বাকলিয়ার মিয়া খান নগরে বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট করে আবাসিক প্লট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। চরচাক্তাই উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে আবাসিক প্লট তৈরি করতে ইতোমধ্যেই মাঠের মাঝখানে চলাচলের রাস্তা, তৈরি করা হয়েছে। প্রতি কাঠার দাম ত্রিশ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করে প্লট বরাদ্দ দেয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে। এতে করে এলাকায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে নন্দনকাননে স্কুল ভবন ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের তোড়জোড় চালিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয় সিটি কর্পোরেশন। পরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে স্কুল ভবনে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ হতে পিছু হটে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
সূত্র জানিয়েছে, স্বাধীনতার লাভের পর ১৯৭২ সালে বাকলিয়ার মিয়াখান নগরের চরচাক্তাই এলাকায় অবাঙালীদের ফেলে যাওয়া প্রায় তিন একর জায়গার উপর চরচাক্তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং চর চাক্তাই উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা এবং কলামিস্ট মোহাম্মদ ইদ্রিস আলম বিদ্যালয় দুইটির প্রতিষ্ঠাতা। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকার ফলে বিদ্যালয় দুইটি শুরুতেই এলাকার শিক্ষা-দীক্ষার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠে। চরচাক্তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন হাজার দুইশ’ ছাত্র ছাত্রী পড়ার রেকর্ড রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে স্কুল দুইটি খুবই ভালোভাবে চলে আসছিল। বিদ্যালয়ের পাশে একটি ইউসেফ স্কুল এবং একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও রয়েছে। এখানে বাকলিয়া মহিলা কলেজ নামের একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে অনেকদিন ধরে। সাবেক এক মন্ত্রী এখানে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু কলেজ প্রতিষ্ঠার সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।
১৯৯৭ সালে এসে চরচাক্তাই উচ্চ বিদ্যালয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হয়। বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্কুল হস্তান্তর করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী স্কুলটিকে ভবিষ্যতে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। এলাকাবাসী আশ্বস্ত হয়ে স্বপ্ন দেখেছিল। ১৯৯৭ সাল থেকে সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় স্কুলটি পরিচালিত হয়ে আসছে। মোটামুটি মানের একটি স্কুল হিসেবে এটি বেশ ভালোভাবেই চলছে।
চরচাক্তাই উচ্চ বিদ্যালয় এবং চরচাক্তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় চার হাজার ছাত্র ছাত্রী রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক ছাত্র ছাত্রীর খেলাধুলার জন্য স্কুলের সাথে একশ’ চল্লিশ গন্ডার একটি মাঠ রয়েছে। বিশাল এই খেলার মাঠটিই পুরো এলাকার একমাত্র মাঠ। স্কুলের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও এলাকার হাজার হাজার যুবক এই মাঠে খেলা করে। বৃদ্ধরা বিকেলে হাঁটেন। অনেকেই মাঠে বসে গল্পগুজব করে সময় কাটান। গত প্রায় তিন যুগ ধরে এলাকাবাসীর অতি প্রিয় একটি স্থান হিসেবে মাঠটি টিকে আছে। মাঠটিকে প্লট বানিয়ে বিক্রি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল একবার। এলাকাবাসীর তীব্র আন্দোলনের হুমকির মুখে সেই প্রক্রিয়া থেমে যায়। গত বেশ কিছুদিন বিষয়টি নিয়ে আর তেমন কোন উচ্চবাচ্য হয়নি। স্কুলে লেখাপড়া হয়। মাঠে খেলাধুলা চলে। কারো কোন অসুবিধা না হলেও কিছুদিন আগে সিটি কর্পোরেশন মাঠ এবং স্কুলের মাঝ বরাবর একটি রাস্তা তৈরি করে দেয়। স্কুলের ভিতরে এত বড় রাস্তা করে দেয়ায় গাড়ি চলাচল বেড়ে যায়। যাতে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের চলাচলে অসুবিধা এবং দুর্ঘটনার আশংকা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এলাকার উন্নয়নে রাস্তার প্রয়োজন বিধায় এলাকাবাসী এই রাস্তা নির্মাণের কোন বিরোধিতা করেননি।
কিন্তু স্কুলের মাঠকে প্লট বানিয়ে বিক্রি করে দেয়ার বিজ্ঞাপন পত্রিকায় দেখে স্থানীয়রা নিশ্চিত হন যে রাস্তাটি জনগণের চলাচলের সুবিধার জন্য নয়, মাঠকে প্লট বানানোর সুবিধার্থে তৈরি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পত্রিকায় যেই বিজ্ঞাপন দিয়েছে তাতে ২.২৩ কাঠা থেকে ৩.৮০ কাঠা আয়তনের প্লট বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি প্লটের জন্য আবেদন ফরম এক হাজার টাকা দিয়ে সিটি কর্পোরেশন থেকে কেনার কথা বলা হয়েছে। প্রতি কাঠা প্লটের দাম ত্রিশ লক্ষ টাকা এবং কাঠা প্রতি দশ লাখ টাকা জামানতের পে অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফটসহ আবেদন করতে বলা হয়েছে। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে প্লট বরাদ্দের কথাও বলা হয়। সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগের এস্টেট শাখা থেকে প্রচারিত এই বিজ্ঞাপনে প্লটের নির্দিষ্ট স্থানের উল্লেখ না করে চরচাক্তাই স্কুলের নিকটবর্তী বলে উল্লেখ করা হয়। গতকাল সরজমিনে স্কুলের নিকটবর্তী এলাকায় খোঁজ নিয়ে স্কুলের মাঠটি ছাড়া আর কোন জায়গা আবাসিক এলাকার প্লট করার উপযোগী দেখা যায়নি। এস্টেট অফিসার এখলাসুর রহমান চর চাক্তাই স্কুল মাঠে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার কথা স্বীকার করে বলেন- মাঠটি ভরাট করে আবাসিক প্লট করতে নিয়োগকৃত ঠিকাদারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন অনুযায়ী প্লট বরাদ্দ করা হবে।
এ ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান শহিদুল আলম বলেন- মাঠটি খোলা থাকায় তা স্কুল ছাত্ররা খেলার মাঠ হিসাবে ব্যবহার করতো। এলাকায় কোন ব্যক্তি মারা গেলে ঐ মাঠে জানাযাও হতো। এখন কর্পোরেশন উক্ত মাঠে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর এয়াছিন চৌধুরী বলেন- মাঠটি স্কুলের হলেও সেটার মালিক এখন সিটি কর্পোরেশন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বিহারীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে স্থানীয়রা স্কুল গড়ে তোলে পরবর্তীতে তা কর্পোরেশন অধিগ্রহণ করে।
এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কিছু লোকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলের মাঠটিকে প্লট বানানোর জন্য বহুদিন ধরে চেষ্টা চলছিল। অবশেষে সিটি কর্পোরেশন তাদের খোলস খুলে বেরিয়ে এসেছে মাঠকে প্লট বানিয়ে বিক্রি করে দেয়ার জন্যই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে।
সিটি কর্পোরেশন অপর্ণা চরণ বালিকা বিদ্যালয়ের ভবন ভেঙ্গে সেখানে স্কুল ভবনে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। ব্যাপক গণ প্রতিবাদের মুখে সেই কর্মসূচি থেকে ফিরে আসে সিটি কর্পোরেশন। এবার স্কুলের মাঠ দখল করে প্লট করার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হতে শুরু করেছে। স্থানীয় বাসিন্দা এবং স্কুলের সাথে সংশ্লিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অভিমত, সিটি কর্পোরেশন কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। নগরবাসীকে সেবা দেয়ার জন্য এই প্রতিষ্ঠান। অথচ প্রতিষ্ঠানটি তার আদর্শ এবং উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে মহাজনী আচরণ শুরু করেছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক বলেও তারা মন্তব্য করেন। তারা বলেন, নগরবাসীর স্বার্থের কথা চিন্তা করে সিটি কর্পোরেশনের উচিত নগরীতে খোলা চত্বর এবং খেলার মাঠ তৈরি করা। অথচ তা না করে কর্পোরেশন সবেধন নীলমনি যেই খেলার মাঠটি বাকলিয়া এলাকার রয়েছে সেটিই কেড়ে নিতে চাচ্ছে।’ এলাকাবাসী সিটি কর্পোরেশনকে এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন।
এবার এই লেখাটি পড়ুন।নগরীতে কেউ পুকুর ভরাট করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে : মেয়র ।। কর্পোরেশনের কোন জায়গা অবৈধ দখলে রাখতে দেয়া হবে না
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৩৪