আনন্দহীনতা আমার ঘাড়ে চেপে বসলেই আমি কল্পনার আশ্রয় নিই। পৃথিবীকে ছেড়ে দিই পৃথিবীর হাতে। দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহনহীন একান্ত নিজস্ব কিছু সময় কাটাই। একেবারে ভিন্ন হয়ে যাই। হারিয়ে যাই। তলিয়ে যাই। উড়ে যাই পৃথিবী ছেড়ে। আমি তখন অন্য গ্রহের মানুষ।
তখন আমার চোখ দুটো আর পৃথিবীর মানুষের চোখ নয়। তখন আমি শিকারী ঈগল। ক্ষুধার্ত চোখে খুঁজে ফিরি শিকার। খুঁজে ফিরি জীবন। খুঁজে ফিরি মানুষ। উড়ে বেড়াই। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। শহর থেকে শহরান্তরে। দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রত্যেক কুটিরে, প্রাসাদে, অট্টালিকায় রাখি আমার বুভুক্ষু হৃদয়। অনুভব করি স্পন্দন। ব্যবচ্ছেদ করি অর্থহীনতা। বিক্ষুব্ধ অথবা উদ্বেলিত চিত্তে আমার অতলতায় যোগ করি নতুন অভিজ্ঞতা।
কল্পনায় আমার তখন শারীরিক কোনো বয়স নেই। আমি তখন প্রবীণ জ্ঞানবৃদ্ধ অথবা সদ্যজাত জ্ঞানহীন এক শিশু।
কল্পনা আমাকে আমার আনন্দহীন সময়ে বাঁচতে শেখায়। একাকীত্বের অবসাদগ্রস্থতা থেকে আমাকে দেয় মুক্তি। তারপর আমার চিত্তকে অধিকার করে নিয়ে, আমাকে এমন একটি বিচিত্র অনুভব ও সংবদ্ধতা দান করে যে ভূতগ্রস্থ বর্তমান, বিষণ্ণ অতীত, সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত, পরিবেশ, প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি; এমনকি ধর্ম আর রাজনীতির মতো বিদঘুটে কিংবা সংঘাতময় ব্যাপারগুলোও আমার কাছে ভীষণ উপভোগ্য আর আনন্দময় বলে মনে হয়। কল্পনায় এমনই অপার আনন্দ। এমনই বিস্ময় বিনোদন।
এই যেমন আমি এখন কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের প্রান্তে একটি মৃতপ্রায় প্রাচীন অজানা গাছের নিচে বসে থাকা এক বিস্ময় বালককে। যার মুঠোতে বন্দী একরাশ অদ্ভুত কবিতা; যে এইমাত্র কবিতাগুলোকে হাত থেকে নামিয়ে দিলো মাটিতে। তারপর তার নোংরা পায়ে কবিতাগুলোর উপর উঠে দাঁড়িয়ে থেতলে দিলো। একদম সদ্যজাত সম্ভাবনাময় কবিতাগুলো মুহূর্তেই পরিণত হলো একেকটি অজ্ঞাত লাশে। আর ছেলেটি চিৎকার করে একটানা বলতে থাকলো, এই আধুনিক পৃথিবীতে বিষণ্ণ কবিতার কোনো সম্ভাবনা নেই; নোংরা আর আর যন্ত্রণাময় মৃত্যুই তাদের শেষ পরিণতি। অথচ ছেলেটা একবারও ভেবে দেখলো না যে, এই কবিতাগুলো পড়ে আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক পরে, কোনো এক অতৃপ্ত যুবকের মনে গভীর কোনো ভাবনার উদয় হলেও তো হতে পারতো; যা তার পরবর্তী জীবনকে একটি সুস্থ, স্বাভাবিক ও স্থির ধারাতে বয়ে নিয়ে যেতো।
আমার কল্পনার চোখে এইমাত্র একজন তরুণ দার্শনিকের আবয়ব ভেসে উঠলো। যার দর্শনকে অপ্রয়োজনীয় প্রগলভতা বলে কেবলই উড়িয়ে দিলেন এক প্রবীণ অধ্যাপক। কুঁকড়ে একেবারে মাটিতে মিশে গেলো স্বচিন্তায় দীক্ষিত একজন সম্ভাবনাময় তরুণ দার্শনিক। যার দেওয়া প্রস্তাবনাটি নিয়ে আর বার কয়েক চিন্তা করলেই হয়তো এতোদিনের অস্তিত্ববাদী ভাবনার আমূল পরিবর্তন ঘটে যেতে পারতো। পুরো পৃথিবীর মানুষ হয়তো নতুন করে ব্যক্তি ও চিন্তার মধ্যকার একটি সমন্বয় সূত্র পেয়ে যেতো। খুঁজে পেতো সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যকার সংযোগ সেতুর প্রারম্ভিক সোপান।
কিন্তু আমার ভারাক্রান্ত চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছে, অধ্যাপকের নাতিশীতোষ্ণ কক্ষ থেকে বের হয়ে, নিজের চিন্তার অসারতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছেলেটি তার এতোদিনের যাবতীয় জ্ঞানের সুসংবদ্ধ লিখিত রুপটি নিক্ষেপ করলো একটি ডাস্টবিনের দূর্গন্ধময়তায়, যেখানে পড়ে আছে কোনো দম্পতির গতরাতের যৌনসংগমে ব্যবহৃত আপাতদৃষ্টিতে আপত্তিকর আর প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন কিছু উপকরণ।
আমি স্থির চোখে দেখতে পাচ্ছি, নির্জন বনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দুটি অচঞ্চল শিশু হরিণ, যাদের দিকে তাক করা আছে দু’জন শিকারীর নির্ভুল নিশানা। এই সুন্দরী, গরান, গেওয়ার আর গোলপাতার বনে নিষ্পাপ হরিণ শাবক দুটি জানেনা তাদের জীবন কি ভয়াবহভাবে আর কিছু মুহুর্ত ব্যবধানে একেবারে ক্রান্তি লাভ করবে। তারা বঞ্চিত হবে পরিণত বয়সের প্রণয় ও সঙ্গমসুখ থেকে এবং পরিণত হবে জগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও একই সাথে নির্বোধ সম্প্রদয়ের দুজন প্রতিনিধির আহার-উৎসবের উন্মত্ততার কেন্দ্রবিন্দুতে। শিকারী দুজনও জানে না, যদি হরিণ শাবকদুটি বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়তো আজ সন্ধ্যায় ক্রোশখানেক দূরে একটি ক্ষুধার্ত বাঘের অসময়ে মৃত্যু হতো না।
চাইলেই এখন ধরে নিতে পারি আমার চোখের সামনে চলে এসেছেন মৃত্যুদূত। আমার দিকে হা করে চেয়ে আছেন। আমার কপালে জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলোর তৃপ্তিচিহ্ন আর মলিন দিনগুলোর কদর্য রেখার অনুপাতে গড়মিল দেখে তিনি অবাক হয়ে যাচ্ছেন। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন যে, তিনি আমাকে এখনি নিয়ে যাবেন নাকি আরো কিছুদিন সময় দেবেন। যাতে করে আমি আরো কতগুলো মূল্যহীন ছাপ রেখে যেতে পারি দুঃখময় পৃথিবীতে।
অথচ আমি চাইছি এই মুহূর্তে আমার সকল কিছুর অবসান হোক। বহুদিন থেকেই আমার মনে হচ্ছে জীবন অর্থহীন। এর কোনো মানে নেই। এই রকম অতিপুরাতন অথচ বিস্ময়করভাবে রহস্যাবৃত চিন্তায় আমার এতোদিনের প্রচলিত সুতোয় টান পড়েছে। আমি আর নিতে পারছি না। ও মা, একি মৃত্যুদূত যে চলে যাচ্ছেন। আমিই কি এমনটা চাইছি? বেঁচে থাকবার বড়ো লোভ মানুষের। যদিও সে জানে, সচেতনভাবে বেঁচে থাকাটা ভীষণরকম কষ্টের।
কল্পনার দড়ি আমি ঝুলিয়ে দিয়েছি, আমার বাড়ির জামরুল গাছের নিচের প্রাচীন কুয়োটার পরিত্যক্ত জলে বেড়ে ওঠা একটা সোনালি ব্যাঙের স্যাঁতস্যাঁতে শরীরের ছোপ ছোপ চামড়ায়। যার সারাটা জীবন পার হয়ে যাবে তবু জানবে না কুয়োটার বাইরেও আলোয় উজ্জ্বল একটি জগত আছে। যেখানে মানুষেরা নানারকম প্রতিযোগিতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শিল্প, ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি, ভূগোল, অর্থনীতি ইত্যাদি নানাদিক নিয়ে মেতে থেকে জীবনকে অহেতুক অর্থপূর্ণ করে তোলার ব্যর্থ প্রয়াসে ব্যস্ত। যদিও ঈশ্বরের কাছে তাদের এই বৈচিত্র্যময় জগতটা একটা অন্ধকার কুয়ো ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা জগতের সুখে কিংবা দুঃখে ঈশ্বর বরাবরের মতো আজও নির্বিকার।
আমার অপ্রকৃতস্থ অসুন্দর অনুজ্জ্বল অপ্রচলিত আর ভীষণভাবে অপ্রয়োজনীয় এমন কল্পনার গাড়ি নিয়ে আমি অস্পষ্ট ছাপ রেখে গেলাম জীবনের জটিল বিবর্ণ পথে। কেউ কেউ আমাকে একটা বিশেষ উপাধিতে ভূষিত করলেন যা ছিলো চিরঅপ্রত্যাশিত। কেউ বা আমাকে বিকারগ্রস্থ ভাবলেন। কেউবা ভ্রু কুঁচকে খানিকটা মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে কি যেন বললেন ঠিক বোঝা গেল না।
সবশেষে কল্পনায় আমি নিজেকে দেখলা। উপর থেকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আমি হাসছি আর বলছি, বিপরীত দর্শন অথবা অপ্রচলিত ভাবনার অভাব যেদিন পৃথিবীতে ঘটবে। সেদিন সকল সভ্যতা ডুবে যাবে সাগরের ফুলে ওঠা জলে। আর মৃত্যুর আগে পৃথিবীর শেষ মানুষটিও, না বুঝে বলে ফেলবেন - এটা গ্রীণ হাউজ এফেক্ট ছাড়া আর কিছু নয়।
আহ, কল্পনার কি অদ্ভুত আনন্দ। যা খুশি তাই ভাবতে পারি আমি। আমার ইচ্ছার স্বাধীনতায় কোনো নিরানন্দময় দর্শন, আবদ্ধ ধর্ম অথবা সংঘাতময় রাজনীতি বাঁধ সাধে না।
কল্পনার আমি সবসময়ই মুক্ত। ডানা মেলা প্রজাপতির মতো স্বচ্ছন্দ স্বাধীন আমার এলেবেলে ভাবনাগুলো।
(০১/০৭/২০১৪)