আজ প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম দিনে হাতে ছাতা না থাকলে মেজাজ বিগড়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে নিজের উপর খুব বিরক্ত লাগে।
গাল পেড়ে উঠি মনে মনে
"হারামজাদা বৃষ্টি আসারো আর সময় পাইলিনা"।
গজগজ করতে করতে তাকাই চলায়মান গাড়িগুলোর দিকে।
অনেকক্ষন ধরে বসে আছি বাসের জন্য।
আসতে এখনো মিনিট বিশেক বাকি। কেমনটা লাগে বলো।
সারাদিন একটানা কাজ করি একটা ছোট্ট স্টোরে।
খুব কষ্ট করে চাকরিটা ম্যানেজ করে দিয়েছেন আমার এক পরিচিত বাঙালী ভাই।
এই সামারে নতুন একটা জব হন্নে হয়ে খুজছি, কিন্তু পোড়া কপাল শুধু ফরম জমা দেয়াটাই সায় হয়।
ভদ্রতার হাসি হেসে দোকান মালিক বলে "বি রিষষ পধষষ ুড়ঁ ষধঃবৎ".
আগে অপেক্ষায় থাকতাম, এই বুঝি ফোন আসলো। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। শালারা শুধু ভন করে।
ওদের ভং দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। নিজেও কি কম ভং করি। আগে প্রতি সপ্তাহে ফোন দিতাম দেশে।
জানান দিতাম, "মাগো খুব ভালো আছি। পড়াশোনা ঠিক মতো করছি।" এখন আর দেই না।
কি হবে দিয়ে..সেই এক দঙ্গল মিথ্যে কথার তুবড়ি ছোটাতে হবে। মায়ের সাথে মিথ্যে কথা বলতে ভালো লাগে না।
আমি তো ভালো নেই। টাকার চিন্তায় সারাক্ষন আতকে থাকি। কতো খরচপাতি।
মাসের শুরুতে বাড়ি ভাড়া, খাবার খরচ দিয়ে দিতে হয় মামুন ভাইকে। এই চাকরি দিয়ে কুলোচ্ছিল না আমার।
কি লজ্জাটাই না লাগছিলো গত মাসের ভাড়াটা দিতে পারিনি। ওনাদেরো তো টানাটানি চলে।
তারপরো কি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন হান্নান ভাই "আপাতত আমরাই চালিয়ে নেব। তুমি পরে আমাদের দিয়ে দিও।
আমি জন্ম থেকেই হাদা প্রকৃতির। কোনো কিছুই আমার দ্বারা হলো না। সামান্য একটা চাকরী খুজতে খুজতে পেরেশান হলাম।
তিথী আমাকে শুধু শুধু বুদ্ধু বলে ডাকতো না। তিথীর কথা মনে হতেই আমার মনটা কেমন উদাস হয়ে গেলো।
কেমন আছে সে.. ভালোই তো থাকার কথা। ইঞ্জিনিয়ার স্বামী, ভালো বাড়ি-গাড়ি নিয়ে সুখেই তো থাকার কথা।
আমার মতো গাবলুর কথা মনে রেখে কষ্টই শুধু বাড়বে তার। তিথীর বিয়ের কথা শুনেছিলাম চৈতির কাছ থেকে।
খুব সহজভাবেই নিয়েছিলাম। আমি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
এখানে আসার পর অনুভূতি গুলা ভোতা হয়ে গেছে মনে হয়। কিন্তু সে রাতে বুঝেছিলাম অনুভূতি ভোতা হয় না।
দুঃখ কষ্টের বোধগুলা কখনো মরে না। সে রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। হু হু করে কাদছিলাম বালিশ চাপা দিয়ে।
কিন্তু কান্নাটা যে চাপা রাখতে পারিনি সেটা বুঝলাম হান্নান ভাইয়ের নাক ডাকার আওয়াজ বন্ধ হওয়াতে..
গলা উঁচু করে বললেন "এই রুপক, কি হয়েছে তোর?
তোদের মতো সেন্টিমেন্টাল ছাওয়াল দিয়া কিচ্ছু হইব না.." আসলেই আমাকে দিয়ে কিছুই হয়নি।
বাবা অনেক টাকা খরচ করে এই দূর দেশে পাঠালো ভালো করে লেখাপড়া করার জন্য।
আমারো স্বপ্ন ছিলো তাই। কিন্তু সেই স্বপ্নের ছিটেকোটা-টা আছে শুধু পড়ে।
আসার এক বছরের মাথায় বাবা মারা গেলেন সড়ক দূর্ঘটনায়।
বাবার সঞ্চয় বলতে শুধু ছিলো মালিবাগের একটা বাড়ি।
মা কখনো মুখ ফুটে টাকার সমস্যার কথা বলেনি আমাকে।
কিন্তু আমিতো জানি চৈতি আর রৌশনিকে নিয়ে মাকে কতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।
সেদিন চৈতি মেইল দিয়েছিলো বলেছে চিন্তা না করতে।
সে তিনটা টিউশনি করছে, গান শিখায় পাড়ার দুইটা মেয়েকে।
আমি যেন আমার যত্ন নিই ঠিকমতো। কোনরকম চিন্তা যেন না করি।
ছোট বোনের কথা শুনে আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।
আমারই তাদের সান্ত্বনা দেয়ার কথা ছিলো অথচ আমাকে তারা বুঝায়।
নিজেকে ছোট কীট পতঙ্গের চেয়েও ক্ষুদ্র মনে হয়। আমি ফোন করা ছেড়ে দিয়েছি।
পালিয়ে বেড়াই সব কিছু থেকে। কিন্তু নিজের থেকে কি পালাতে পারি?
টাকার জন্য এবারেও ইউনিভার্সিটিতে রেজিষ্টার করা হলো না।
টাকার জন্য তো দেশেই যাওয়া হলো না। বাবার মুখটা শেষবারের মতো দেখাও হলো না।
এ কষ্ট আমি তিলে তিলে জমা করে রেখেছি বুকের ভেতর।
বাবা আমার কি তীব্র যন্ত্রনায় মুষড়ে পড়ছিলো..শুধু বলছিলো "খোকা কোথায়? খোকাকে খবর দাও।"
আমি আমার বাবার এমনই অধম ছেলে বাবার জীবিত মুখ দেখা দূরের কথা, মৃত লাশটাও দেখতে পারলাম না ।
টাকার কথা দেশে জানাইনি। বলেছিলাম ফাইনাল চলছে এরকম সময়ে আসতে পারব না।
মা কিছু বলেনি, বোধহয় বুঝতে পেরেছিল। মায়ের কাছে আমার কোন আড়াল নেই।
মায়ের কাছে আমার মনটা খোলা আকাশের মতোই মেলা রয়েছে। কেউ না জানুক মা জানে।
মা তুমি কি জানো তোমার ছেলে আজ সারাদিন কিছুই খায়নি..এক পশলা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে..
খোকা তোমার ভালো নেই অনেক কষ্টে আছে..আমার তীব্র ইচ্ছে করতে থাকে মায়ের মুখটা দু হাতে ধরে দেখতে..
মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে..আমি কাঁদতে চাই সারা মন প্রাণ জুড়িয়ে মা ।
আমি কাঁদি..ব্যর্থ মানুষের মতো আমি কুজো হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদি। আমার কান্না কেউ দেখতে পায় না। প্রকৃতি তার মানব সন্তানের কষ্ট, নিসংগতা সহ্য করতে পারে না। প্রকৃতি আজ বৃষ্টি হয়ে আমাকে সঙ্গ দেয়। আমি বৃষ্টির হাত ধরে কাঁদি।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০