সরকারি চাকুরি টা পাওয়া মাত্রই যেন তাহার মৃতপ্রায় যৌবনের নদে এক বিরাট বান আসিয়া কানায় কানায় পূর্ণ করিয়া গেল। কিন্তু আক্ষেপ সে নদীতে একটু ডুব সাঁতার খেলিবার মত কেউ তাহার নাই! উনত্রিশটা বছর কাটিয়া গেল এখনো কোন ললনার হাতটা টিপিয়া নাড়ীর স্পন্দন মাপা হইলো না, নির্জন দুপুরে রেস্তোরাঁর কোনার দিকটায় বসিয়া কাহারও লিপিস্টিকের কোম্পানিটা অনুসন্ধান করিবার ভাগ্যও তাহার হয়নি। অথচ সাথের যে বন্ধুগুলো সেই ছয় ক্লাশ পড়িবার সময় বিদ্যাদেবীর অনুগ্রহ বঞ্চিত হইয়া বই-খাতা ছুড়িয়া ফেলেছিল, আজ তাহারা দিব্যি বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করছে। আহা! তাহাদের মত একটি বার যদি সেই অমৃত চাখিয়া দেখিবার ভাগ্য অমূল্যকুমারের হইতো!!
তবে সে আক্ষেপ খুব একটা দীর্ঘয়িত হইলো না, তাহার সরকারি চাকুরির খবর আত্নীয়মহলে রটিতেই বিবাহের সম্বন্ধ আসিতে শুরু করিল। বনেদি বাড়ির ঘরোয়া মেয়ে থেকে শুরু করিয়া প্রগতিশীল চাকুরিজীবী মেয়ের সম্বন্ধ অব্দি আসিল। তবে তাদের ভেতর থেকে খুজিয়া বাছিয়া সবথেকে কচি মেয়েটাই তাহার মনে ধরিল। ছবি দেখিয়া মনে হইতেছে কন্যার বয়স টানিয়া হ্যাচরাইয়া আঠেরো পর্যন্ত অনায়াসে প্রচার করা যাইবে, আর অতটুকুন না করিলে আবার বাল্যবিবাহের খপ্পরে কষ্টের চাকুরীটা খোয়া যেতে পারে।
তবে কাল করিল বাড়ির আয়নাটা। গত কয়েক বছর ইহার ব্যাবহার বেমালুম ভুলেই বসে ছিল অমূল্য। আজ হটাৎ সেটার দিকে দৃষ্টি পরিতে দেখা গেল মাথার চুল খানিকটা লোপ পাইয়াছে সাথে পেট টাও সম্মুখ পানে বেশ খানিকটা প্রসারিত হয়েছে মালুম হয়। এমতাবস্থায় মেয়েটির পাশে নিজেকে একটু বয়ষ্ক মনে হবে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল সে।
তাহার এমন উদ্বেগ দেখিয়া বাড়ির দিদিমা শ্রেণীরা বলিতে শুরু করিল, এ আর এমন কি বয়স! তাহারা যখন পুতুল খেলিতে খেলিতে এ বাড়িতে এসেছিলেন তখন নাকি দাদুদের বয়সটা অমূল্যর থেকে ঢের বেশি ছিল। আর এই সরকারি চাকুরিটা জুটাইতে কি অমূল্য কম কসরত করিয়াছে? এখন পছন্দ করিয়া একটি বিবাহ করা তাহার নায্য হক বৈকি।
মেয়ে সবে মাধ্যমিক পাশ দিয়াছে, বেশ সুন্দরীও বটে,বনেদি পরিবার। কবে পাড়ার কোন্ বখাটে ছোকড়া মেয়েকে প্রেমের ফাদে ফুসলাইয়া বংশের নাম খারাপ করিয়া দেয়, তাহার পূর্বেই একটা ভাল সম্বন্ধ দেখিয়া কন্যাদান করা তাহারা উপযুক্ত বোধ করিলেন। আর তাহাদের অমন যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের ফলেই আজ অমূল্যর বিবাহভাগ্য সুপ্রসন্ন হইতে চলিতেছে।
দুই পরিবারে কথাবার্তা খানিকটা আগানোর পর অমূল্য কন্যার সহিত একবার একান্তে দেখা করিবার বায়না ধরিয়া বসিল। কিন্তু বনেদি ঘরের মেয়ে, বিবাহের পূর্বে পরপুরুষের সামনে যাওয়াটাই একপ্রকার অন্যায় তাও আবার একান্তে!! যতই তাহার সহিত বিবাহের কথা চলুক এখনো সে পরপুরুষই তো। এদিকে অমূল্যও খুঁটি গেড়ে বসিয়াছে, দেখা সে করিবেই।
অতঃপর ভাল পাত্র হাত ছাড়া হইবার ভয়ে শর্তসাপেক্ষে তাহারা মত্ দিলেন। বলা হইলো কন্যার সহিত শুধু তাহার শ্রদ্ধেয় কাকীমা থাকিবেন এবং তিনি এরূপ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করিবেন যেখান থেকে বর-কনের উপর নজর রাখিতে পারিবেন ঠিকই কিন্তু তাহাদের কথা শুনিতে পাইবেন না।
এই যা!! এখনো কন্যার নামটাই বলা হলো না যে!! তাহার নাম দুলি, পাঁচ বছর বয়সে মা কে হারিয়ে কাকীমা-র কাছেই বড় হইয়াছে। তবে কাকীমা শব্দটা শুনিতে অমূল্যর চোখের সামনে হটাৎ করেই পান চিবতে থাকা এক খিটখিটে বয়স্ক মহিলার প্রতিমূর্তি ভাসিয়া উঠিল, কেননা কাকা শ্বশুড়কে দেখিয়া বয়স পঞ্চাশের কম মনে হয়নি। ওদিকে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা শেষে পঞ্জিকা দেখিয়া মাসের শেষ বুধবার বর-কনের দেখা করিবার দিন ঠিক হইলো।
অতঃপর সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত আসিয়া গেল, আর টিকে থাকা মহামূল্যবান চুল গুলোতে কয়েক দফয়ায় চিরুনি করে, পেট টাকে জোড় করিয়া ভিতরে চাপিতে চাপিতে অমূল্য কনের বাড়িতে হাজির হইল। খানেক বাদে মাথায় কাপড় দিয়ে লাজুক কন্যার আগমন ঘটিল। প্রায় একযুগ পরে কোন নারীকে এত কাছ থেকে দেখিয়া মনে মনে বেশ স্মৃতিকাতর হইয়া পড়িল অমূল্য। গ্রামের কলেজে পড়িবার সময় অমূল্যর জীবনেও একটি বার প্রেম এসেছিল। তবে ভাগ্যের বিড়ম্বনায় প্রথম অভিসারেই মেয়ের বাপের কাছে ধরা পরে সে। অমনি মাস খানেকের মধ্যেই মেয়েটিকে শহুরে জামাই দেখে বিয়ে দিয়ে দেয় তার পরিবার। ঘটনাটা মনে পড়তেই একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে সে, every dog has its day আর দেখো আজ তাহারো দিন আসিয়াছে!! হেন নস্টালজিয়ায় খানিক আনমনে হওয়া মাত্রই তাহার এতক্ষন যাবৎ চেপে রাখা ভূড়িটা হটাৎই সামনে ঝুলিয়া পড়িল। তা দেখিয়া কনে মুচকি হাসিল।
যাহোক এতক্ষণে তাহার খেয়াল হইলো কন্যার সহিত তাহার যে বয়স্ক অভিভাবক থাকার কথা ছিল, তাহাকে তো আশপাশে দেখা যাইতেছে না। তবে খানিকটা দূরে লাল-পেড়ে সাদা শাড়ি পরিহিত একজন ভদ্রমহিলার অবয়ব দেখিতে পাইলো অমূল্য। কিন্তু তাহারা চেহারাটা পরিষ্কার বুঝিতে পারিল না সে। চুলের সাথে সাথে সাথে যে তাহার দৃষ্টিশক্তিও খানিক কমিয়াছে তা যেন কন্যাপক্ষ জানিতে না পারে সে জন্য চশমাটা বাড়িতেই ফেলিয়া এসেছে সে।
কিছুক্ষণ বাদে সেই ভদ্রমহিলা চা-জলখাবার দিতে আসিলেন। বয়স তাহার ত্রিশের কোঠায় কিন্তু তাহার ডাগরডাগর চোখের চাহনি আর সবে স্নান সেরে আসা ভেজা চুলের গন্ধ অমূল্যর মনোযোগ ছিনাইয়া নিল। আহা! বিধাতা বুঝি বড়ই বেহিসেবী মনে গড়েছেন এ রমনীকে, রূপ-মাধুর্যে কোথাও কোন কার্পণ্য তো করেন নি বলতে গেলে খানিকটা বাড়াবাড়ি করেছেন। দুলির রূপে যৌবনের যে চন্দ্রিমাকে অমূল্য কেবল ঊঁকি মারিতে দেখিয়াছিল, তা বুঝি পূর্নিমার ন্যায় এ রমনীর মাঝে আসিয়া পূর্ণতা পাইয়াছে। হবু গিন্নীর উপস্থিতিতে অন্য নারীকে নিয়ে এমন মনে হওয়া অন্যায়, তাই নিজেকে সংযত করিয়া চা খেতে খেতে দুলির সাথে হালকা আলাপ সারিয়া বাড়ির দিকে রওনা দিল সে।
রাস্তায় হাটিতে হাটিতে দুলির সাথে তাহার কথোপকথন গুলো স্মরণ করিল সে,
সেই ভেজা চুলের ভদ্রমহিলা-ই দুলির কাকিমা হন। বড্ড আদর করেন তিনি দুলিকে। তিনি নাকি তখন সবে বউ হয়ে এসেছিলেন ওবাড়িতে যখন দুলির মা মারা যায়। দুলির সাথে তাহার বয়সের তফাৎ বড়জোর দশ-বারো। গ্রামে মাধ্যমিক শেষ করিয়া কেবল কলেজে উঠেছিলেন, সেসময়ই কি এক কারনে তাহার বাবা তাহাকে জোড়পূর্বক বিবাহ দিয়ে দিয়েছিলেন । এদিকে দুলির মা মারা যাওয়াতে তার কাকাও একটু তাড়াহুড়ো করেই তাকে গ্রাম থেকে এ বাড়ির বউ করে আনেন। নিজের সবকিছু ছেড়ে আসা এই ভদ্রমহিলাও এবাড়িতে এসে সে বয়সেই মা হারা দুলিকে আপন করে নিয়েছিলেন।
কথাগুলো মনে করিতে গিয়ে অমূল্যর বুকটা হুহু করে উঠিল, অতঃপর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়া নাক দিয়া ধোঁয়া ছাড়িল।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০২০ সকাল ১১:৪৮