বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ জোন ইনডিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মনিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে সুনামি ফল্ট লাইনের ওপর দ্বিতীয় ফারাক্কা নামে পরিচিত টিপাইমুখ বাধ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে ইনডিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার। এর ফলে সুনামির চেয়েও ভয়াবহ পানির ঢলে বাংলাদেশের প্রায় ১২টি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে যাবে।
বাংলাদেশকে না জানিয়েই সুনামির মতো ভয়াবহ ভূমিকম্পের একই ফল্ট লাইনে গত শনিবার টিপাইমুখ বাধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে ইনডিয়ার বিদ্যুত্ ও শক্তিমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে এবং ভারি শিল্পমন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেব।
অভিন্ন বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাধটি নির্মাণের আগে প্রকল্পটির রিপোর্ট বাংলাদেশ সরকারকে জানানোর কথা আন্তর্জাতিক নদী আইনে উল্লেখ থাকলেও তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে ইনডিয়া। ইনডিয়ার সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি গত বছর ঢাকা সফরকালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত থাকায় না জানিয়ে টিপাইমুখ বাধ নির্মাণ করবে না ইনডিয়া; কিন্তু ইতিমধ্যে বাধ নির্মাণের জন্য ইনডিয়ান সরকার ছয়
হাজার কোটি রুপির বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সংরক্ষিত ভূমিকম্পপ্রবণ মানচিত্র অনুযায়ী, বিশ্বের বিপজ্জনক ভূমিকম্প ফল্ট লাইনটি ইনডিয়া, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ার সুনামি পর্যন্ত দীর্ঘ ও অ্যাকটিভ রয়েছে। এতে স্পষ্ট দেখা যায়, টিপাইমুখ বাধ নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থল ও সুনামির কেন্দ্রস্থল একই ফল্ট লাইনে অবস্থিত। তথ্য থেকে আরো জানা যায়, এ উপমহাদেশের বৃহত্ ১০টি ভূমিকম্পের মধ্যে শক্তিশালী তিনটি ভূমিকম্পই সংঘটিত হয়েছে টিপাইমুখ বাধ এলাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। রিখটার স্কেলে এসব ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল সাত দশমিক দুই থেকে আট দশমিক ছয় পর্যন্ত।
সম্প্রতি ইনডিয়ার মনিপুর রাজ্যের স্থানীয় একটি পত্রিকায় টিপাইমুখ বাধ ও ভূমিকম্প শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, টিপাইমুখ বাধ ঝুকিপূর্ণ ভূমিকম্পপ্রবণ জোনে নির্মিত হতে যাচ্ছে। এতে উল্লেখ করা হয়, টিপাইমুখ বাধটি অত্যন্ত অ্যাকটিভ তাইথু ভূমিকম্প ফল্ট লাইনের অক্ষরেখায় নির্মাণ করা হবে। এর আশপাশেও রয়েছে উচ্চ ভূমিকম্পপ্রবণ ফল্ট। গত দেড়শ্থ বছরে নির্মাণাধীন টিপাইমুখ বাধের ৭৫ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে রিখটার স্কেলের ছয় থেকে সাত মাত্রার ভূমিকম্প অনেকবার হয়েছে। আরো আশঙ্কার কথা, এসব ভূমিকম্পের উত্পত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের নিচ থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে, যা সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক হয়ে থাকে।
টিপাইমুখ বাধ বিরোধী সংগঠনগুলোর আন্দোলনের মুখে সম্প্রতি মনিপুর রাজ্যের এক মন্ত্রী মি. হাইকো সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, টিপাইমুখ বাধ নির্মিত হলে মনিপুরবাসী বিনামূল্যে বিদ্যুত্ পাবে। ভূমিকম্পে বাধ ভেঙে গেলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মনিপুর নয়।
এছাড়া নদীতে বড় ধরনের বাধ তৈরির ফলে উজানে যে বিশাল গভীর জলাধার সৃষ্টি হয় তার ফলে বাধসৃষ্ট ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব বাধের উচ্চতা ১০০ মিটার বা তার বেশি এবং বাধে জলাশয়ের আয়তন এক ঘনমিটারের বেশি হলে এ ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে; কিন্তু টিপাইমুখ বাধের উচ্চতা হবে ১৬২ দশমিক ৮ মিটার।
বাধসৃষ্ট এ ভূমিকম্পের বিষয়টি বিশেষজ্ঞরা প্রথম নিশ্চিত হন ১৯৩১ সালে গৃসের ম্যারাথন বাধটি নির্মাণ হওয়ার পর থেকে। ম্যারাথন বাধে ১৯২৯ সাল থেকে জলসঞ্চয় শুরু হয়ে ১৯৩১ সালে জলস্তর পূর্ণমাত্রায় পৌছানোর পর থেকেই ওই এলাকায় ভূমিকম্প চলতে থাকে। বাধের সঙ্গে ভূমিকম্পের এ সম্পর্কের একাধিক প্রমাণ তারা আবিষ্কার করেন। আমেরিকার ২২০ মিটার উচু হুভার বাধটি নির্মাণের কারণেও ওই এলাকায় ভূমিকম্পন হয়। হুভার বাধটি ১৯৩৫ সালে জলসঞ্চয় শুরু হয়ে ১৯৩৯ সালে পূর্ণমাত্রায় পৌছানোর পরপরই সেখানে পাচ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পন হয়। চায়নার সিনফেনকিয়াং ও রোডেশিয়ার কবিরা বাধের সৃষ্ট জলাধার পূর্ণ হওয়ার পর ১৯৬২ সালে একই রকম ভূমিকম্প হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শতাধিক বাধ এলাকায় এ জলাধারসৃষ্ট ভূমিকম্পন লক্ষ্য করা গেছে।
দুই শতক ধরে ইনডিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব ভূমিকম্প হয়েছে তার হিসাব করলে দেখা যায়, বাধসৃষ্ট জলাধার এলাকায় তুলনামূলক বেশি ভূমিকম্পন হয়েছে। ইনডিয়া বাধের জলাধারসৃষ্ট ভূমিকম্পের বিষয়টি প্রথম জানা যায় মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলায় কোয়না বাধের জলাশয় পূর্ণ হওয়ার পর। ১৯৬২ সালে ১০০ মিটার গভীর বাধটির জলাধারে পানি সঞ্চয়ের পর থেকে মাঝে মধ্যে মৃদু ভূকম্পন শুরু হতে থাকে এবং মেঘ গর্জনের মতো আওয়াজ শোনা যায়। এরপর ১৯৬৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ১ থেকে ১০ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর ঠিক তিন মাস পর ১০ ডিসেম্বর আরো প্রবল বেগে সাত মাত্রার ভূমিকম্পন হয় এবং বাধের আশপাশের এলাকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। এতে প্রায় ২০০ জনের জীবনহানি ঘটে এবং বাধের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা দেয়। এখনো মাঝে মধ্যে এ এলাকায় মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূকম্পন পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
কোয়নার পর মহারাষ্ট্রেরই ভাতসা এবং মুলা বাধ, গুজরাটের কাডানা ও উকাই বাধ, অন্ধ্রপ্রদেশের নাগারর্জুন সাগর ও শ্রীরাম সাগর, কেরালার ইডিকিসহ ইনডিয়ার প্রায় ১১টি বাধ এলাকায় জলাধারসৃষ্ট ভূকম্পন লক্ষ্য করা গেছে।
উল্লেখ্য, ইনডিয়া সরকার সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দুই শতাধিক বাধ নির্মাণ করে ৬৩,০০০ মেগাওয়াট পানি বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে চাচ্ছে। এর মধ্যে টিপাইমুখ বাধ দিয়ে ১,৫০০ মেগাওয়াট পানি বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হবে বলে প্রকল্প রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আফতাব আলম খান জানান, জলাধারসৃষ্ট ভূমিকম্প সাধারণত ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। ফলে টিপাইমুখ বাধ নির্মিত হলে ওই এলাকায় সক্রিয় ভূমিকম্প প্লেটকে আরো জাগিয়ে তুলবে। এতে ঘন ঘন ভূমিকম্পের সংখ্যাও বেড়ে যাবে। তিনি আরো জানান, হিমালয় পর্বতমালা এলাকায় প্রতিনিয়ত ভূমিকম্প ঘটছে এবং পাহাড়ের গা বেয়ে আসা ঝরনার পানি ছিটকে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ বুয়েটের প্রফেসর মেহেদী আনসারী জানান, ইনডিয়া ও বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। এ এলাকায় বড় রকমের কোনো ভূমিকম্প হলে ইনডিয়ার ভেতরে সহস্রাধিক উচু বাধের অধিকাংশই ভেঙে যেতে পারে। এসব বাধের ভাঙনের ফল হবে বাংলাদেশের জন্য আরো ভয়াবহ। কেননা ইনডিয়ার অধিকাংশ নদীর পানি প্রবাহিত হয় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। ফলে ভূমিকম্পে এসব বাধের ভাঙন বাংলাদেশের সবকিছু পানির তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে ফেলবে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের মহাপরিচালক আকরাম হোসেন বলেন, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং সংলগ্ন ইনডিয়ার ভেতরে অনেক ভূমিকম্পপ্রবণ ফল্ট রয়েছে। ইনডিয়া ওই এলাকায় টিপাইমুখ বাধ নির্মাণ করলে যে জলাধার সৃষ্টি হবে এতে যে কোনো সময় ভূমিকম্প ফল্টগুলো জেগে উঠে ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।
আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্পবিদ মজিদুল ইসলাম জানান, টিপাইমুখ বাধ এলাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বৃহত্ ভূমিকম্প ফল্ট ছাড়াও ছোটখাটো আরো শতাধিক ফল্ট রয়েছে। টিপাইমুখ বাধে সৃষ্ট জলাধারে আটকানো পানির চাপে এসব ফল্টও জেগে উঠতে পারে।
উল্লেখ্য, টিপাইমুখ বাধ নির্মাণের জন্য ইনডিয়ার পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র এখনো না মিললেও মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্রের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। গত ২ আগস্ট বাধ নির্মাণের উদ্যোগী সংস্থা নর্থ-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেড (নিপকো সে দেশের গোয়াহাটিতে নতুন আরেকটি অফিসের উদ্বোধন করেছে। এখানেই টিপাইমুখ বাধ নির্মাণে আগ্রহী দেশ-বিদেশের মোট ১৪টি কম্পানির জমা দেয়া টেন্ডার খোলা হয়।