যতবারই চিটাগাং মেডিকেলে আসি, ততবারই লাশখানায় যাওয়ার চেষ্টা করি।
ছোটবেলা থেকেই এই লাশখানার প্রতি একটা বিশেষ আগ্রহ কাজ করতো...
সেখানে কীভাবে কী হয়, জানার খুব ইচ্ছে ছিলো...
বড়বেলায় এসে সেই ইচ্ছেটা নিজেই পূরণ করলাম, ফারুক ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব করে...
ফারুক ভাইয়ের বন্ধুত্ব করার কাহিনী অনেক লম্বা বিধায়, সেই গল্পে যাচ্ছি না। সেই গল্প অন্য আরেকদিন...
লাশখানার ভেতর একেকটা লাশের একেক গল্প। কোন কোন লাশের বিষ খাওয়ার গল্প। কোন কোন লাশের ফাঁস নেওয়ার গল্প। আবার কোন কোন লাশের নাম-পরিচয়হীন অজানা গল্প...
লাশ রাখারও তিনটা ক্যাটাগরি আছে...
যেগুলো সুসাইডের, সেগুলো অন্য সারিতে...
আবার যেগুলোর নাম-পরিচয় নাই, সেগুলো অন্য সারিতে...
যেগুলো এক্সিডেন্টের সেগুলো আরেক সাড়িতে...
সুসাইড করা লাশের বেশিরভাগ আত্মীয় স্বজনরা নাকি তাদের পরিচিত লাশকে নিয়ে যেতে চান না।
বেওয়ারিশ হিসেবেই নাকি দাফন করে দিতে বলেন...
টাকা-পয়সা দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব, এই কাজ সেড়ে নিতে বলেন...
আমি অবশ্য বেওয়ারিশ লাশগুলোর চেহারা দেখার চেষ্টা করি...
দেখলে দেখলাম, না দেখলে নাই...
লাভও নাই, আবার ক্ষতিও নাই...
কয়েকবছর আগেও মানুষ পঁচার গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না...
পরে নিয়মিত যাওয়া-আসাতে অভ্যাস হয়ে গেলো...
টানা ৩/৪ মাসে এই গন্ধ নাকের আয়ত্বে আসলো...
নাহলে তো, প্রথম প্রথম মৃত মানুষের গন্ধ একবার নাকে আটকে গেলেই দেড় মাসেও যেতো না...
না কিছু খেতে পারতাম, না শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম...
অনেককিছুই করে এই গন্ধ থেকে রেহাই পেতে হতো...
এখন বলতে গেলে মোটামুটি কন্ট্রোলে এই গন্ধ...
বেশিরভাগ লাশের মধ্যে মেডিসিনের গন্ধ অনুভব করি, তবে আজকের গন্ধটা ভালো লাগছে...
একদম পলি মাটির গন্ধ।
আহা, কতবছর যে গ্রামে যায় না!
মনে হচ্ছে গ্রামের মাটির গন্ধ পাচ্ছি...
আমি আর আমার কাজিন সাইকেলে করে কত মাঠঘাট যে ঘুরে বেড়াতাম...
আহা শৈশব, আহা কৈশোর...
জিজ্ঞেস করলাম ডোমকে, ভাই এই লাশের এমন গন্ধ কেন?
ডোম বলে, এক সপ্তাহের মত তাকে হত্যা করে কর্দমাযুক্ত কাঁদার নিচে পুঁতে রেখেছে। সারা শরীরে কাঁদা। মুখের ভেতরে কাঁদা। কানে কাঁদা। সারা দেহ পরিষ্কার করার পরও কাঁদার গন্ধটা যায়নি...
প্রায় ২০ মিনিটের মত ডোমসহ সেখানে বসে আড্ডা দিলাম...
ডোমের নাম ফারুক মিয়া। কিন্তু উনি নিষেধ করে দিয়েছেন, ওই নামে না ডাকতে...
নাম ধরে ডাকলে নাকি উনার অপমান লাগে...
তাই উনার আবদার, উনার প্রফেশন নিয়ে যাতে উনাকে ডাকা হয়...
এই প্রফেশনে নাকি অনেক সম্মান করেন...
আফসোস করে ডোমকে বললাম, আহা ভাই এই মানুষগুলোর কত শত পরিচিত জন আছে, অথচ একটা নাম-ঠিকানার অভাবে বেওয়ারিশ হিসেবে পড়ে আছে...
ডোম হেসে বললো, সমস্যা নাই, ওই যে লাল পাহাড় দেখতাছেন না? ওই লাল পাহাড়ে ওদের দাফন করা হবে, যদি না কারও পরিচিতি পাওয়া না যায়...
এই কাঁদার গন্ধওয়ালা লাশটাকে আজ রাতে সেখানে দাফন করা হবে...
মনে মনে নিজেকে নিজে বললাম, বাহ, একটা লাশের নাম অন্তত দেয়া হলো, কাঁদার গন্ধওয়ালা লাশ...
কাছে গিয়ে কানে কানে লাশটাকে বললাম, ও লাশ ভাই, আপনার নাম শুনেছেন তো?
কাঁদার গন্ধওয়ালা লাশ...
খুব সুন্দর নাম...
মনে থাকবে তো? এখানে আপনি ছাড়া আর কারও নাম দেয়া হয়নি কিন্তু...
কাউকে বলিয়েন না আবার, মনে রাখিয়েন লাশেরও কিন্তু কান আছে...
নয়ন বড়ুয়া
আগস্ট, ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:৫৮