১
ইচ্ছে ছিলো, নদীর বুকে ডুবসাঁতার...
বলা যায়, গ্রামের পাশে একটি নদী ছিলো। অথবা নদীর পাশেই ছিলো গ্রামটা। বলা যায়, নদীর পাড়ে টালিতে ছাওয়া কয়েকটা গরিবিপনা ঘর ছিলো। সেখানে মানব শিশুর জন্ম হতো। ছোট ছোট। লেঙ্গট পরা অথবা উলঙ্গ। খালি পা। ধুলো-কাদা মাখা শরীর। রৌদ্রে পুড়ে তামাটে। দিন আসে রাত যায়। শরীর পাল্টায়। হামাগুড়ি। হাঁটি হাঁটি পা পা। একটু একটু করে সময় গড়ায়। অর্থহীন চিৎকার পরিণত হয় অর্থপূর্ণ শব্দে, বাক্যে। শৈশব ডাক দিয়ে যায়। মানুষের শিশু সে ডাকে সাড়া দেয়। গ্রামের পাশে একটি নদী। অথবা নদীর পাশেই ছিলো গ্রামটা। নদীর কোল ঘেঁষে একটা ধুলোমাখা পথ। খানিকটা উঁচু।
ধরা যাক, সেই পথে একসারি মানুষের শিশু। হাতে সাইকেলের পুরনো টায়ার। ছোট একটা লাঠি। টায়ারে আঘাত পড়ে। ছায়াগুলো এগিয়ে চলে। বাঁধ ভাঙ্গা হাসি। কালো কালো অথবা রোদ-জ্বলা তামাটে মুখে উজ্জ্বল সাদা হাসি। কিংবা মোটাপেট শিশুটার হলদেটে খানিকটা ম্রিয়মাণ হাসি। অথবা একটু পিছিয়ে পড়েছে মানব কঙ্কালের মতো শিশু। ভ্রু কুঁচকে থাকা একটা পরাজিত পরাজিত হাসি। একদল মানুষের শিশু। সাইকেলের পুরনো টায়ার অথবা ফেলে দেওয়া অকেজো রিং। একটা অদ্ভুত আনন্দ।
পুরনো টালি, ভাঙ্গা-মালসা অথবা মাটির সরা’র একটা টুকরো। কাঁচের কিংবা কড়ির গুটি(মার্বেল)। সুন্দরী কিংবা গেওয়ার লাটিম। জিউলির ডাল ভাঙা, ডান-গুলি। কিছু খালি গাঁ। ময়লা হাফপ্যান্ট। মাথার তালুতে সেটে রাখা তেলে ছোঁয়া চুল। দুপুর রোদ। প্লেটের গরম ভাত থেকে আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে একরাশ ধোঁয়া। এক থাবা লালশাক, এক টুকরো ভেটকি অথবা শোল, একটু ঝোল, দুটো কাঁচা মরিচ। কোনদিন বা শুধু ডাল-ভাত।
ধান কাঁটা হয়ে গেলে বিলের মধ্যে সাপঘুড়ি, বেতঘুড়ি কিংবা চড়কি। কতগুলো মানুষের শিশু। নির্ভার কৈশোর। মাটি-কাদা-জল। গুলতি হাতে একছুট। গাছে বসে আছে হলদে পাখি কিংবা টিয়ে। ঝোপের মধ্যে এইমাত্র আড়াল হলো একটা টুনটুনি। খালের পাশ দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে, বসে আছে মাছরাঙা। বসে আছে ধবধবে সাদা বক।
চোখ বুজলে এখনো দেখা যায়, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। নদীতে টলমল জল। জলের ভিতরে মানুষের কতগুলো শিশু। ডুবসাঁতার। অকারণে হাসে। চিৎকার। আনন্দ। উল্লাস। ছোট ছোট লেঙ্গট পরা অথবা উলঙ্গ। নদীর পাড়ে টালিতে ছাওয়া কয়েকটা গরিবিপনা ঘর।
২
ছেলে আর মেয়েটা রোজ গাড়িতে করে স্কুলে যায়। আমিই নামিয়ে দিয়ে আসি। বইয়ের বোঝা নিয়ে বাড়ি ফেরে পড়ন্ত বিকেলে। বাইরে বেরুতে ওদের ইচ্ছে নেই। হাই-রেজুলেশন গেমস। গ্রান্ড থেফট অটো, কল অফ ডিউটি, ফার ক্রাই, হিরোজ অব ওয়ারক্রাফট। এক্সাইটমেন্ট, সাসপেন্স, থ্রিলার। বুদ হয়ে থাকে কম্পিউটার স্ক্রিনে। মেতে থাকে মুঠোফোনে। শৈশব, কৈশর, যৌবন। বলে, পৃথিবীটা এখন হাতের মুঠোয়। এটা গ্লোবালাইজেশনের যুগ। সমগ্র পৃথিবীটা একটা গ্রাম। গ্লোবাল ভিলেজ। সব দূরত্ব ঘুঁচে গেছে।
৩
-বাবা, তুমি ওই কাদামাখা নোংরা ছেলেগুলোর উলঙ্গ ছবি ড্রয়িং রুম থেকে কি সরাবে না? কেমন বিশ্রী দেখায়!
বর্ষার ভরা পুকুরের মতো ভরে ওঠে আমার চোখ। এই ছবিটা আমি কি কোনদিন সরাব না?
ইচ্ছে ছিলো, নদীর বুকে ডুবসাঁতার... এখন সেটা দূর্লভ স্বপ্ন।