প্রধান শিক্ষককে আমরা জন্মের ভয় পেতাম। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আমরা তাঁর ধারেকাছেও যেতাম না। আরও একজন শিক্ষককে আমরা ভয় পেতাম। তাঁর গল্প অন্য আরেকদিনের জন্য রেখে দিলাম।
এখন এমন একটা সময়ে আমরা বাস করছি যে, মোবাইল ছাড়া আধুনিক জীবন কল্পনাই করতে পারি না। ঠিক তেমনই এক যুগ বা দুই যুগ আগেও শিক্ষকেরা বেত ছাড়া শিক্ষাদান কল্পনাই করতে পারতেন না। হুইল পাউডারের বিজ্ঞাপনে যেভাবে বলে—আহা! হুইল ছাড়া আমাদের একদিন কি চলে? এটা তো আমার সংসারেরই একটা অংশ! তৎকালীন শিক্ষকদের কাছে বেতের বিষয়টি ছিল অনেকটা এরকমই! বেত ছাড়া তাঁদেরও কী একদিন চলে!
স্যারের বেত্রাঘাতের পক্ষে হয়ত অনেক যুক্তিই দাঁড় করানো যাবে; কিন্তু সেবসব যুক্তিতর্কে আমি যাচ্ছি না। আমি কেবল মানবিক দিকের কথাই বলবো। স্যারের জালি বেত বা সিঙ্গলার বেত খায়নি এমন শিক্ষার্থী আমাদের ক্লাসে ছিল না বললেই চলে। মার খাওয়া আমাদের যেমন নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তেমনই স্যারেরও মার দেওয়াটা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। একদিন আমাদের এক সহপাঠি জ্বর নিয়েও ক্লাসে হাজির। শারীরিক অসুস্থতায় স্যারের হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করতে পারেনি।
স্যার, পড়া জিজ্ঞেস করতেই সে বললো— স্যার, রাইতে জ্বর ওটছিলো, হের লাইগা পড়া মুখস্ত করবার পারি নাই। স্যার, কেন যেনো তার কথাটি বিশ্বাস করলেন না। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল মাইর। বিষয়টি আমার কাছে খুবই অমানবিক মনে হলো। আমি সাহস করে বললাম, স্যার ও সত্যিই অসুস্থ।
আমার কথা শেষ না হতেই স্যার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠলেন। তরে জিকার করছিনি? তরে ওকালতি করতে খইছিনি? ব্যাস শুরু হয়ে গেল আমার ওপর ঝড়! অন্যান্য দিন অনেক কাকুতিমিনতি করি, ক্ষমাপ্রার্থনা করি; কিন্তু কেন যেনো আজ কিছুই করতে মন চাইল না। স্যারের যতক্ষণ ইচ্ছা মারতে থাকলেন। একবার আমাকে আরেকবার তাকে। আমার মুখ থেকে টু শব্দটিও বের হলো না। আমার নীরবতায় স্যার কি একটু ভরকে গিয়েছিলেন?কী জানি! এখন আর সেকথা মনে করতে পারি না।
স্যারের আজকের আচরণে ক্লাসের সকলেই ব্যথিত হলো। বিরতির সময় আমরা সকলেই বড়ইতলায় জড়ো হলাম। এটা অনেকটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মতো! আড্ডাখানা আরকি!
সহপাঠিরা কথা বলছে। তবে খেয়াল করলাম সবার স্বরেই গ্রীষ্মের দাবদাহ। আমি কিছুই বলি না। কেবল মার খাওয়া বন্ধুটির পানে তাকাই। সত্যিকার অর্থেই তার জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছিল। আমি তার শার্ট খুলে পিঠের অবস্থা অবলোকন করলাম। ওহ্! আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। অবস্থাদৃষ্টে আমার শিশু হৃদয়ে যে ক্ষরণ হচ্ছিল সেকথা ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে। আমি নির্বাক হয়ে অদূরের বাঁশঝাড়ের দিকে তাকাই। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বোধের শিল্পাঞ্চল জুড়ে কেবল বিষণ্নতা উপচে পড়ছে। আমার ঠোঁট কাপছে। একসময় সকল নীরবতা ভেঙে আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার সে সহপাঠি বন্ধুটিও কাঁদছে; আর প্রলাপের স্বরে বলছে—আমার জন্য কেন মাইর খাইতে গেলি!
আমাদের এ ঘটনা বোধ করি সকল শিক্ষার্থীর মনেই প্রবলভাবে রেখাপাত করেছে। এক শিক্ষার্থী আমাদের দুজনের জন্য ব্যথার ট্যাবলেট আর মলম নিয়ে এলো। বাল্যের সব স্মৃতিই কি ভোলা যায়? না, যায় না।
একেকজন একেক এঙ্গেল থেকে কথা বলছে। কেউ কেউ অভিভাবকদের জানানোর প্রস্তাব দিল। কেউ কেউ সভাপতির কাছে বিচার দেওয়ার কথাও বললো। তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই নতুন একটি পরিকল্পনা আঁটলেন। মানে আমাদের দুজনকে স্কিপ করে অন্য সহপাঠিরা একটি গোপন সিদ্ধান্ত নিল।
পরের দিন। স্যার জিজ্ঞেস করলেন কে কে পড়া শিখিয়া আইছো না, উবাও। সব শিক্ষার্থী একসাথে দাঁড়িয়ে গেল। ব্যাপার কী? স্যার কিছুটা অবাক হলেন। এমন তো হওয়ার কথা না। এমন তো কোনোদিন হয়নি। তিনি মনে করলেন আমরা সকলেই তার সঙ্গে ইয়ার্কি করছি। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল তার জালিবেতের সন্ধান! তিনি তাঁর টেবিলের ওপর তাকালেন। আট থেকে দশটি ভাঙা বেতের টুকরো! মুহূর্তেই তিনি অন্য সব রুমের টেবিলের দিকে তাকালেন। সব টেবিলেরই একই অবস্থা!সব বেতই ভাঙা। বেত ভাঙা দেখে স্যারের চোখ তো আরও রক্তবর্ণ হয়ে গেল। এত বড়ো সাহস!এত বড়ো আস্পর্ধা! এত বড়ো বেয়াদবি কে করল? তিনি বড়ো টেবিলের গোপন ড্রয়ার খুললেন। সেখানে রাখা এক হালি জালিবেতও ভেঙে খান খান করা! সর্বনাশ!
আমরা সকলেই তখন ভয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। স্যার সে ভাঙা বেতের দিকে তাকিয়ে আরও গরম হয়ে গেলেন। কে ভেঙ্গেছে, কেন ভেঙ্গেছে—এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে লাগলেন। কিন্তু কোনো সহপাঠির মুখ থেকেই কোনো টু শব্দটি বের হচ্ছে না।
স্যার, এরপর কী বুঝে যেনো একেবারেই নীরব হয়ে গেলেন। আমরা দাঁড়িয়েই আছি। স্যার আমাদের বসতেও বলছেন না। হঠাৎ বৃষ্টির মতো স্যারের মধ্যও হঠাৎ পরিবর্তন দেখতে পেলাম। স্যারের কণ্ঠস্বর ভেজা। আমরা আরও ভরকে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম স্যারের চোখ দিয়ে বৃষ্টির নহরার মতো করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। স্যারের সে অশ্রুর বন্যা আমাদেরকেও প্লাবিত করল। আমরা দাগি আসামির মতো অবনত মস্তকে বেঞ্চ থেকে বের হয়ে এক এক করে স্যারের টেবিলের চারদিকে জড়ো হলাম। সমস্বরে বললাম—স্যার, আমাদের ক্ষমা করে দিবেন …। স্যার, কিছু বলেননি। কেবল অঝোরে কেঁদেছিলেন।
এরপর স্যার আর কখনোই ক্লাসে বেত ব্যবহার করেননি। এদিন পর মনে হচ্ছে—স্যার কি সত্যিই আমাদের ক্ষমা করেছিলেন?
বোধের পাঠশালা
২৩/০৩/২০২২
উপশহর, সিলেট
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০২২ রাত ৯:৪৯