও সিনিয়র মার্কেটিং এর ছোকরাটা আমার চরম অপছন্দের তাও ভদ্রতা করে বলে দিলাম জ্বর এসেছে,যাবো না(সাথে মনে মনে কয়েকটা গালি)। কালকে একটা ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে,যেভাবেই হোক,নইলে আরেকদিন ফোন করলে গালি দিয়েও বসতে পারি। বসে বসে ভাবছিলাম বাসা বদলানোর সময় আস্ত ১টা ঠেলাগাড়ি ভরে যে বইগুলো এনেছিলাম সেগুলো বস্তাবন্দী হয়ে পোকার খাদ্য হচ্ছে,এ বেলা গুছিয়ে ফেলবো,হয়নি এখনো,পোকাদেরও বিদ্যাশিক্ষার দরকার আছে,হোক। সকালে ঘুম থেকে উঠে সূর্যটা না দেখেই দৌড় দিতাম,আজকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রোদটা মন্দ লাগলো না। নেটে বসলাম গদাইলস্করি চালে নাস্তা করে,বসতেই মোটকা নক করলো,কিরে মতি মিয়া কি বাঁইচা আছে নাকি পটল তুলছে? জানালাম,বেঁচে আছে। (এখানে জানিয়ে দেয়া কর্তব্য যে মতি মিয়া আমাদেরই এক কর্মপাগল বন্ধু,যে কিনা কর্তব্য পালনের চাপে আগের দিন পানিশূন্যতায় ভুগে হাসপাতাল যাত্রা করেছিল এবং
বাংলাদেশের নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর উদ্ভট সার্ভিসের বদৌলতে যথেষ্ট ভোগান্তি করেই তাকে আমাদের সুস্থ করতে হয়েছে।) সুস্থ আছে শুনে মোটকার আফসোস বাড়ে,আহহা,এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়া গেল রে? আরেকটু পরে হইলে হইত,মনে রাখতো ঠিকমত! হ,ইন্ঞ্জেকশনটা আরেকটু পরে দিলে চলতো,আরো ২ দিন শোয়ায়া রাখা যাইতো,আমার বিজ্ঞ মতামত। দু'জন খানিক আফসোস চলে,পোলাপানের কর্তব্যপরায়নতা নিয়ে। আফসোস আমিও করি,মনে মনে,মোটকা,যেকোন মহাবিপদে ডাকলেই যাকে সব কাজ ফেলে পাওয়া যেত, শিগগিরি আরো বেশি কর্তব্যপরায়ন হয়ে দূরদেশে উড়াল দিচ্ছে,কবে দেখা হবে কে জানে!
খানিক ঝিমিয়ে বিরক্ত হয়ে ভার্সিটির দিকে রওনা দিই,এককালের চরম অপছন্দের জায়গাটা বেশ আপন লাগে এখন। ভার্সিটি ছুটি,এর মাঝেও দু-চারজনের সাথে দেখা হয়ে যায়,আরো বেশি আপন মনে হয় সবাইকে, যদিও আমাদের সূর্যের দিন শেষ হয়ে গেছে,এখন যাত্রা ফিকেরঙা বিকেলের দিকে,তবু অনেকদিন পর একসাথে টিচারদের মুণ্ডুপাত করার সুযোগ পেয়ে খুশি হয়ে উঠি সবাই,বদমেজাজী শিক্ষকদের এখন কেন যেন ভালই লাগে। একজনের সাথে দেখা হয়ে গেল,জানালাম,বেকার আছি। রেজাল্ট শুনে মাথা নাড়লেন,নাহ,সময় থাকতে কেন যে পড়ো না! যাক, চিন্তা নেই,হবে কিছু একটা। মাথা নাড়ি আমিও,হবে হবে,আমরা সবাই বড়ই আশাবাদী।
আবার বাসায় ফেরা,অনিচ্ছায় খেয়ে নিয়ে ঝিম ধরা,হঠাৎ টুপটাপ থেকে রিমঝিম,জানালায় বসে বৃষ্টি দেখা,মাঝে মাঝে কীবোর্ডে খটাখট। একটু উদাস লাগে,টিউশনি করতে যাবো না,সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। রাসেলের ফোন আসে,ছোকরা ঢাকায় এখন,ফোন রিসিভ করার সময় মনে হয়,ব্যাটা একটা গান চেয়েছিল,অনেক কিছু লেখা হল,গায়কের জন্য একটা গান আর লেখা হয়ে উঠলো না। লিখে ফেলতে হবে যত তাড়াতাড়ি পারি,সিদ্ধান্ত নিই যেমন নিয়েছিলাম জীবনের অনেকগুলো না করা না পারা কাজ করার। যেমন ভেবেছিলাম নিজের চরম অগোছালো পড়ার টেবিল আর ঘরটার মত অগোছালো জীবনটাও গুছিয়ে ফেলব খুব তাড়াতাড়ি,যেমন ভেবেছিলাম তারছেঁড়া ভাঙ্গা স্পিকারটার মত ফাটা কপালটাও মেরামত করে ফেলব জলদি করে,যেমন ভেবেছিলাম না পড়া বইগুলো পড়ে ফেলব যত্ন করে,যেমন ভেবেছিলাম খোলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে হাত মেলে শ্বাস নেব বুক ভরে।
তারপরেও,কেন যেন না করা কোন কিছুই করা হয়ে ওঠে না। চারমাস ধরে না কাটা মাথার চুলগুলো এখনো কাটানো হয়ে ওঠে না,আমার বেসুরো এক তার ছেঁড়া গিটারের তারগুলো লাগানো হয়না,আমার ভাঙা স্পিকারে অনেকদিনের মতই আজো গান বাজেনা,অন্ধকার বাড়ি ছেড়ে আরো ঘুপচি বাড়ির জানালায় বসে থাকা আমার সূর্যমুখী ফুল দেখার স্বপ্নও সত্যি হয়না। আমার বইগুলো পোকার খাদ্য,আমার পেটে এসিডিটি,অসুস্থ নগরের অসুস্থ নগরবালকের ধুসর চোখে ধোঁয়াটে দৃষ্টি,নষ্ট ক্যালকুলেটরটার মতই বারেবারে ডিজিটগুলো কোথায় যেন নষ্ট হয়ে যায়,টেবিলের ছবির ফ্রেমে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা ৫ বছরের বড় বড়
চোখের বালকের দিকে তাকিয়ে আমি হ্যারি পটারের ম্যাজিক ওয়ান্ড খুঁজে বেড়াই,বর্ষার তীব্র বৃষ্টিতে ভিজে আমি শরতের মেঘ স্পর্শ করতে চাই,আরো একবার আমি ধোঁয়া ওঠা চুলোর ভাপ নিয়ে মানুষ হতে চাই।
আহা জীবন,এক জীবনে আমরা কত কিছুই না চাই!