ছোটবেলা যখনই বাবা-মার সাথে কারো বাসায় বেড়াতে যেতাম, তখন একটা জিনিস খেয়াল করতাম যে - সে বাসায় স্কুলপড়ুয়া কোনো ছেলেমেয়ে আছে কিনা। থাকলে আমি তার টেবিলে যেয়ে বাংলা বই বের করে কবিতা পড়তাম। অবশ্য এমন নয় যে, আমি খুব পড়ুয়া ছিলাম তখন। কিংবা কবিতা বুঝে উলটে দিতাম। তবে বইয়ের ছবিগুলো দেখতাম উল্টেপাল্টে। আমার তখন হাশেম খানের আকাশ দেখে মুগ্ধ হবার বয়স। ভাবতাম, কবে বইগুলো আমার ক্লাসের পাঠ্যবই হবে। বোধহয় তখন থেকেই বাংলা কবিতা আমাকে দখলে নিতে শুরু করেছে।
তারপর কখন যেন আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, বাংলা পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর ভাষা - সবথেকে আদরের - সবথেকে বিস্ময়ের। আর এ ভাষার কবিতা তো এক মাদকতার নাম। যদিও এখন অনেকেই কবিতার নামে আঁতকে ওঠেন। তাদের সবাইকে অবশ্য দোষ দেয়াও যায় না। কারণ কবিতার মোড়কে 'অস্বস্তি' ফেরী করে ফেরা লোকের সংখ্যাও তো কম নয় এখন। তবু নান্দনিক অমৃতমধুর কবিতা কখনোই অপ্রতুল হয়নি বাংলা নামের মধুর ভাষাটিতে। মানুষ মুগ্ধ হয়েছে সেসব কবিতায়।
তেমনই একটি কবিতা - 'মানুষের কেউ কেউ'
পুর্ণেন্দু পত্রীর এই কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে -
সবাই মানুষ থাকবে না ।
মানুষের কেউ কেউ ঢেউ হবে, কেউ কেউ নদী
প্রকাশ্যে যে ভাঙে ও ভাসায়।
কবিতার শুরুতেই কী ভয়ংকর কথা ! সবাই মানুষ থাকবে না। কী হবে তাহলে ? কবি বলছেন, কেউ কেউ নদী হবে, ভাঙবে; আবার মানুষেরই কেউ কেউ ঢেউ হয়ে ভাসাবে।
কী ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখিই না হতে হল প্রথমেই। মানুষ হয়ে জন্মেও সবাই তাহলে মানুষ থাকবে না। কী ভীষণ সত্য। কী অকপট স্বীকারোক্তি। সবাই কি মানুষ থাকে শেষ পর্যন্ত? অগণিত মানুষের মধ্যে ক'জন সত্যি মানুষের মতো মানুষ পাওয়া যায়? মানুষেরই কেউ কেউ প্রবল ছোবলে মনের পাড় ভাঙে; আবার মানুষেরই কেউ কেউ ভালোবেসে ডুবে যাওয়া মানুষকে ভাসায়। এরপরই কবি বলেন ----
সমুদ্র সদৃশ কেউ, ভয়ঙ্কর তথাপি সুন্দর ।
কেউ কেউ সমুদ্রের গর্ভজাত উচ্ছৃঙ্খল মাছ।
কেউ নবপল্লবের গুচ্ছ, কেউ দীর্ঘবাহু গাছ।
সকলেই গাছ নয়, কেউ কেউ লতার স্বভাবে
অবলম্বনের যোগ্য অন্য কোনো বৃক্ষ খুঁজে পাবে।
মানুষের কেউ কেউ হবে সমুদ্রের মতো। বিশাল। বিস্তৃত। ভীতিপ্রদ তথাপি সুন্দর। কেউ কেউ বিশাল সমুদ্রের মধ্যে লালিত উচ্ছৃঙ্খল মাছ। সমুদ্র চুষে বেঁচে থাকবে তারা। এই লাইনগুলোতে খুব সুন্দরভাবে দু'ধরণের মানুষের কথা বলা হয়েছে - একদল যারা সমুদ্র সদৃশ, যারা দীর্ঘবাহু গাছ। আরেকদল সমুদ্রের আশ্রয়ে থাকা, বা লতার স্বভাবী পরগাছা। পরগাছা মানুষেরা কি নেই আমাদের আশেপাশে? অবলম্বনের যোগ্য বৃক্ষ খুঁজে পেয়ে পরগাছা কি হয় না মানুষ? তবু কবি বলছেন -
মানুষ পর্বতচূড়া হয়ে গেছে দেখেছি অনেক
আকাশের পেয়েছে প্রণাম।
আবার বলছেন,
মানুষ অগ্নির মত
নিজে জ্বলে জ্বালিয়েছে বহু ভিজে হাড়
ঘুমের ভিতরে সংগ্রাম।
আর এর পরের লাইনগুলো ঠিক যেন স্বপ্নের মত সুন্দর। কুসুমের মত নরম। শরতের আকাশের মত নয়নাভিরাম।
অনেক সাফল্যহীন মরুভূমি পৃথিবীতে আছে টের পেয়ে
ভীষণ বৃষ্টির মতো মানুষ ঝরেছে অবিরল
খরা থেকে জেগেছে শ্যামল।
মানুষেরই রোদে,
বহু দুর্দিনের শীত মানুষ হয়েছে পার
সার্থকতাবোধে।
তাই নয় কি? মানুষই তো মানুষের বিপদে, দুঃখের দিনে মানুষেরই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষই হয়েছে মানুষের পরম আপনজন। মানুষেরই হৃদয়নির্যাসে সিক্ত হয়েই তো খরা থেকে জেগেছে শ্যামল। আর তাই অগ্নির মত মানুষ নিজে জ্বলে জ্বালিয়েছে বহু ভিজে হাড়। কর্মহীনকে করেছে কর্মক্ষম। বলহীনকে সবল। মানুষ শুধু মানুষ থাকেনি উঠেছে আরো উর্ধ্বে কিংবা পতনে হয়েছে নিম্নমুখ। তাই তো কবির উচ্চারণ - সবাই মানুষ থাকবে না।
প্রশ্নটা অনিবার্যভাবেই চলে আসে। কী হবে তাহলে ?
উত্তরে কবি বলেন -
সবাই মানুষ থাকবে না ।
কেউ কেউ ধুলো হবে, কেউ কেউ কাঁকর ও বালি
খোলামকুচির জোড়াতালি।
কেউ ঘাস, অযত্নের অপ্রীতির অমনোযোগের
বংশনুক্রমিক দুর্বাদল।
আধারে প্রদীপ কেউ নিরিবিলি একাকী উজ্জ্বল।
সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ,
কেউ বা সন্ধ্যার শঙ্খনাদ।
অনেকেই বর্ণমালা
অল্প কেউ প্রবল সংবাদ।
চরণগুলি বেদনার, কষ্টের কারুকাজে খচিত। কারা হবে ধুলো, কাঁকর কিংবা বালি? কারা ঘাস ভালোবেসে হবে ঘাস; যা অবহেলা আর অযত্নে পড়ে থাকে পায়ের তলায় চিরটাকাল - তারা কি কবি ? কবিরা কি আঁধারে প্রদীপ জ্বেলে পড়ে থাকে না একাকী উজ্জ্বল? হয়তো। হয়তো বা, না।
তবু সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ আর শঙ্খনাদের করুণ সুরে অমনোযোগ আর অবহেলায় মানুষের কেউ কেউ হবে একাকী উজ্জ্বল। মানুষের কেউ কেউ হবে ঢেউ, নদী; পাবে অবলম্বনের যোগ্য কোনো বৃক্ষ কিংবা সাগর; হবে পর্বতচূড়া; হবে অগ্নি, রোদ, ধুলো অথবা নিরিবিলি একাকী প্রদীপ।
তবুও - এতকিছুর পরেও - সবাই মানুষ থাকবে না। আর তাই তো কবি শেষ করছেন এই বলে -
অনেকেই বর্ণমালা
অল্প কেউ প্রবল সংবাদ।
------------
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:৩৩