আজকাল আমার খুব খিদে পায়। কেন পায়? জবাব খুঁজি। যেখানে আমার কথা উঠলেই সবাই বলতো পাখির আহার,অথবা দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য একদম প্রায় অরুচির মত না খাওয়ার স্বভাবটাকে দায়ী করতো,তার এখন সারাদিন খাইখাই লাগে। সেদিনও এক বন্ধুকে যখন বললাম তুমি বেশি খাও,আমাকে বললো,তুমি তো দু'চামচ খাও,ঐভাবে দেখলে তো আমাকে পেটুক মনে হবেই। খুব পছন্দের খাবারটাও আমি অল্প খেতাম,সেই আমার কেন এখন সারাদিন পেটটা খালি মনে হয়? কেন খুব সাধারণ খাবার দেখলেও খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে,মনে হয় সারাদিনেও কিছু খাইনি? খাবার দিন দিন দামী আর দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে বলেই কি,এমনকি মধ্যবিত্তের জন্যও?
মধ্যবিত্তকে বিলাসদ্রব্য বা বাড়ি-গাড়ি নিয়ে চিন্তিত দেখা গেলেও,দৈনন্দিন চাল-ডালের যোগানে টান পড়ার চিন্তা খুব বেশি যে করতে হতো,তা না,অন্তত আমি করিনি,সৌভাগ্য। বাড়িতে ভিক্ষুক বা না খাওয়া ১টা মানুষ এলে,তাকে ১ মুঠো চাল বা সকালের বেঁচে যাওয়া ভাত-তরকারি দিয়ে দিতেও প্রায় কারোরই দ্বিধা ছিলোনা,এমনকি গ্রামেও গৃহস্থের ঘরে ঘরে ঘুরলে না খাওয়া মানুষগুলো রান্নার চালটুকু নিয়ে ফিরতে পারতো বেশিরভাগ জায়গাতেই। এখন পারেনা,দ্বিধা ছাড়াই বলতে পারি। চালের কেজি ৪৫ টাকা,মোটা চালও ৪০ টাকার কম না,ডাল ৬০-৭০ টাকা(কোন ব্যাটা এখন বলবে এটা গরীবের আমিষ?),আটাও নাকি ৫০ টাকা,রুটি খেয়ে ডায়েটের শখ থাকলে এখন আটা কিনে বসে থাকলেই হবে,দুশ্চিন্তাতেই মেদ কমে যাবার কথা। মুষ্টিভিক্ষা দেয়াটাও এখন নিম্নমধ্যবিত্তের আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে,মধ্যবিত্ত এখন চাইলে ২টা টাকা দিয়ে দেবে কিন্তু একমুঠো চাল দিতে দু'বার ভাববে।
তো,এসবের সাথে আমার খিদে পাবার যোগটা কোথায়? ভেবেছি। আর ভেবে,একটা সময়ের অপক্ক চিন্তার জন্য অনুতাপও করছি। বাড়িতে মাঝে মাঝে ভিক্ষুক এলে,ছোটবেলায় দেখতাম,ভাত চাইলে মা দিত,ভাতের সাথে হয়তো বেঁচে যাওয়া তরকারি বা একটু ডাল,তাই গোগ্রাসে গিলতো মানুষগুলি,আমার ছোটবেলা থেকে আদরে মানুষ হওয়া মনে আর চোখে যে সেটা খুব একটা ভালো ঠেকতোনা,বলাই বাহুল্য। মা'কে যখন বলতাম এরা এরকম হুম-হাম করে কেন খাচ্ছে,মা খালি বলতো,খিদের জ্বালা তো বুঝো না বাবা,বুঝলে খাওয়া নিয়ে এইরকম ঢং-আল্লাদ করতে না আর মুখে তুলে খাওয়ানোর জন্য তোমার পিছনে আমাকে দৌড়ানো লাগতো না,তোমার অনেক বড় কপাল। সেইসময় বুঝতাম না,আজকাল কি একটু বুঝি? যখন নিচু স্বরে বলা বাবার "তেলের প্যাকেট ৪৯০ টাকা হয়ে গেছে" শুনি আর কপালে হালকা দুশ্চিন্তার রেখা দেখি,তখন সামনে রাখা অপছন্দের ভাজিটাও অনেক বেশি দামী মনে হয়,চেটেপুটে শেষ করে দিই,তা-ও তো পাচ্ছি আমি,বাপের ঘাড়ে বসে বসে,দিন আনে দিন খায় মানুষগুলো কোথায় যাচ্ছে? পরের দিনের খাবারটার অনিশ্চয়তা থাকলেই বুঝি মানুষের রুচি এভাবে বেড়ে যায়! নাকি আমার খিদেটা ঐ পরিবারটাই বাড়িয়ে দিয়ে গেল,ঐযে,বরিশাল থেকে ঢাকাতে একটা আশ্রয়ের সন্ধানে এসে যে মহিলা ৩ বাচ্চাসহ রাস্তায় বসে তীব্র শীতে কাঁপছিলো আর কাঁদছিলো? শুধু রাতটার জন্য পাশের বাসার বারান্দাটায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়াতে আর একবেলা খাবার চাল-ডাল পেয়ে যে খুশি আর নিশ্চিন্তির ভাবটা মানুষগুলোর মুখে দেখলাম,এরপর থেকে ডাল রান্নার গন্ধেই মনে হচ্ছে পেট খালি হয়ে গেছে,এতদিন ডালের স্বাদ বুঝিনি কেন??
ফাস্টফুডের দোকানগুলোর দিকে আগে বিশেষ ফিরে তাকাতাম না,এখন সেখানে নাদুসনুদুস সুখী সুখী খাদকগুলোকে দেখলেই কেমন জানি এদের কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে,রাস্তার যে ছেলেটা দোকানের বাইরে বসে আছে সে-ও কি আমার মতই ভাবছে নাকি,না আমার মধ্যবিত্ত মানসিকতা সামান্য অভাবের টানেই নরখাদক হয়ে গেলো? আগোরা'র ৯০০ টাকা কেজি নাশপাতিগুলো বেশি সুস্বাদু নাকি সেটা যাদের ঝোলায় ঢুকছে সেই ইংরেজি বলা আল্ট্রা মডার্ন ছেলেমেয়েগুলো,সেটাও ভাবি। রোজ ২৫০-৩০০ টাকার বার্গার সাঁটানো পাজেরো লেক্সাস হাঁকানো ২১০০ কোটি টাকা চুরি করা তিতাসের কাদের মোল্লার পরিবারবর্গকে গ্রিল করে আমাদের চাল-ডালের বিকল্প হিসেবে চালানো যায় কিনা তাও বিবেচনা থেকে বাদ যায়না। মাথাটাই গেছে মনে হয়,আবারো খাওয়ার চিন্তা। এই ফকিরি মানসিকতার জন্যই সারাজীবন খাইখাই করা লাগবে মনে হচ্ছে,রাস্তার পাশে বসে থাকা হাভাতে লোকগুলির জুলজুলে চাউনি দেখার চেয়ে ওদের পেটে লাথি মেরে নিত্যখাদ্য মজুদ করে বরং নিজের বৌ-ছেলেমেয়ের জন্য জমাও হে গর্দভ,তাহলে ওরাও পিজ্জা হাটে বসে ৫০০ টাকার ফ্যামিলি সাইজ সাঁটাবে,তোমার মত বাইরে থেকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেনা,নিজেকে বলি,মনে মনেই যদিও,কিন্তু বিড়বিড় করেও খানিকটা,মানুষজন একটু অবাকই হয় আজকাল এই স্বভাবটার জন্য।
শেষরাতে বসে যখন লেখাটা লিখছি,তখনো বেশ একটা জোর খিদে খিদে,খাইখাই ভাব। কি খাওয়া যায়? নাবিস্কোর বিস্কুটের প্যাকেটটা খুলি,এককালে অখাদ্য মনে হওয়া বিস্কুটটা আজকে খুবই লোভনীয় লাগে,খেয়ে ফেলি বরং ৩-৪টা। মুড়ি আছে বাসায়,৪৮ টাকা কেজি মনে হতেই খিদে আরো বেড়ে যায়,ঝটপট খানিকটা চালান করে দিই মুখে। সারাদিন না খাওয়া বাচ্চাগুলির মুখটা মনে পড়ে,কে জানে এখান থেকে তো চলে গেল,আজকে খাওয়া জুটলো কিনা? মুড়ি চিবানো বেড়ে যায় আমার,বুভুক্ষুর মত খেয়ে চলি,১০০ বছরের মজুদ একবেলাতেই পেটে ভরে নিতে চাই, এ'বেলা তো খেয়ে নেই,খাওয়া যখন জুটেই গেছে! যেমন ওদের চোখের ক্ষুধার্ত ভাষায় লেখা থাকে,বিড়বিড় করে উঠি,আপনমনে--"ভাত দে হারামজাদা,নইলে মানচিত্র খাবো,তোর লাল রঙের গাড়িটা খাবো,আর তোর নাদুসনুদুস মাখন খাওয়া কুকুরগুলোকেও খাবো।"