এক
সারাদিন আপত্তিকর হিন্দি গান শুনে সন্ধ্যাবেলা আমাদের ধর্মবোধ জেগে ওঠে। নামাযের হাত বাঁধা নিয়ে খুব একচোট হয়ে যায়। গুগলে তথ্য প্রমাণ দেখিয়ে আপন মতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে বন্ধুদের বলি, এইবার দেখ শালারা, আমার কথা ঠিক কিনা। ওদিকে মুয়াজ্জিন ডাক দেয় ‘হাইয়া আলাস সালাহ’। আমরা বলি, দাঁড়াও বাবা আগে ফয়সালা শেষ করি তারপর আসছি।
নিজেদের খিস্তি-খেউড়ের শব্দে মুয়াজ্জিনের ডাক নিভে গেলে মসজিদের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকে, তবু ধর্মের পাকা জহুরী হয়ে উঠছি- এই গর্বে আমাদের বুক দশ হাত ফুলে যায়। সেই ফোলা বুকের সামনে দিয়ে প্রতিবেশী আহমেদ সাহেবের বড় মেয়ে সুরাইয়া, কোচিং শেষে বাড়ি ফেরার সময়, আমাদের চোখে আগুন ঢেলে দেয়। মুখে কামভাব ফুটিয়ে আমরা ফিসফিসিয়ে বলে উঠি, আহ, খাসা ফিগার মাইরি, একদম খাপে খাপ। তারপর সুরাইয়ার শরীরের জ্যামিতি-পরিমিতি নিয়ে আমাদের মধ্যে রীতিমত গবেষণা শুরু হয়। রাতের সুখস্বপ্নে সেদিন আমরা সুরাইয়াকে বিবস্ত্র করে, সকালে গোসল করে পবিত্র হই।
সাড়ে আটটায় নজরুলের চায়ের দোকানে তুমুল আড্ডা জমে। আমরা নানা বিষয়ে কথা বলি। অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য সবকিছু চায়ের কাপে ঢেলে দেই। তবুও যখন চা তেতো মনে হয় তখন চোখে পড়ে- ইউনিফর্ম পরে সুরাইয়া ওর মায়ের সাথে রিকশা করে কলেজে যাচ্ছে। আমাদের চা তখন সরবত হয়ে যায়, আমরা নজরুলকে গালাগাল দেই, হারামজাদা, চায়ে এত চিনি দিস কেন? নজরুল বিব্রত ভঙ্গিতে ঘাড় চুলকাতে থাকে। আমরা বলি, চারটা বেনসন দে হারামজাদা।
ধোঁয়ার রিং উড়িয়ে আবার সংলাপে মেতে উঠি। কলেজ জীবনে পড়া প্রাণিবিজ্ঞানের ‘প্রজননতন্ত্র’ চ্যাপ্টারটা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করি। উদাহরণ সল্পতায় সুরাইয়ার মাকেও অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবচ্ছেদ করতে হয়। তবে আমরা আগাগোড়া খারাপ ছেলে নই, ভালো ছেলে বলে আমাদের যথেষ্ট সুনাম ছিল। গুরুজন দেখলে আমরাও শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে যেতাম, সালাম দিতাম, আদিখ্যেতা করে বলতাম – চাচা, ভাল আছেন?
বেকার দিনগুলো আমাদের মগজে পাথর না ভাঙলে, এবং মেধার চেয়ে দলালির মূল্য অধিক না হলে, ভদ্রতার ব্যাকরণ আমরা কোনোদিনই শেলফে তুলে রাখতাম না; বরং চোখ-নেই ভিক্ষুক দেখে বিনা জিজ্ঞাসায় মাদার তেরেসা হয়ে উঠতাম। কিন্তু ভাগ্যের চাকা খাঁদে আঁটকে পড়ায় আমরা এখন সুরাইয়ার বুকের উচ্চতা মাপি, উঠতে বসতে চা-দোকানদার নজরুলকে গালমন্দ করি, সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরপাক খাই। তারপর এক আকাশ ধোঁয়া বুকে জমিয়ে লাল চোখ নিয়ে গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরি। বাবা কৈফিয়ত চাইলে দরজায় লাথি মেরে বলি, ধুত্তোরি, ভাল্লাগে না। অথচ একসময় এই আমরাই জব-সল্যুশনের দাগানো পৃষ্ঠায় স্বপ্ন গেঁথে প্রেমিকাকে বলেছিলাম - আর মাত্র কিছুদিন, তারপর সব হবে।
দুই
টাকা?
নেই।
সুপারিশ ?
নেই।
বিদেশী ডিগ্রী?
নেই।
প্রতিযোগিতায় হারব না বলে বাজারের সবগুলো বইয়ের পাতায় আমরা তর্জনী ঘুরিয়েছি। যে ঐকিক নিয়ম আর শতকরা হিসেবের ভয়ে-আমরা শৈশবে রবীন্দ্রনাথ হতে চেয়ে স্কুল পালিয়েছিলাম, সেগুলো আবার হারানো মানিকের মতো বুকে তুলে নিয়েছি। প্রোবাবলিটির জটিল চ্যাপ্টারে আমাদের ঢুলু ঢুলু চোখ রাখব বলে- প্রেমালাপ সংক্ষিপ্ত করে প্রেমিকাকে বলেছি, এখন রাখি, কাল আবার কথা হবে।
সেসব নিষ্ঠুর রাতে আমাদেরকে জানতে হয়েছিল - কে কোথায় কখন মরে গিয়ে ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে, কোন রাজার প্রাসাদে জন্ম নিচ্ছে ফুটফুটে মানবশিশু, কতবার কারা ছিঁড়ে খেল প্রতিবেশীর মানচিত্র, কোথায় পাওয়া যায় দ্রুততম পতঙ্গের দেখা, কিংবা ওজনস্তর কতটুকু ফুটো হলে পৃথিবী তলিয়ে যাবে অতলে। আমরা মরুভূমির উটের মতো ক্যাকটাস মুখে পুরে সে সব তথ্য চিবিয়ে খেয়েছিলাম, সুবোধ বালকের মতো আঁখিপল্লবে কাঁচামরিচ ঘষে কণ্ঠস্থ করেছিলাম সবকিছু। ভেবেছিলাম, আর তো মাত্র কিছুদিন, তারপর সব হবে - আমাদের স্বপ্নগুলো পাখা গজিয়ে উড়তে শিখবে, আমাদের প্রেমিকারা সে পাখার নিচে অভিমানী বউ হয়ে খুনসুটি করবে আর আমরা প্রাণ খুলে গাইব, আহা, আজি এ বসন্তে।
একদিন সেই আকাঙ্ক্ষিত দিনে, সকালে স্নান সেরে মায়ের পায়ে হাত ঠেকিয়ে আর বাবার আশীর্বাদ নিয়ে আমরা নজরুলের চায়ের দোকান পিছনে ফেলে সগর্বে সোনার হরিণ আনতে স্বপ্নভবনে ছুটেছিলাম। তারপর একান্ত বৈঠকে বসে ‘কোনো সুপারিশ আছে কিনা ?’ – এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম, আমাদের এতদিনের সব ভাবনায় শুভঙ্করের ফাঁকি ছিল। এ যাবত শুধু ভুল তথ্যাদি মগজে পুরে রাতের ঘুম নির্বাসনে পাঠিয়েছি, বাবার পেনশনের টাকায় বোতলের পর বোতল ফুরিয়েছি নিদ্রাকুসুম। শহরের স্বপ্নভবনগুলো সেদিন আমাদের গলা ‘সুপারিশ নেই?’ - বলে টিপে ধরেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত দু’টুকরো কাগজ হাতে করে সেদিন আমাদের বুঝতে হয়েছিলো জীবন আসলে কতটা বাস্তব। কচ্ছপ পায়ে বেঁধে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমাদের অনেক রাত হয়েছিল সেদিন এবং তারপর থেকেই আমাদের সব মন-খারাপেরা মূল্য হারিয়ে ‘ন্যাকামো’ উপাধি পেয়েছিল।
বিত্তহীন স্বদেশী ডিগ্রীধারী এই আমরা হতাশায় পকেটে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অনেক আগেই আমাদের প্রেমিকাদের বাড়িতে সরকারী উচ্চপদস্থ অফিসারদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। এবং আমাদেরই একসময়ের প্রেমিকারা -যারা চিরকাল পাশে থাকবে বলে কথা দিয়েছিল – আমাদেরকে বখাটে অকর্মণ্য ছেলে বলে চারিত্রিক সনদপত্র পাঠায়। আমাদের কেউ কেউ ন্যাকামো করে আত্মহত্যা করতে না পারার ব্যর্থতা বুকে নিয়ে হাসপাতালে রাত কাটাতে থাকে। আমরা খালি হাতে হাসি মুখে দেখতে যাই, কান মলে দিয়ে বলি, শালা রামছাগল, মরতেও জানিস না! মরতে না পারার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে এভাবেই বাধ্য হয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। তবু অবসরে আমরা ডেল কার্ণেগি, শিব খেরা, অথবা শ্রেষ্ঠ মনীষীদের জীবনী পড়ে নিজেদের সাহস দেই, বলি, ইউ ক্যান উইন।
তিন
বইয়ের লেখার সাথে জীবনের লেখা মেলে না বলেই আমরা ক্রমাগত হেরে যাই, পিছিয়ে যাই, ভড়কে যাই। বাসের হেলপার, পার্কের বাদামওয়ালা, কিংবা রাস্তার রিকশাওয়ালার সাথেও কথা বলতে ভয় পাই। আড়ষ্ট থাকি। আমাদের আত্মবিশ্বাসে পলি জমে। নিজেদের অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। চারপাশে কেবলই জীবনানন্দ দাশের অন্ধকার ঘন হতে থাকলে আমরা মাথা নিচু করে আবুল হাসানের মতো শেষমেশ বলে উঠি, ‘আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি।’
এই আত্মসমর্পনে শহরের রুই কাতলারা খুশি হয়ে বুকে টেনে নিলে আমাদের বেশভূষা বদলে যায় জুয়েল আইচের ম্যাজিকের মতো। ফুলহাতা-শার্ট হাফহাতা টি-শ্যার্ট হয়ে যায়, হাতে স্টিলের বেসলেট ঘড়ির জায়গা দখল করে নির্লজ্জের মতো হাসে। আমরাও মুখে বেনসন ধরিয়ে নিয়ে হো হো হো করে হেসে উঠি। চা-দোকানদার নজরুল কিছু বুঝতে না পেরে প্যাঁচার মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।
আমাদের সাহস বাড়তে বাড়তে আকাশ স্পর্শ করলে তখন কাউকে আর তোয়াক্কা করি না। হাতে অস্ত্র নিয়ে দেশ উদ্ধারে রাস্তায় নামি, আর কিভাবে যেন আমাদের পুষ্টিহীন মানিব্যাগ রাতারাতি স্বাস্থ্যবান কলাগাছে পরিণত হয়। রাস্তার সকলে ভয়ে কেমন সিটিয়ে যেতে থাকে যেন আমরা সুন্দরবনের বাঘেরা হরিণ শিকারে নেমেছি। সোনার হরিণ ধরতে পেরেছি ভেবে বাড়িতে ফিরে দেখতে পাই মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। আর সেদিন থেকেই আমরা বাবার চোখে চোখ রাখার অধিকার হারিয়ে ফেলে ভীষণ একা হয়ে যেতে থাকি।
নিজের বাড়িতে বহিরাগত হয়ে যাবার পর থেকে নজরুলের চায়ের দোকানের কাঠের অনুচ্চ বেঞ্চগুলোকেই আমাদের বেশি আপন মনে হয়। আমরা সকাল সন্ধ্যা রুটিন করে চায়ের কাপে ঝড় তুলি। প্রতিবেশী আহমেদ সাহেবের বড়ো মেয়েটা কোচিং সেরে বাড়ি ফেরে। আমরা হা করে সে দৃশ্য গিলে শিস দিয়ে প্রকৃত বখাটে হওয়ার চেষ্টা করি। ওদিকে মোয়াজ্জিন ডাক দিয়ে যায়, ‘হাইয়া আলাস সালাহ’।
চার
বেকার দিনগুলো আমাদের মগজে পাথর না ভাঙলে, এবং মেধার চেয়ে দলালির মূল্য অধিক না হলে, ভদ্রতার ব্যাকরণ আমরা কোনোদিনই শেলফে তুলে রাখতাম না; বরং চোখ-নেই ভিক্ষুক দেখে বিনা জিজ্ঞাসায় মাদার তেরেসা হয়ে উঠতাম।