'' সেই মেয়েটি এর চেয়ে নিকটতর হ'ল না
কারণ আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয় "
কোন মেয়েটি এর চেয়ে নিকটতর হলো না?... আমাদের জীবন পাখিদের জীবনের মতো হলেই বা কি হতো? মেয়েটি কি আরো নিকটতর হতো?
যখনই জীবনান্দ দাশ নিয়ে ভাবি, এক অদ্ভুত নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা এসে ভর করে শরীর ও মনে। জীবনানন্দ দাশ নিয়ে, মানে তার কবিতা নিয়ে যতবারই ভাবতে বসবেন ততোবারই শিহরিত হবেন। আপ্লুত হবেন। আবেগতাড়িত হবেন। এবং উপলব্ধি করবেন সত্যিই তো এর চেয়ে সত্য বুঝি আর নেই। বলছিলাম তার অগ্রন্থিত একটি কবিতার কথা। কবিতার নাম 'হাজার বর্ষ আগে'। আসুন দেখি কি বলছেন কবি এখানে...
সেই মেয়েটি এর থেকে নিকটতর হ'লো নাঃ
কেবল সে দূরের থেকে আমার দিকে একবার তাকালো
অর্থাৎ যে মেয়েটি দূরের থেকে কবির দিকে একবার তাকালো, সেই মেয়েটি 'এই তাকানো দূরত্বটুকু' অতিক্রম করে এর চেয়ে নিকটতর হলো না। হতে পারলো না। কিন্তু একবার তাকিয়ে কি এমন বোঝা যায়? কবিই বা এই এক দর্শনে কি এমন বুঝলেন?
আমি বুঝলাম
চকিত হয়ে মাথা নোয়ালো সে
কিন্তু তবুও তার তাকাবার প্রয়োজন__ সপ্রতিভ হয়ে
একবার তাকিয়েই মাথা নামিয়ে নিলো সে। আর কবি বুঝলেন 'তবুও তার তাকাবার প্রয়োজন__সপ্রতিভ হয়ে'। অর্থাৎ শুধু এই একবার আকস্মিক লজ্জাবনত দৃষ্টি বিনিময় কিছু নয়, এতে কিছুই বোঝা যায় না বরং সকল জড়তার উর্ধে উঠে সাবলীল ও অসংকুচিত হয়ে, সপ্রতিভ হয়ে কবির দিকে মেয়েটির তাকাবার প্রয়োজন।
সাত-দিন আট-দিন ন-দিন দশ-দিন
সপ্রতিভ হয়ে__ সপ্রতিভ হয়ে
সমস্ত চোখ দিয়ে আমাকে নির্দিষ্ট করে
অপেক্ষা করে__অপেক্ষা ক'রে
অপেক্ষা করে , সময় নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে কবিকে দেখবার প্রয়োজন। অর্থাৎ কবি চাইছেন মেয়েটির দৃষ্টি যা কবিকে মুহুর্তেই এক অতল ভাবনার সাগরে নিমজ্জিত করেছে। তাকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু তা তো হলো না। মেয়েটি তার লজ্জাবনত দৃষ্টি একবার কবির দিকে নিক্ষেপ করেই মাথা নোয়ালো। সে এর চেয়ে আর নিকটতর হলো না। কিন্তু কেন?
সেই মেয়েটি এর চেয়ে নিকটতর হ'ল না
কারণ,আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয়
কারণ আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয়। আমাদের জীবন যদি পাখিদের মতো হতো তাহলে কি হতো? পাখিদের মতো জীবন হলে কি হয় ? সেই জীবন নিয়ে কি করতেন কবি? এসব প্রশ্ন মনকে ছেয়ে ফেলে, আমরা ভাবনাতাড়িত হই কবির মতোই। আহা, যদি পাখিদের মতো জীবন হ'তো !
যদি হ'ত
সেই মাঘের নীল আকাশে
(আমি তাকে নিয়ে) একবার ধবলাটের সমুদ্রের দিকে চলতাম
গাঙশালিখের মতো আমরা দু'টিতে
এই হলো কবির চাওয়া। তিনি বেশি কিছু চান না। তিনি শুধু গাঙশালিখের মতো ধবলাটের সমুদ্রের দিকে সেই মেয়েটিকে নিয়ে উড়ে যেতে চান। তিনি গাঙশালিখের মতো স্বাধীন জীবন চান। উন্মুক্ত বাতাস আর সমুদ্রের বিশালতায় তার 'সেই মেয়েটি'কে নিয়ে উন্মুক্ত হতে চান। এবং যদিও মেয়েটি একবারই মাত্র কবির চোখে চোখ রেখেছে তবুও তিনি জানেন সেই মেয়েটিও এটাই চাইছে...অপেক্ষা করছে...
আমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি
তুমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছো
এবং এই অপেক্ষার শেষ কখন হবে তা কবি সঠিকভাবে জানেন না। তবে অপেক্ষার হয়তো শেষ হবে , হয়তো হাজার হাজার বছর পরে। তখন তার এই ইচ্ছা পূরন হবে আর তিনি মাঘের নীল আকাশে সমুদ্রের দিকে সেই মেয়েটিকে নিয়ে উড়ে যাবেন। তখন তাদের মনে হবে হাজার হাজার বছর আগে তারা তো এমনটিই চেয়েছিলেন। এমনিভাবেই মাঘের নীল আকাশে সমুদ্রের দিকে ডানা মেলতে চেয়েছিলেন।
হয়তো হাজার হাজার বছর পরে
মাঘের নীল আকাশে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাবো
আমাদের মনে হবে
হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম।
এই শেষে এসেই কবিতাটি ভীষণভাবে ছুঁয়ে যায়। আমরা সবাই তো উড়ে যেতে চাই আমাদের প্রিয়জনকে সঙ্গী করে। যেখানে আমরা আরো একটু স্বাধীন হবো। আরো একটু আনন্দময় জীবন পাবো। আমরা কেউই তো জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত বাঁকে নিষ্ঠুরতম সংগ্রামের মুখোমুখি হয়ে নিশ্চল পড়ে থাকতে চাই না। আমরা তো গাঙশালিখের মতো স্বাধীন, স্বতঃস্ফুর্ত জীবন প্রত্যাশা করি। আর তাই যখনই জীবনানন্দ দাশ পড়বেন তখনই এক অদ্ভুত নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা এসে ভর করবে শরীর ও মনে। ভাববেন, সত্যিই তো আমরা তো এমনটিই চেয়েছিলাম।