ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আজ আবার গোধূলির আকাশের দিকে তাকালো সে। আকাশের রঙ লালচে হলুদ। ভাসা ভাসা মেঘ দৌড়ে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। মেঘগুলো ঘোলাটে কিংবা আকাশের বিচ্ছুরিত রঙের মতো রঙিন। গত দুদিন বৃষ্টি হয়নি। আরো কতদিন হবে না - কে জানে।
এভাবে আকাশের দিকে মুখ করে থাকার অবশ্য কোনো মানে নেই। একাকীত্ব বিসর্জন হয় না ওতে। শুধু যন্ত্রণাই বৃদ্ধি পায় সহস্রগুণ। সবই তো সে জানে। তবু জানা শোনা অনেককিছুই সবসময় মানা যায় না। শূন্য আকাশ শূন্য মানুষগুলোকে ঠিকই কাছে টানে। দুর্নিবার সে আহ্বান উপেক্ষা করার শক্তি থাকে না তখন।
আজ এই গোধূলিবিষাদে দাঁড়িয়ে তাই আনমনা নাগরিক মন। কিছুটা লালচে রঙের একটা মেঘের দিকে তাকাতেই তার মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে পরিচিত সব মুখ। কিছু কিছু ফিকে হয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। আর কিছু এখনো অমলিন। একটা মুখ তো একেবারে জীবন্ত। মুচকি হেসে ওঠে সে। মুক্তি নেই। মুক্তি নেই। স্মৃতি এক দুর্ভেদ্য কারাগার। সে আজীবন দন্ডপ্রাপ্ত এক আসামি। আকাশের মতোই বিশাল শূন্য তার চারপ্রকোষ্ঠের ছোট্ট মানব হৃদয়।
ব্যক্তিগত ইচ্ছে বিসর্জনের মধ্য দিয়েই তো বয়স বাড়ে। অপরিপক্কতা বদলে যায় অভিঞ্জতায়। নূন্যতম একটি ব্যর্থতার ইতিহাস মানুষ মাত্রেরই থাকে। তার ক্ষেত্রেও তো ব্যতিক্রম কিছু হয় নি। তবে কেন অহেতুক দুঃখবোধ? কেন এমন নিস্তরঙ্গতায় সমর্পিত সে? কেন সেই একমাত্র ব্যর্থতা আঁকড়ে বসে থাকা? কেন আবার নতুন করে আরম্ভ নেই?
উত্তর নেই কোনো। শুধু একের পর প্রশ্ন জমে জমে ভারি হতে থাকে শূন্য অন্তঃকরণ। দু-একটা গভীর থেকে উৎসারিত দীর্ঘশ্বাস। আহ! গভীর থেকে। যেখানে পৌছায়নি কোনো রমনীয় হাত। যেখানে সঞ্চিত আছে কেবলই ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত জরাজীর্ণ ইতিহাস।
২
পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে জীবনের। কম সময় নয় মোটেও। চুলে পাক ধরেছে। শরীরের চামড়ায় শিথিলতার পূর্বাভাস। চোখে চশমা উঠেছে। তবু আজো তার মনের মধ্যে সেই সব ছবি। কতোগুলো ফিকে হয়ে গেছে। তার মাঝে একটা একেবারে জীবন্ত। একটুও ঘোলাটে হয়ে যায়নি। আগের মতোই জ্বল জ্বল করছে। শুধু ছবির মানুষটি আর নেই। কোনোকালে আসেওনি তার ঘরে। বুকের মধ্যে আগুন দিয়ে চলে গেছে। ফিরে তাকিয়ে একবার দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি, যে কতোটুকু পুড়লো সে আগুনে।
ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে তার এককালের সঙ্গিনী। সে নিরাপদ থাকতে চেয়েছিল। তাই নিজেকে কোনো ব্যতিক্রম কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করায় নি। পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদেরকেও বিব্রত করেনি। ছেড়ে দেয়াই তার জন্য সবচেয়ে সহজ ছিলো। সেটাই সে করেছে। এতে তো দোষের কিছু নেই। আর কেউ যদি হঠাৎ সম্পর্কহীন হতে চায়, যে সম্পর্কটা কিনা উত্তোরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নয় বরং বোঝাপড়ায় নির্মিত, ভালোলাগার চাদরে ঢাকা - তাহলে তার জন্য তো কোনো অভিযোগ করা যায় না। কষ্ট হয়। যন্ত্রণা হয়। নিজেকে প্রতারিত আর একা লাগে। কিন্তু এজন্য অভিযোগ করা যায় - এমন আদালত কোথায়? হৃদয়কে যে পায়ে দলে চলে পায় তাকে নীরবেই যেতে দিতে হয়। অন্তরের ব্যাপার নিয়ে আর যাই হোক উচ্চবাচ্য করে কোনো ফল হয় না।
নিজেকে এভাবেই তো বুঝিয়ে এসেছে এতকাল ধরে। মেনেও নিয়েছে এই একাকী জীবন। তবু মানুষের মন তো- তাই কোথায় যেন একটা অসম্ভব ইচ্ছা থেকেই যায়। যদি সে ফিরে আসে। যদি আসে।
আকাশের রঙ বদলে কালো হয়ে এলে গোধূলি পরিবর্তিত হয়ে সন্ধ্যা নামে। সে ঘরে আসে। শূন্য অন্ধকার ঘর। তার জীবনের মতোই একঘেয়ে। ক্লান্তিকর।
৩
গভীর রাতে প্রায়ই তার ঘুম ভেঙে যায়। কিংবা বহুদিন হলো ঘুমই হয় না। তখন ডায়েরিটা টেনে নিয়ে লিখতে বসে। নিজের কথা কিছু কিছু লিখে রাখার বড়ো সাধ তার। সে লিখতে শুরু করে। একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা।
চেয়েছিলাম একটি পথ হবে। মাত্র একটি। বেশি নয়। যদিও আমরা মানুষ ছিলাম দুজন। তবু একটি পথেই আমার ভরসা ছিলো। হোক না সে পথ ভীষণ বিপদসঙ্কুল। থাকুক সে পথে বাঁধার পাহাড়। তবু দুজনের জন্য দুটি ভিন্ন পথ আমি কোনোদিনও চাই নি। তা সে যতো সহজ পথই হোক না।
আমাদের জন্য একটি পথকেই যথেষ্ঠ বিবেচনা করেছিলাম। তবু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বললো, তুমি তোমার মতো ভালো থাকো। আমি আমার মতো।
আমি বাকশক্তি তিরোহিত জড় পদার্থ হয়ে গেলাম। বোধহয় অপরিপক্ক আবেগের আতিশয্যে আমার প্রসারিত হৃদপিণ্ড হঠাৎ সংকুচিত হয়ে গেছে। পড়ন্ত বিকেলের ছন্নছাড়া বাতাসেও আমি বড়ো অসহায় বোধ করছি। আমি যেন মরে যাচ্ছি। তবু আমি কিছুই বলতে পারছি না। ভীষণরকম বিষন্নতা আমাকে জাপটে ধরে বসে আছে। আমি চাইছি তার হাত ধরে একবার মিনতি করে বলি যেন এমন কথা সে আর না বলে। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। চলৎশক্তিহীন অসাড় শরীর নিয়ে আমি স্থির নিঃশব্দ বসে থাকলাম। আর শুধু দেখলাম আমাকে বিমূঢ় করে দিয়ে সে ঝটপট উঠে চলে গেল।
আমাদের দুটি আলাদা পথ তৈরি হয়ে গেল। আমরা একা হতে শুরু করলাম। না, ভুল বললাম। আমি একা হতে শুরু করলাম। ভীষণ একা।
অথচ তাকে বলো যেত, কয়েক বছর আগে যখন সে আমাকে ভালোবাসি বলেছিলো সেটা আমি সত্যি ভেবেছিলাম। এবং ভেবেছিলাম এ কথাটি আমাদের দুজনের জন্য কখনো মিথ্যে হয়ে যাবে না। কেননা আমার দুর্বল হৃদয়টাকে তার হাতেই তো সমর্পণ করেছিলাম। আমি কোনোদিনই ভাবিনি এভাবে আমাদের দুজনের পথ পৃথক হয়ে যাওয়ার এমন কুৎসিত সম্ভাবনা তৈরি হবে। আমার কল্পনার রঙে সাজানো ঘরবাড়ি আচমকা ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাবে।
আর লিখতে পারে না সে। কলম কামড়ে বসে থাকে। অনেক চেষ্টা করেছে লেখাটা শেষ করে আনার কিন্তু পারে নি। আসলে শেষ তো দূরের কথা সে লেখাটায় আর একটি শব্দসংযোগও করতে পারে নি। এরপর আর লিখে লাভ কি? যে গেছে সে তো গেছেই। জীবনের এই পঞ্চাশ বসন্তের অবসানে নিশ্চয়ই তার আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। তবুও কোথায় যেন একটু আশা থেকে যায়।
আগে কতবার তার মরে যেতে ইচ্ছে করেছে। তবু সে এই একটি সান্ত্বনাবাক্যে নিজেকে সামলে নিয়েছে - যদি আসে। যদি তার ইচ্ছে হয়।
সে বুঝেও যেন বুঝতে চায়না খাঁচা ভেঙে পাখি পালিয়ে গেলে সে আর খাঁচায় ফিরে আসে না। তাকে পাওয়া যায় কোনো উঁচু গাছের মগডালে। তবু মানুষের অপেক্ষা সীমাহীন অনর্থকতায় ভরা। শূন্য খাঁচা আগলে সে বসেই থাকে।
৪
ব্যাপারটা প্রথম টের পেয়েছিলেন মা। মায়েরা কিভাবে যেন টের পেয়ে যান। সে অবশ্য অনেক আগের কথা। মাকে সব জানাতে হয়েছিল। মা দুঃখ পেয়েছিলেন ভীষণ। বলেছিলেন, যে গেছে তাকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারবি নে। তুই বরং আবার নতুন করে শুরু কর।
সে শুরু করেছিল। সারাদিন অফিসেই কাটাত। দুঃখী চেহারাটা নিয়ে মায়ের সামনে যেতে তার খুব একটা ইচ্ছেও হতো না। দিনে ব্যস্ত থাকাতে কিছুটা ভুলে থাকা যেত কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরলেই যতো যন্ত্রনা সব ভুত হয়ে কাঁধে চেপে বসতো। মা বলতেন, তুই একটা বিয়ে কর এবার। অনেকদিনই তো হলো।
মায়ের কথা রাখা আর সম্ভব হয়নি। কে জানে- সে দুঃখেই তিনি অতো তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলেন কিনা। মা চলে গেলে তাকে দেখার মতো সত্যিই আর কেউ ছিলো না। বোনটা স্বামীর সাথে দেশের বাইরে সেটেলড। সুতরাং বাড়িটা তখন একেবারে শূন্য। তখন থেকেই অপেক্ষাটা আরো যেন বেগ পেয়েছে। তার কেবলই মনে হতো সে অবশ্যই আসবে। তার প্রেমে তো খাঁদ ছিলো না। তাহলে এমন হবে কেন? সে কেন বঞ্চিত হবে?
কিন্তু থেকে থেকে তার অপেক্ষাই শুধু সার হয়েছে। একের পর এক বসন্ত বিদায় নিয়েছে। গ্রীষ্মের রোদ্রে পুড়ে গিয়েছে তার শরীর। কই? তবু তো সে একবারও আসে নি। একবার চলে গেলে কি আর আসতে নেই? কি জানি! মানুষের সবটুকু কি আর জানা যায়। কেউ চলে গিয়ে সুখ খোঁজে। কেউবা পথ চেয়ে অপেক্ষার অসুখে ভোগে। বড়ো পুড়ে যায় হৃদয়।
বাইরে থেকে অবশ্য বোঝা যায় না। শান্ত সৌম্য চেহারা। নিপাট ভদ্রলোক। অফিসে সবাই মান্য করে। সমীহ করে চলে। কেউ কিচ্ছু জানে না। কিন্তু আমি তো জানি। আমার শিমুল তুলো বুকে মুখ গুঁজে কতো রাত সে কেঁদেই কাটিয়েছে।
প্রথম প্রথম খুব রাগ হতো। পরে আস্তে আস্তে লোকটার জন্য কেমন মায়া পড়ে গেছে আমার।
৫
ওইতো অফিস থেকে ঘরে ফিরে এসেছে সে। চশমাটা খুলে রেখে একটানা লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে থাকবে এখন। একঘন্টা শাওয়ার নেবে। হয়তো জলের নিচে চোখের জল লুকাবে। তারপর হয়তো খাবে কিংবা খাবে না। বসে থাকবে বারান্দায়। তারপর একসময় শহরের সব বাতি নিভে গেলে দুর্বল রোগাটে হৃদয়টা নিয়ে আমার বুকে মাথা রাখবে। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকবে সকাল পর্যন্ত।
আমি বুকটাকে আরো নরম করে দেবার চেষ্টা করবো যাতে সে একটু আরাম পায়। তার একটু শান্তি হয়। ঘুম আসে। এ ছাড়া একটা অক্ষম বালিশের আর কিইবা করার আছে।