বাবা ছিলেন
একজন বদমেজাজী, প্রচন্ড রাগী মানুষ।
শাসনে ছিলো ব্যাঘ্য কন্ঠের গর্জন।
অল্পতেই বকাঝকা করতেন। চোখ রাঙ্গাতেন।
ছোট বেলায় বাবার ভয়ে তটস্থ থাকতাম। স্কুল, খেলাধুলা,খাওয়া দাওয়া, হাতমুখ ধুয়ে পরিপাটি থাকা ছিলো নিত্য দিনের কাজ। কোন ভূল করলে মা তেমন মারতেন না, বুঝাতেন, শাসাতেন কিংবা ডাল ঘুটনি দেখিয়ে মার দেয়ার ভয় দেখাতেন। তবে একটু অনিয়ম বা বেশী ভূল করলে, বলতেন-আজ তোমার আব্বু আসুক, সব বলে দিবো। তাতেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যেতো।
তখন বাসায় বিদ্যুৎ ছিলো না। হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসতাম। রাত সাড়ে আটটা বাজতে না বাজতেই, চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম আসতো। বাবার চোখ ফাকি দেয়ার জন্য সিজার সিগারেটের প্যাকেট কিংবা কোন কাগজ ছিড়ে হারিকেনের চিমনীতে দিতাম, শান্তিতে একটু ঝিমানোর জন্য। কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়-হঠাৎ যেন বাঘের গর্জন। হুমরি খেয়ে লাফ দিয়ে উঠতাম। বিরবির করে বলতাম, কই ঘুমাইনা তো।
পড়ায় কিংবা নিত্য দিনের (রুটিন) কর্মে কখনই ছাড় দিতেন না। কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠা, সময় মতো ফ্রেস হওয়া, পড়ায় বসা, নাস্তা কিংবা খাবার খাওয়া, স্কুলে যাওয়া, খেলাধূলা করা, হাতমুখ ধোয়া, সবই ছিলো রুটিন মোতাবেক। রাতে বাবাই পড়াতেন, পড়া না পারলে ধমক, কঞ্চির টাস টাস শব্দের কমতি হতো না। পড়া কমপ্লিট না হলে, ছুটি দিতেন না। তখন রাত দশটা মানেই গভীর মধ্য রাত। ঝিঝি পোকার ডাক আর ভুতুরে পরিবেশ। কিন্তু পড়া কমপ্লিট করার পর, সেই পড়া মুখস্থ কিংবা লিখে দিলে পর ছুটি হতো, নয়তো রাত এগারোটা অবধি কিংবা আরো বেশী সময় ধরে পড়েই যেতে হতো। তারপরও পড়া না হলে, উত্তম মধ্যমের কমতি হতো না। বাশেঁর কঞ্চি ছিলো ডিটেনশনের হাতিয়ার। তবে, শখ করে পিকনিকে গিয়ে বাঘের শরীরের মতো ছাপ ওয়ালা যে বেত আনতাম, সেটা দিয়ে তখন হতো শখের বারোটা বাজতো। মা পাশে থেকে প্রায়ই বেত্রাঘাত থেকে বাচানোর সর্ব্বোচ্চ চেষ্ঠা করতেন। তারপরও যখন রেহাই পেতাম না,কান্না করতাম, ব্যাথায় কোকড়াতাম, তখন চুপটি করে চোখ ভেজাতেন আমার মা। মাঝে মধ্যে ভাবতাম, দাড়াও বড় হয়ে নেই, তখন প্রতিশোধ নিবো।
মার খাওয়ার দিন, রাতে যখন বিছানায়, তখন মাঝে মধ্যে, ঘুম না আসলেও চোখ বন্ধ করে রাখতাম। তখন উপলব্দি করতাম, বাবা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, ব্যাথা স্থানে মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন, মাথা মুছে দিচ্ছেন কিংবা আম্মাকে কে বলছেন, ছেলেটাকে আজ বেশী মেরেছি, মনটা সইছে না। ঘুমের বান করে, চুপচাপ থাকতাম। আমি যে সজাগ সেটা বুঝতে দিতাম না। মাঝে মধ্যে খুব গোপনে একটু তাকাতাম, দেখতাম বাবার চোখের কোনও যেন একফোটা জল। মনে মনে বলতাম, তখন মেরে এখন নিজে কাঁদেন। মারার সময়তো মারতেই থাকেন, হুস থাকে না।
সকালে অফিসে যাবার প্রাক্কালে মিষ্টি করে হেসে আদর করে, তারপর বাসা হতে বাহিরে পা দিতেন। আমাদের সকল আবদার বা চাহিদা রাতে খাবার পর বাবাকে জানাতাম, তিনি কখনই নিরাশ করতেন না। বয়স ছোট হলেও বায়নার কমতি ছিলো না। মাঝে মধ্যে দেখতাম কী যেনো ভাবেন, তারপরও চাহিদা পূরণের আশ্বাস দিতেন, আদর করতেন। বলতেন তোমাদের কথা (চাহিদা) আমি পূরণ করবো কিন্তু আমারও একটা কথা (চাহিদা) আছে, ভালো ভাবে লেখাপড়া করতে হবে, ভালো মানুষ হতে হবে। আমি, মাথা ঝুকিয়ে জি বলতাম। এতেই যেনো বাবা খুশী হয়ে যেতেন।
বাবা খুবই নিয়ম মেনে চলতেন। ঘড়ির কাটার সাথে ছিলো ওনার সকল কর্মের সখ্যতা। খাবারে এবং পোষাকেও ছিলেন যথেষ্ঠ সচেতন ও পরিপাটি। জুম্মা দিনে সুগন্ধি আতর এবং অফিস কিংবা অন্যত্র যাবার প্রাক্কালে সব সময়ই পারফিউম ব্যবহার করতেন। জেট ডিটারজেন পাউডার কিংবা ৫৭০ নামক সাবান দিয়ে, কাপড় চোপড় ধোয়ার পর, ইস্ত্রি করাতে লন্ড্রিতে পাঠাতেন । সাদা গেন্জি, সুতির পায়জামা পান্জাবী ধোয়ার পর গুড়া নীল দেয়া ছাড়া, ব্যবহারই করতেন না। তদুপরি এখন বোধ করছি, ওনার অফিস, সামাজিকতা কিংবা আটপৌরের যত পোষাক, তা” আমার (সন্তানদের) তুলনায় কমই ছিলো। আমাদেরকে নুতন নুতন পোষাক পরাতে, পর্যাপ্ত ফলমুল খাবার খাওয়াতে তিনি খুব তৃপ্তি পেতেন। শুনেছি, শিশু অবস্থায় আমাকে গরুর দুধ খাওয়ানের জন্য তিনি বিশাল গরু কিনেছিলেন।
একবার, কোন এক অসুখে, বাবা আমাকে, ওনার সাইকেলে বসিয়ে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে শহীদ মিনারে নিয়ে যান এবং ভাষা শহীদদের ইতিহাস, খুবই সহজ ও সাবলীলভাবে বুঝিয়ে ছিলেন, যা আজও মনে দাগ কাটে। বিমান দেখানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে, রেলিং ধরে দাড়িয়ে, আবার বাবার কাধে চড়ে, হলুদ রঙের বিমান দেখে কতইনা খুশী হয়েছিলাম। সন্তানের খুশীতে পিতাও যে খুশী হন, তখন না বুঝলেও, আজ সন্তানের পিতা হয়ে উপলব্দি করি। আসলে বাবা ছিলেন মিষ্টিকড়া পরম বন্ধু আমার ।
অফিস কর্মের পাশাপাশি সামাজিক কর্মেও সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন। ঢাকার গোলাপবাগ এলাকার তৎকালীন (সময় কাল ৭০-৮০ দশক) মুরুব্বীদের সাথে নিয়ে এলাকার যাতায়াতের সুবিধার্থে সাঁকো তৈরী, রাস্তা ঘাট, অলিগলি নির্মান/মেরামত করা, ওয়াসার পানি লাইন সংযোগ, বিদ্যুতের মেইনলাইন আনয়নে, বরাবরই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। সেই সাথে কুমিল্লা, কৃষ্ণপুর গ্রামের সাথে ছিলো ওনার নাড়ীর সম্পর্ক। ছিলো যাতায়াত ও নিবিড় যোগাযোগ। প্রায় দুতিন মাস পরপরই যেতেন গ্রামে। বাবার পুরো নাম মোঃ সামছুল হক। তবে গ্রামে সামছু নামেই পরিচিত ছিলেন। গ্রামের আত্বীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী-কেনো জানি, বাবাকে খুব পছন্দ করতেন। গ্রামে গেলে, বাবা মার সাথে দেখা করার পরই তিনি গ্রামের মুরুব্বিদের (বিশেষ করে সৈয়দ সাহেব) সাথে দেখা করতে যেতেন। খোজখবর নিতেন। তখন আত্বীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী বাড়ীতে আসতেন। বাবা কাউকে আপ্যায়ন না করায়ে বিদায় দিতেন না। বিকালে কুমিল্লার সুয়াগাজী বাজারের একটি নির্ধারিত হোটেলে, বাবাকে কেন্দ্র করে আত্বীয় অনাত্বীয়দের সগর্ব উপস্থিতিতে হয়ে উঠতো এক মিলন মেলা। চলতো খোজখবর, খোশগল্প ও চায়ের ধুম। ছোটবড়, সমবয়সী এবং মুরুব্বী, সবার কাছেই ওনার একটা বিশেষ গ্রহনযোগ্যতা ছিলো।
বাবা সব সময়ই সততার সাথে চলতেন। দুর্নীতি বা অবৈধ কাজ বরাবরই অপছন্দ করতেন। জানা যায়, ওনার অফিসের অধস্থন ব্যক্তিদেরও ঢাকায় একাধিক বাড়ীর মালিক হয়েছেন। সৎ উপার্জনে হজ্ব করবেন বলেই তিনি নির্ধারিত সময়ের পূর্বে চাকুরী ইস্তফা দেন এবং পেনশনের এককালীন অর্থ খরচ করে, হজ্ব পালন করেন। খেলা খুব পছন্দ করতেন। বিশ্বকাপ ফুটবল, মোহাম্মদআলী ক্লে এর মুষ্টিযুদ্ধ দেখতে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে জেগে দেখতেন। ছিলেন ভোজন রসিক ও অতিখি পরায়ন। আমাদের বাসায় প্রায়ই মেহমান আসতেন, থাকতেন। কাহারোর চাকুরী দরকার, চিকিৎসা দরকার, বিদেশ যাবে কিংবা ঘুরে বেড়াবেন কিংবা আমাদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করবে, এ সমস্ত বিভিন্ন প্রয়োজনে নির্দিধায় বাসায় আত্মীয়-অনাত্মীয়রা আসতেন। সবার সাথেই তিনি মন খুলে আলাপ আলোচনা করতেন, সবাইকে নিয়ে একসাথে খেতেন। তিনি বেশী বেশী আইটেম দিয়ে সবাইকে খাওয়াতেন এবং নিজেও খেতেন। যার যার প্রয়োজন বেধে বাবা তাদের সহযোগিতা করতেন, ফেরার সময় কারো কারো পকেটে গুঝে দিতেন গাড়ী ভাড়া। যেনো সব দায়িত্ব তাঁর। তিনি বলতেন, মানুষকে সাহায্য সহযোগীতা করা আল্লাহও পছন্দ করেন। আর মেহমান যার যার রিজিক নিয়ে নিয়ে আসেন। তাতে আমাদের কোন কিছুই কমে না বরং মেহমানের উছিলায় আল্লাহ আমাদের খাবারে বরকত বাড়িয়ে দেন, আমাদের উপর রহমত করেন, আমাদেরকে ভালো রাখেন। সুস্থ রাখেন। গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার সময় তিনি এলাকার গরীব আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের জন্য কাপড় চোপড় ও খাবার নিয়ে যেতেন। আর্থিক সহায়তাও করতেন।
চাকুরীর সুবাধে বাবা অফিসের গাড়ীতে চলাচল করতেন। কিন্তু তারপরও আমার জানামতে, বাবার একটা শখ কখনই পূর্ণ হয়নি। একটু একটু করে টাকাও জমিয়ে ছিলেন, হঠাৎ এক গরীব নিকটাত্মীয় অসুস্থ হয়ে পরলেন, তার চিকিৎসার জন্য সেই টাকা তাকে দিয়ে দিলেন। যে কারনে বাবার আর মোটর সাইকেল কেনা হলো না, শখ অপূর্ণই রয়ে গেলো।
এক কথায় বাবা ছিলেন বন্ধুবৎসল, আত্বীয়স্বজন ও প্রতিবেশী প্রবন, পরোপকারী, সমাজসেবী, আদর্শবান, সু-শৃংখল প্রকৃতির ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। নিজের বাবা বলে নয়, পৃথিবীর সকল বাবারাই এমনই হয়। সমাজ, পরিবার ও সন্তানের জন্য সকল বাবা যেন একই সূত্রে গাথা।
দীর্ঘদিন পর আজ বাবাকে খুব মনে পরছে।
আমার সেই প্রতিশোধ আর নেওয়া হয়নি এ জীবনে।
বাবা, আমি আপনার মতো গোপনে চোখের জল ফেলতে পারি না।
আপনার কথা মনে পরলে কেনো যেনো মনটা খারাপ থাকে, অনেকক্ষন।
নীরবে নীভৃতে বুকটা হাহাকার করে। কষ্ঠ হয়।
আপনার সেই ধমক, সেই বাাঁশের কঞ্চির বেত্রাঘাত আজ যেনো পুরোই বৃথা।
মনে হয়, আমি পুরোপুরি মানুষ হতে পারিনি।
মানুষ হলে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে কাঁদতে পারতাম।
সমাজে কাজে লাগতাম।
বাবা আমি ব্যর্থ, আমি অযোগ্য।
যতদিন ছিলেন পাশে, বুঝিনি বাবার কী মর্ম।
বাবা নামক বটগাছ টির ডালপালা ভেঙ্গেছি,
ক্ষত বিক্ষত করেছি,
কষ্ট দিয়েছি হাজার বার, লক্ষ বার।
বুঝি নাই, আপনার রিদয়ে রক্ত ক্ষরনের স্রোতধারার কষ্ট।
তবুও বাবা, আপনি মাথায় ঝড়বৃষ্টি সহ্য করে,
বটগাছের ছায়া থেকে, বঞ্চিত করেননি আমাদেরকে।
বাবা,আপনি আমার যোগ্য বাবা ছিলেন
কিন্তু আমি আপনার যোগ্য সন্তান হতে পারি নাই।
পৃথিবীর সকল বাবাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
হে আল্লাহ, সকল বাবাদের কে ভালো রাখুন।
যে বাবা আজ কবরবাসী, ওনাকে বেহেস্ত নসীব কুরুন, আমিন।
রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি সগিরা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২০ রাত ১১:৩৪