গল্প তিন
মতিন সাহেব অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। বয়স ৭৮, থাকেন গুলশান ২ এভিনিউতে নিজের বাড়িতে। গুলশানে থাকেন শুনলেই যেমন একটা আভিজাত্যে ভরপুর প্রাচুর্য্যপূর্ণ চরিত্র মনে ভেসে আসে মতিন সাহেব মোটেও তেমন মানুষ নন। খুব সাদা-সিধে, ছোটখাট মানুষ। রাস্তায় হাঁটলে অন্য দু’দশজন থেকে তাকে খুব আলাদা করে বোঝা যায় না। তবে তাঁর চেহারার মধ্যে একটা নূরানি-ভাব আছে সবাই বলে, তা নিয়ে তিনি খুব আহ্লাদিত নন।
মতিন সাহেবের দোতলা বাড়িটি সরকারের কাছে পাওয়া জমিতে তোলা। ৮০’র দশকের ঘটনা, তখনও গুলশান সুনসান, এখানে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেনাকাটা করতে আসছে, দেশি-বিদেশি কোম্পানীরা অফিস খুলছে তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করা যেত না, বরঞ্চ এ কথা বললে লোকে নির্ঘাত পাগল ঠাউরাতো! সোনালি ব্যাংকের লোন নিয়ে বাড়িটি করেন মতিন সাহেব অন্য অনেকের মতই, লোন-টোন সব শোধ দিয়ে দিয়েছেন তাও অনেকদিন হলো।
ফজর নামাযের পর হাঁটতে বেরুনো মতিন সাহেবের অনেক পুরনো অভ্যাস। আগে যখন গুলশানে এত অফিস-আদালত, স্কুল কলেজ হয়নি তখন প্রতিবেশী, সমসাময়িক অন্য সরকারী কর্মকর্তা যারাও এদিকটায় বাড়ি করেছিলেন সবাই মিলে একসাথে হাঁটতেন। কালের পরিক্রমায় তার সমসাময়িক কেউ কেউ আর বেঁচে নাই, কেউ বা পাড়ি জমিয়েছেন পশ্চিমা দেশগুলোতে এবং বেশিরভাগই অনেক টাকার বিনিময়ে বাড়ি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানীর কাছে বেঁচে চলে গেছেন অন্য কোথাও। তাদের সাথে আর যোগাযোগও নেই তাঁর।
মতিন সাহেব গুলশানের যে জায়গাটাতে থাকেন সেখানটা আগের মতো নেই বটে; তবে এখনও অন্য যে কোন এলাকার চাইতে সুনসান; আশেপাশে পার্ক, দু’একটা খেলার মাঠ, পাখিদের কল-কাকলি বাঁচিয়ে রাখছিল তাকে। গত ক’বছর থেকেই একধরণের আতংকে গ্রাস করতে থাকে, মনে হয় যেন পুরনো বাড়িগুলো কথা বলছে তার সাথে। এপার্টমেন্ট করবার জন্য ভেঙে ফেলা বাড়ির দেয়ালগুলো তার সাথে কথা বলে, একেকদিন ভোরে তিনি দেখেন একেকটি ভাঙা বাড়ির কংকাল, যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুর করুণ আর্তনাদ।
মতিন সাহেব একেকটি বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যান, সাথে মনের ভেতর ভেসে আসতে থাকে একেকজন মানুষের স্মৃতি, ইতিহাসের নানা সাক্ষী-সবুত। সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টি, উনসত্তুর, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ।
মতিন সাহেবের বয়স বাড়তে থাকে প্রতিদিন, সাথে সাথে গুলশান এলাকায় কমতে থাকে পুরনো বাড়ির সংখ্যা। মতিন সাহেবকে প্রতিদিন নিজের সাথে যুঝতে হয়, তিনি ভাবেন গুলশানের শেষ দোতলা বাড়িটি কি তবে তারই নাকি তিনিও পরাস্ত হবেন সভ্যতার কাছে, বয়সের কাছে!
গল্প চার
সুবর্ণচরের কৃষক ফারুক মিয়াকে চেনেন? ফারুক মিয়ার জীবনে কি আছে আর কি নেই তা কেউ জানে না। ফারুক মিয়া নিজেও বুঝে ওঠে না সে কি চায় বা কি চায় না। মানুষ সৃষ্টির রহস্য তাকে ভাবায় না; কিন্তু অলৌকিকভাবে শিক্ষিত হয়ে ওঠা ফারুক মিয়া দুনিয়াদারীর খবর রাখেন। কোন কোন অমাবস্যার রাতে তার মনে হয় দুনিয়ার তাবৎ রহস্যের সমাধার বোধহয় আছে তার এই সুবর্ণচরের নারিকেল বাগানের পিছে, যেখানে বালিয়াড়ি মেশে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় আর অন্ধকার রাতেও আকাশে ফুটে থাকে কোটি তারার মেলা!
সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর প্রতি সন্ধ্যায় ফারুক মিয়া গোসল করে ঠান্ডা পানিতে। ভাত খায়। ভাতের সাথে একেকদিন একেক সালুন। তাঁর বউ রান্না ভাল করে। কচুঘেঁচু যাই রান্না করে খেতে বড় ভাল লাগে ফারুক মিয়ার। খেয়ে দেয়ে বাড়ির কাছের চায়ের দোকানে বসে পান খায়, গান গায়, আকাশের তারা গুনে। কোনদিনও শরীরে জোর থাকলে আবার বাড়ি ফিরে বউটাকে কাছে টানে, আদর সোহাগ করে, রাতের নিরিবিলিতে সেই আদরের শব্দ শোনা যায় সুবর্ণচরের অন্য পাড় থেকেও।
বউয়ের সাথে ভালবাসা করুক কিংবা নাই করুক, অলৌকিক জ্ঞানপ্রাপ্ত ফারুক মিয়া সন্ধ্যা করে চরের এক কোণায় এসে একা একা বসে থাকে। রাতের অন্ধকারের মধ্যেও যে আলো, নারিকেল গাছের পাতায় পাতায় রাতের বাতাসে ঘষা খেয়ে যে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ আসে তাঁর মধ্যে সে শোনে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা।
সুবর্ণচরের এক কৃষক যে দু’বেলা চাষ দেয় জমিতে আর মানুষে; তার আধ্যাত্মিকতা ভাবিয়ে তোলে বঙ্গোপসাগরের নোনা জলকে, বাদাম খেতের বড় বড় দানার বালিকণাকে আর আর ভাবায় নারিকেল বাগানের ভেতরে লুকিয়ে থাকা না দেখা এক অদৃশ্য শক্তিকে যার দায়িত্ব সুবর্ণচরের মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা।
এ দু’টি গল্পেরই পরিণতি জানা যাবে ২০১৫ বইমেলায় প্রকাশিতব্য শামীম আহমেদ এর গল্পগ্রন্থ অদ্ভুত ইঙ্গিত আসে ঈশ্বর থেকে'র পাতায় পাতায়! কিংবা হয়ত জানা যাবেনা!
শামীম আহমেদ
২০ অগাস্ট ২০১৪
বনানী, ঢাকা
https://www.facebook.com/shamimahmedjitu