মামা প্রায়শই নিজের গান নিজে রেকডিং করে শোনেন। এটার মধ্যে তিনি অন্যরকম আনন্দ খুঁজে পান। বলা যায় অপার্থিব আনন্দ! কিন্তু এই বিষয়টাকে তার বন্ধু আপন খান মোটেই সহজভবে দেখেন না। তিনি কটাক্ষ করে বলেন—শুনরে ব্যাটা মুটকো, পাগলের সুখ মনে মনে! মামা কিন্তু এইসব বিষয়ে মোটেও পাত্তা দেওয়ার লোক নয়। বরং নিজের কাজকেই তিনি সবসময় গুরুত্ব দেন। আজ কী মনে কের যেন সকাল সকালই কাজে লেগে গেলেন। মোবাইলে রেকর্ডিং অন করা। মামা তন্ময় হয়ে গান গাইছেন। মামা সাধারণত চোখ বন্ধ করে গান গান। তার ধারণা—এতে মনোযোগের গভীরতা বাড়ে! আজও তাই করলেন। যতক্ষণ না গান শেষ হলো, ততক্ষণ চোখ বন্ধ রাখলেন। গান গাওয়া শেষ হলে তবেই তিনি চোখ খুললেন।
মামার মন খুবই ফুরফুরে। কেননা আজকে তিনি তার প্রিয়াকে নিয়েই গান লিখেছেন। শুধু লিখেই শেষ নয়! সে গানের সুর করা থেকে শুরু করে নিজেই গলা ছেড়ে গেয়ে রেকর্ড করেছেন। আজকের গান প্রিয়তমাকে না শোনালেই যে নয়! যে কথা সেই কাজ। মামা তার বান্ধবীকে সেই খাদিম চাবাগানে আসতে বললেন। নানা কারণেই মামা নীরব এলাকা বেশি পছন্দ করেন। মামার বান্ধবী কিন্তু ওইসব নীরব জায়গা বা ঝোপঝাড় মোটেও পছন্দ করেন না। কেন করেন না—সে ব্যাখ্যা আর নাইবা করলাম। কারণ কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে না আবার সাপ বেরিয়ে আসে!
মামার বান্ধবীর নাম শাহজাদী। মামা অবশ্য মজার ছলে মাঝেমধ্যে তাকে হারামজাদী বলেও ডাকে। সে যাইহোক। শাহজাদী বললেন—আজ কিংব্রিজে এসো। আমার বান্ধবীরাও তোমার গান শুনবে। এ কথা শোনার পর মামার তো খুশিতে প্রায় স্ট্রোক করার মতোই অবস্থা! সময়টা জিজ্ঞেস করেই তিনি অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকেন।
অপেক্ষার সময় কি আর ফুরাতে চায়? কত বার যে তিনি ঘড়িতে সময় দেখেছেন সে হিসাব করতেও বোধ করি শহীদ আশরাফের মতো ক্যালকুলেটর বিশেষজ্ঞ লাগবে! অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। কাটায় কাটায় সাড়ে চারটা। সূর্যের আলো অনেকটাই পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। গোলটেবিল বৈঠকের মতো গোলাড্ডা। শাহজাদী বললেন—এবার শোনাও তোমার সেই বিখ্যাত গান। শাহজাদীর বান্দবীরা নড়েচড়ে বসলো। কেননা, মামাই হলেন আজকের আড্ডার মধ্যমণি। কেমন এক অদ্ভুত আনন্দে মামার সমস্ত শরীরটা শিহরিত হচ্ছে। তিনি মোবাইল বের করে গানের রেকডিং অপেন করলেন। প্লে বাটন চাপলেন। বেজে উঠলো মামার সেই বিখ্যাত গান! তুমি আমার ভাঙ্গারি…এই ভাঙ্গারি…!
ভাঙ্গারি শব্দ শুনতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন শাহজাদী। এটা কোনো গান হলো? ফালতু কোথাকার? ফ্রড কোথাকার? বান্ধবীদের সামনে আমাকে অপমান করার সাহস হলো কী করে? আমি পেছনের টেবিল থেকে উঁকি দিতেই দেখি মামা তার ডানের গাল হাতাচ্ছেন। ওমা! বান্ধবীসমেত শাহজাদীও ততক্ষণে উধাও! টেবিল একেবারেই খালি। মামার গালের দিকে আর তাকানোরই সাহস পাচ্ছি না। একেবারেই রোদেপুড়া ইংরেজদের মতো লাল হয়ে গেছে।
মামা হ্যাবলাকান্তের মতো এক হাত দিয়ে গাল ধরে বিষণ্ন মনে বসে আছেন। সদ্য বিধবা নারীদের মতোই মামাকে খুবই বিমর্ষ লাগছে। এই অবস্থায় তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা মোটেই ঠিক হবে না। পাছে বিলেতিদের মতো আমার গালও লাল হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না! সেই ছোটোবেলা থেকেই তো তাকে চিনি। ওদোর পিণ্ডি বুদোর ঘারে দিতে তিনি মোটেও পিছপা হন না। বলতে গেলে তার শিরা-উপশিরা পর্যন্তও চিনি!
আমি কোনোক্রমে সটকে পড়ার জন্য পা বাড়াতেই রুবজ মামার ডাক পড়ল। বুঝলাম আজকে কপালে শনির দশা আছে। সকালে একবার পত্রিকায় জ্যোতিষশাস্ত্রের পাতায়ও চোখ রেখেছিলাম। রাহুর প্রভাব পড়তে পারে জেনেও কেন যে বের হলাম!
একটু আগে মামার ওপর যে টর্নেডো আক্রমণ করেছিল সেটা মামা রীতিমতো চেপে গেলেন। কেবল আমাকে বললেন—আইচ্ছা ভাগিনা, এখটা ব্যাপার আমি ঠিক বুজরাম না। সকালিবেলা আমি এখটা গান রেকর্ড করলাম। প্রথম লাইনটা অলান—তুমি আমার। কিন্তু আমার রেকর্ডিংয়ে ভাঙ্গারি শব্দ আইলো কীলান? ইখান আমার গানোও নাই, আর আমিও ইখান গাইছি খরি মনো অর না। আমি মামাকে উৎফুল্ল করার জন্য বললাম—পুরো লাইনটা আরবার খউক্কা-রেকর্ডে কিতা আইছে। তিনি বললেলন—তুমি আমার ভাঙ্গারি…এই ভাঙ্গারি…!
গানের কলি শুনেই আমি অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লাম। আমার হাসির শব্দে মামার যেনো গা জ্বলে যাচ্ছে। জ্বলে যাওয়ারই তো কথা। কেননা, এটা যে অনেকটা কাটা ঘায়ে নুনেরছিটের মতোই অবস্থা!
হাসি অবস্থায়ই মামার চোখের দিকে তাকালাম। তার চোখ ক্রমশ লাল হচ্ছে। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে আমি একটু দূরত্ব বজায় রেখে বললাম—মামা, রাগ করইন কিতার লাগি। দোষ তো আফনার নিজর। রাস্তার লাগা জানালা খোলা রাখি রেকর্ডিং করলে তো ভাঙ্গারিওয়ালার ভাঙ্গারি, এই ভাঙ্গারি… শব্দ অটো ঢুকবো!
আমার কথা শেষ হতেই মামা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। —হালার হালা! তরে কতদিন কইছি রাস্তার লাগা জানালা ইতা কোনোদিন খুলতে নায়। তুইন খুলছত খরি আইজ…। এই বলেই মামা একহাতে তার বিলেতি গালটি লুকানোর চেষ্টা করলেন। আমার বোঝার বাকি রইলো না—এরপর কী ঘটতে পারে।
আমি ফিরতিপথের দিকে হাত উঁচিয়ে বললাম—শহীদ এখটুতা ওবা, আমি আইয়ার। এই বলেই দিলাম দৌড়। আমার নাগাল আর পায় কে! পেছন থেকে তখনও মামা গালি দিয়েই চলছেন—হালার হালা!
১৬.০৯.২০২২
উপশহর, সিলেট
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১০:২০