আর কিছুই ভালো লাগছে না – এরকম মনের অবস্থা নিয়ে জানালার বাইরের পৃথিবীতে ডুবিয়ে দিলাম চোখ।
একসময় এই জানালার বাইরের জগতে বৈচিত্র্য ছিলো। ক্লান্ত দুপুরে চোখ দুটো জানালায় গলিয়ে দিলে দেখা যেত, বরই পাতার ফাঁকে বুলবুলি নয়তো চড়ুই তাদের ক্ষুদ্র জীবনের নিরর্থক সময়টুকু আমার ক্ষুধার্ত চোখে ঢেলে দিয়ে তৃপ্ত হচ্ছে। আকাশে তখন ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘেদের বন্ধুতা। কবিরা যাকে বলে ‘মেঘের ভেলা’- অনেকটা সেরকম। আর ঐ যে দূরে যেখানে এখন কোনো সৌন্দর্য নেই, স্বপ্ন নেই, নেই কোনো নতুন প্রত্যাশা - সেইখানে ছিলো এক রূপবতী নদী। নীল শাড়িতে ছোপ ছোপ পাখিদের ছাপ ছিলো। শরীরে তার যৌবন ছিলো। এখনকার মতো অস্ত্বিত্বহীন সে কখনো ছিলো না। নদীর পাড় বেয়ে জন্মেছিলো কাশবন। যৌবনের প্রান্তসীমায় সেটে দেওয়া আনন্দের পতাকা দুলে উঠতো মৃদুমন্দ বাতাসে। উপরে ছেঁড়া মেঘের ভেলা প্রতিফলিত হতো নদীর স্বচ্ছ-সরস জলে। আর পাশে দাঁড়িয়ে কাশবন মাথা নাড়তো অবিরাম। রাজহাঁস ভেসে চলে যেত পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ আলোর স্রোতে। উফ, আমার শরীরে কী যে শিহরণ বয়ে যেত সেসময়!
আচ্ছা, তখন কি শরৎকাল ছিলো?
জানি না, শুধু এইটুকু জানি - তখন শান্তির কাল ছিলো। নরম রোদ এসে ভিজিয়ে দিত মনের উঠোন। ক্লান্তিহীন নিশ্চুপ পৃথিবীর একান্ত আকাশে ডানা বিস্তার করে ভেসে যেত চিল। জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল। আর আমি একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে আবৃত্তি করতাম,
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দূপুরে
তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।
শেষের দিকে আমার গলা ধরে আসতো। উচ্চারণ অস্পষ্ট হয়ে যেতো। ঠিক কান্না পাওয়ার আগে মানুষের যেমনটা হয় তেমন। কেমন একটা বেদনা ঘিরে ধরতো আমাকে। মনে হতো, উফ, ঐ চিলটার মতো আমিও কী ভীষণ একা। আচ্ছা, এমন হতো কেন আমার?
তুমি তো বরাবরই এরকম। সঠিক পুরুষের মতো তো তুমি নও। জীবনের অর্থহীনতা নিয়ে কি কেউ ভাবে? তুমি আসলেই একটা পাগল? কিছুই মেনে নিতে পারো না সহজভাবে। তোমার মধ্যে তাই দ্বিধার সমুদ্র। তুমি সর্বাঙ্গীন গতিহীন এক পুরুষ। ভেতরে প্রাণ আছে কিনা বোঝা যায় না। তুমি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাচ্ছো দিনদিন।
জানো, ইদানিং কেমন অপাংক্তেয় মনে হয় নিজেকে। মনে হয় ময়লার স্তুপে ফেলে দেওয়া উচ্ছিট্টে গজিয়ে ওঠা অপ্রয়োজনীয় ছত্রাক আমি। অথবা ছ্যাদলায় ক্ষয়ে যাওয়া ইটের ফাঁকে ফার্ণের কুণ্ডলিত পাতার মতো পাঁকিয়ে যাচ্ছি ভেতরের দিকে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি বিবর্ণ ঘাস। আমাকে মাড়িয়ে যাচ্ছে সবাই অথচ আমার বেদনা কেউ বুঝতে পারছে না। আগেও তো এমন হতো। কিন্তু কি জানো? আগে একটা শান্তি হতো। বেদনায় ভর করে দূর থেকে ধেয়ে আসা শান্তি। একটা জামরুলের ডালে দোয়েলের ডানা ঝাপটানোর মত অদ্ভুত শান্তি। অথবা ঝরা বকুলের গন্ধে ভেজা শীতের সকালের মতো কিংবা ধরো, প্রেমিকার ঠোঁটের মতো, গালের মতো কিংবা তার শাড়ির আঁচলের আলতো হাওয়ার মতো শান্তি। একটা অসমাপ্ত চুম্বনের মতো একেবারে নতুন আনকোরা টাটকা বিশুদ্ধ শান্তি। এখন জানালার ওপারে আর কোনো শান্তি নেই। আসলে কিছুই নেই। শুধু ভেতরের দীর্ঘশ্বাসগুলো অহেতুক বাড়ি খায় নাগরিক দেয়ালে। কেমন যেন বদলে গেছে সব।
বড্ডো বেশি ভাবো তুমি। আচ্ছা তোমার এই দুঃখবিলাসের কোনো মানে আছে? পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারো না তুমি, যেমন বদলে যাচ্ছে আশপাশের মানুষগুলো?
আমি যে গিরগিটি নই। কেমন করে রঙ বদলাবো? আমার ভেতরে যে স্থায়ী সত্যের শিলাস্তুপ। মিথ্যে দিয়ে তাকে তো আড়াল করতে পারি না। কোনো মুখোশ নেই আমার। কোনো রঙিন আঁকিবুঁকি নেই। তাই বৈচিত্র্যও নেই। তবে আমি নিষ্প্রাণ নই। বিশ্বাস করো, আমার ভেতরে প্রাণ আছে। এই দেখো, হাত রাখো বুকে। এখনো ধুক ধুক করছে। জানালার বাইরে যদি কারো দেখা পাই। আমি বেঁচে যাবো। উফ, আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে। কেন যে আমার চোখে সফলতার নাগরিক দেয়াল টানিয়ে দিচ্ছো প্রতিদিন? আমাকে কি বাঁচতে দেবে না? আমাকে কি নিঃশ্বাস নিতে দেবে না?
তুমি আস্তো পাগল একটা... তোমাকে সত্যিই এ সময়ে চলে না।
তবুও যে আমি বাঁচতে চাই। আমার জন্য জানালার বাইরের পৃথিবীতে নারকেল গাছের নিচে কিছুটা জায়গা রেখো। সেখানে আমি আদিম আনারসের ঘ্রাণ নিতে আসবো। আমার জন্য একটু সজীব সবজির ক্ষেত তৈরি করে রেখো। লাল অথবা পালঙের ক্ষেতে আমার জন্য একটু মুক্ত বাতাস রেখো। একটা দোয়েলকে বাঁচিয়ে রেখো। কিংবা একটা হলদে পাখির থেকে খানিকটা হলুদ ধরে রেখো খেজুর গাছের ভাঁড়ের ওপর। আমি আর এই ঘরে থাকবো না। বিশ্বাস করো আমি আসবো। এই জনালার এপাশে সুশোভিত অথচ পরাধীন সাফল্যমণ্ডিত ঘরে আমার আর ভালো লাগে না। আমার চোখ প্রতিনিয়ত নাগরিক দেয়ালে বাড়ি খেয়ে থেঁতলে যায়। আমি আর পারছি না। আমার জন্য কিছু শিউলি ফুল আর একটা হলুদ গাঁদা কিংবা একটা বেলী ফুলের মালা... না থাক। আর কিছু চাই না শুধু একটুখানি প্রেম আর মমতা রেখো বুকের ভেতরে। আমাকে এই নাগরিক দেয়াল ভেঙে বাইরে আসতেই হবে। আমাকে একটু করুণা করো। তোমার মনের পাথর ভেঙে সেখানে লাল গোলাপের চাষ করো। আমাকে বাঁচাতে শুধু এইটুকু করো। একটি গোলাপ হাতে শুধু একবার 'ভালোবাসি' বলো। তাতেই অনেক হবে।