সেদিন আসন্ন সন্ধ্যার বিদঘুটে ম্লান অন্ধকারে শূন্য উঠোন পেরিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই, দেখি আমার মাটির বারান্দায় একটা বাঁশের খুঁটির গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে একজন মানুষ; যার বয়স গিয়ে ঠেকেছে জীবনের আঁকাবাঁকা সরুপথের একেবারে প্রান্তসীমায়। আমার অনভ্যস্ত চোখ অপ্রত্যাশিত আগন্তক আবয়ব দেখে কিঞ্চিত অপ্রতিভ হয়ে গেল। সারাদিনের কর্মক্লান্তি পায়ের তলায় শক্ত করে চেপে ধরে আমি থমকে দাঁড়ালাম, এলোমেলো অন্ধকারে জাজ্বল্যমান দুটি অশ্রুভেজা চোখের স্থির শান্ত অচঞ্চল ঘোলা চাহনির সম্পূর্ণ বিপরীতে। লোকটির জটবাঁধা দীর্ঘ চুল, চামড়ার কোঁচকানো ভাঁজ, আর শরীরের রুগ্নতা আমার মনের মধ্যে যে একটা অনুরণন ঘটিয়ে দিলো, তাতে করে আমার বিপর্যস্ত মস্তিস্ক মুহুর্তেই লোকটির যায়গায় নিজেকে বসিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্যপটে চলে গেল।
যে প্রাণবন্ত চোখ দুটি আমার ম্লান চোখের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে তাকেও একদিন আমারই মতো জীবনের অলিগলি ঘুরে শেষমেষ এই মাটির উপরে স্ত্রী-সন্তান-পরিবার হারিয়ে, জীর্ণ বস্ত্রে, জমাট চুলে, রুগ্ন শরীরে একেবারে একা হয়ে যেতে হবে; যদি সে আমারই মতো দীর্ঘ জীবন পায়। দীর্ঘ জীবন লাভের এই অনিবার্য ক্ষতির কথা ভেবেই কি বৃদ্ধের ছানিপড়া চোখ ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসছে নোনাজলে?
আমার বাড়ির টালিতে ছাওয়া চালের ওপরে যে বড়ো চালকুমড়াটা গাছের পুষ্টি শোষণ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনে দিনে, এই আবছা অন্ধকারেও যেটা তার সাদা অস্তিত্ব নিয়ে আমার চোখের সামনে প্রতিভাত, যেটা কেটে ফেললে গাছটার কিছুই হবে না বরং কেটে ফেলাটাই ওটার নিয়তি; পৃথিবীর সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারটাও ঠিক তেমনই বলে মনে হলো হঠাৎ। বয়স্ক মানুষ দেখলে আমার ভেতরের সরল চিন্তার জাল একেবারে ওলোট পালোট হয়ে পাঁকিয়ে যায়।
দীর্ঘজীবন লাভকারী কোনো মানুষ দৃষ্টিগোচর হলে আমার ধমনী ও শিরার ভেতরে প্রবাহিত রক্তের চঞ্চল স্রোত আকস্মাৎ ভয়ে একেবারে সংকুচিত ও স্থির হয়ে আমাকে এমন একটি অনুভূতি দান করে যে, আমি অহেতুক প্রলম্বিত জীবনের প্রতি ভীষণ করুণাবোধ করতে শুরু করি।
তবু আকাশে শেষরাত্রির জ্যোৎস্নার আলো আমার গৃহিনীর কমনীয় মুখের উপরে একটি রূপালী আবহ তৈরি করলে, আমি সেটুকু ঠোঁটে শুষে নিয়ে যখন দীর্ঘ জীবন প্রত্যাশা করি, তখন আমার কামনার পশ্চাতে কোনো বৃদ্ধের ঘোলাটে চোখ বাঁধ সাধে না। কী আশ্চর্য মানুষ আমি !
(২৯/০৬/২০১৪)