সুপ্রিয় বেলা,
নাকি অন্য কোন নামে ডাকবো? কি আসে-যায়,সবসময় তোমার একি নাম,যে নামেই ডাকি না কেন,ঘুরে-ফিরে তো সেই বেলা বোস,বিপরীতে হয়তো অন্ঞ্জনের বদলে আমি বা আর কেউ। চিঠিটা লেখা দরকার ছিল অনেক আগেই,কিন্তু অহেতুক রেসের ঘোড়ার মত দৌড়ে দৌড়ে থাকায় লেখা হয়ে ওঠেনি,একসময় ভাবছিলাম আর কখনো লেখা হবেও না। তবু সময় মিলে যায়,আমারো মিলে গেল,বা বলতে পারো,মিলিয়ে নিলাম,এই সস্তার মোবাইলের যুগে সিটিসেল ওয়ান নিয়েও এসএমএসের চেয়ে আকাশের ঠিকানায় চিঠি দেয়াটাই কেমন যেন একটা নায়ক নায়ক ভাব নিয়ে আসে নিজের মাঝে,হালের
অক্ষয় কুমার না হোক নিজেকে দাদার আমলের উত্তম কুমার মনে হয়।
দূর,কি কথা বলতে গিয়ে কোথায় চলে গেলাম,এটাই আমার দোষ,বেশি কথা বলি,সবাই বলে। তুমি অবশ্য বলনি,কারণ বলার সুযোগই কখনো পাওনি,বা দাওনি,বা হয়ওনি। তা যাক,হবেও না,আকাশে গিয়ে কখনো এই চিঠি পড়বে না এই ভরসাতেই ব্লগপিয়নের কাছে ছেড়ে দিলাম এটা। বলতে চাইছিলাম যে আমি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি,এ মাসের পরেই। কেন ছাড়ব জিজ্ঞেস করো না,জবাবটা আমার জানা নেই। বেশ একটা খুশি খুশি মন নিয়ে চাকরগিরিতে ঢুকে গিয়েছিলাম,দাসত্ব শৃঙ্খল পায়ে পড়তে কেমন লাগে সে নিয়ে বেশ গরম কিছু লেখালেখিও করে ফেলবো এমন কুমতলবও মনের মাঝে ছিল। এমনকি আমার ৯৮ পয়সা বা ২৫ পয়সার সেলফোনেরও ২-৪ টা কার্ড শেষ হয়ে গিয়েছিল নিজের চাকর হবার সুসংবাদ দুনিয়াজোড়া জানান দিতে গিয়ে। জানা কথাই সেটা তোমার
মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি,করবে এমন একটা অসম্ভব আশা করাও ঠিক হয়নি যদিও,আজকাল দেশে 'এলিজিবল' তালিকায় আমার বেতনটা ঠিক মানানসই নয় বলেই শিখেছি। তো সেজন্যই জীবনের দিকে বিতৃষ্ঞা এসে গিয়ে বিবাগী হয়ে গেলাম এমনটা বলো না,নাহয় অন্ঞ্জনের মত আমার বেলা বোস তুমি নও যে একি স্বপ্নের তালে আমার সাথে কসবার কোন নীল দেয়ালের ঘর খুঁজেছিল যার জন্য জুতার তলা ক্ষয়ে একটা চাকরি আমার যোগাড় করে ফেলতেই হবে, কিন্তু সে ব্যাটাও শেষমেশ একটা ১১০০ টাকার স্টার্টিং স্যালারি বাগিয়েও টেলিফোন করতে গিয়ে শুধু মিটারের বিলই বাড়িয়ে গেছে,ও মাথায় আর কেউ
কথা বলেনি,বেলা বোসও তো আসলে শুধুই যে কোন নারীই,তাই না?
তবে ছাড়ব কেন? এই আক্রার বাজারে যেখানে ৫০ টাকা কেজি দরে চাল কিনে পাওনাদারের অভিশাপ জমে জেরবার হয় বুড়ো বাপ,সেখানে চাইনিজ বারে চাওমিন খাওয়া বা কোন কারণে বিবাগী হওয়া ঠিক কাজের কথা নয়,আর আক্ষরিক অর্থেই যেখানে লোডশেডিংয়ে আমার ঘরেতে আঁধার তখন পকেটটা ফাঁকা থাকলে যে তারার ঝিলিমিলিও চোখে দেখবো নিয়ম করে সেটাতেও সন্দেহ নেই। এমন না যে আমাকে দাসের মতই খাটায়,সপ্তাহে দু'টো দিন ছুটি তো মেলে,শুয়ে-বসে অলস কাব্য করার সময় পেয়েই যাই,পেয়ে যাই অন্তর্জালে সবার সাথে হাত মেলানোর সুযোগটাও। মাস শেষে টাকাটা পকেটে নিয়ে যে স্বস্তিটুকু
দেখি নিজের মাঝে সেটার জন্যেও দাঁত কামড়ে পরে থাকা যায় কোথাও। নাই বা থাকলে বেলা বোস,নচিকেতা এসে দেখে যাক আমি পরোয়া করি না,দিনের মাঝে ৬ ঘণ্টা করে খোলা ময়দানে দাঁড়িয়ে সূর্যের থেকে ভালবাসা নিয়ে শুধু হৃদয় না গায়ের চামড়াটাও বেশ বাদামপোড়া রঙে রাঙিয়ে ফেলেছি। ঝড়বৃষ্টির সাথে মিতালী করেছি অনেকবার,তারাজ্বলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে রড আর সিমেন্টের হিসাবের সাথে সাথে কখনো কখনো কবিতার হিসাবও মিলিয়ে ফেলেছি,নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বুলডোজারের কর্কশ শব্দের খোলা হাওয়ার তান মিলিয়ে কঠোর সঙ্গীতও শুনেছি নিজের মাঝে। গভীর রাতে পিঁপড়ের মত ব্যস্ত প্রকৌশলী আর শ্রমিকদের কাতারে দাঁড়িয়ে বিশাল দানবীয় কংক্রিটের অবয়বগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে বিশাল কারিগর তো ভেবেছিই।
তারপরেও আমি ছেড়ে দেব। তাই বলে ভেব না চিরকালের অলস আর উদ্যমহীন আমি সারারাত লোডশেডিংয়ে জেগে থেকে ক্লান্তির ভয়ে অফিস যেতে চাই না,অত বিলাসিতা আমার নেই,আর সত্যি বলতে কি গুমোট ঘরে অন্ধকারে পেঁচার মত বসে থেকে বেশ একটা গুহামানব অবস্থায় অভ্যস্তই হয়ে গেছি,সন্ধ্যার পরেই গুহাবাস,একটু আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা থাকলে বেশ হতো। কিন্তু ছেড়ে দেব কারণ আমি অকারণেই ছেড়ে দিই সবকিছু। ছেড়ে দেব কারণ লক্ষ্যে পৌঁছানো কোনদিনই হয়ে ওঠেনি আমার,ছেড়ে দেব কারণ ইঁদুড় দৌড়ে আমি খুব তাড়াতাড়ি হাঁপিয়ে যাই,যা বাবা তোরা সব দৌড়া আমি খেলা দেখি,সবাই দৌড়ালে টিকেট কেটে দৌড় দেখবে কে? যেমন আমি তোমার জন্য দৌড়াতে পারিনি ওভাবেই আর কিছুর জন্যও হাল ছেড়েই বসে থাকতে আমার ভাল লাগে,অলস সময়ের পারে বসে রাজা-উজির মারতে আমার ভাল লাগে,হাঁ করে অন্যের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা দেখতেও আমার মন্দ লাগে না,ভবঘুরে হওয়াটা আমার অ্যাম্বিশন না হলেও ছা-পোষা হওয়াটা বেশ একটা আরামদায়ক ব্যাপার বলেই আমার মনে হয়েছিল,যদিও সেটা কখনো পরীক্ষার খাতায় লিখতে পারিনি,যে জন্য মনে হয় পরীক্ষাতে কখনো আমার জীবনের লক্ষ্যটাও লেখা হয়ে ওঠেনি।
এত বড় একটা চিঠি লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে সময়টা আরো প্রোডাক্টিভ কোন কাজে হয়তো লাগানো যেত যেখানে এই চিঠি কেউ পড়বেই না। অনলাইনে বিডিজবসে ঢোকা যেত দু'একটা বড় ভাইকে নিষ্ফলা তেল দেয়া যেত বন্ধুদের কারো কাছে তাদের সাফল্যের গল্প শুনে যুগপৎ ঈর্ষান্বিত আর অনুপ্রাণিত হওয়া যেত বা দেশের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে বারাক ওবামা বা জন ম্যাককেইনের দেশে যাবার জন্য ছোটখাট কোন ইউনি'র খোঁজ করা যেত,নিদেনপক্ষে যে হতচ্ছাড়া সিভি বানিয়ে রেখেছি সেটা একটু মাজাঘষা করে আরো হতচ্ছাড়া কোন চাকরিদাতার কাছে ডাকবে না জেনেও পাঠানো যেত। সেটা না করে আপাতত ভাবছি অনেকদিন শখ করে বৃষ্টিতে ভেজা হয়না ফাইলপত্র নষ্ট হবার ভয়ে আর বসুন্ধরা সিটিতে গিয়ে গাড়িওয়ালা পোলাপান আর সুন্দরীদের দেখে ঈর্ষান্বিত হওয়াটাও
হয়ে ওঠেনা। অনেকদিন ক্যাফেটেরিয়ার বিস্বাদ চা ভাগ করে খাওয়া হয়না আর টেবিল চাপড়ে কারো ১৪ গুষ্ঠি উদ্ধার করা হয়না। অনেকদিন ২-৩ বন্ধু মিলে রিকশাতে হাওয়ার সাথে ঝালমুড়ি বা পেয়ারা কামড়ে অর্থহীন গল্প করা হয়না,আর অনেকগুলো দিন তোমার বা কারো কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলা হয়না,সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি গানটাও গুনগুন করা হয়না সেও তো অনেকদিন হয়ে গেল। অর্থহীন পরিকল্পনা করে দেশ উদ্ধার করা হয়না সবাই মিলে সেটাও কতদিন হলো?
জানি কি ভাবছো,সবাই যা ভাববে সেটাই,এর জীবনে কিছু হবেনা,এমনি এমনি কি আর ব্যাটাকে পাত্তা দেয়না কেউ? তা সবার জীবনে কিছু হতেই হবে এমন কথা নেই,এলোমেলো চুল-দাড়িতে ছন্নছাড়া দিন আমি এখনো টের পাই,রাত ২টায় নির্জন রাস্তায় একদল অকাজের ছেলের রিহার্সালের রাতগুলো এখনো আমার মুখে মুচকি হাসি এনে দেয়। জীবনানন্দ নিয়ে আমার কোন প্যাশন আমার ছিল বলে মনে পড়ে না কিন্তু গৃহী মানুষও মাঝে মাঝে বিপন্ন বিস্ময় তার রক্তের মাঝে টের পায়,সেখানে অর্থ-বিত্তের ছোটাছুটি খুব বেশি অর্থহীন মনে হয়,যেমন তোমাদের কাছে অর্থহীন মনে হয় আমার খটখট কীবোর্ড টেপাটেপি।
কাজেই বেলা,অথবা যে কেউ,আমি চাকরিটা এ মাসের শেষ দিন ছেড়ে দিচ্ছি,এমন না যে আমি আর কোথাও নেব না দাসত্বের কাজ,কিন্তু দু'-একটা দিনের শান্তির ঘুমের জন্য পালিয়ে যাব কোথাও। আমি অন্ধকার রাস্তায় এলোমেলো হাঁটব,আমি বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব,আমি ক্যাফেটেরিয়াতে বসে স্মার্ট ছেলেমেয়েদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে যুগের হাওয়া বোঝার চেষ্টা করবো,ধানমণ্ডি লেক নয়তো বসুন্ধরার সিঁড়িতে বসে টাকা-পয়সার ঝনঝনানি অথবা দামী গাড়ির ঝলমলানি দেখে তোমাকে সেখানে ভাববো,গুলশানের দামি রেস্তোঁরার সামনে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে বাসের ভাড়া গুনবো। বুঝলে বেলা ডার্লিং,উঁচু,অনেক উঁচু যে পাহাড় চূড়ার দিকে আমরা সবাই ছুটে যাচ্ছি সেখানটাকে আমার কেন যেন শূলের আগা মনে হয়,তুমি বরং সেখানে ঝুলে থাকা কারো হাত ধরে সুখে উড়তে থাকো,আমি ঘননীল জোছনায় শিশিরে ভিজবো একাকী অথবা খুব সাধারণ কারো হাত ধরে,বালুকণার স্পর্শ নেব ঘাসের ডগা ছুঁয়ে।
ইতি,
আমার নাম লিখতে ইচ্ছে করছে না।