অগ্নি, বলাকা সিনেওয়ার্ল্ডে দেখা আমার প্রথম কোন সিনেমা। আমার দেখা মাহী অভিনীত প্রথম কোন সিনেমা। আর সিনেমা নিয়ে আনাড়ি এ দর্শকের প্রথম কোন লেখাও এটি! সিনেমাটির দৃশ্যায়ন, স্পেশাল এফেক্ট, স্বচ্ছ স্ক্রিণ, গ্রাফিক্্র সবমিলিয়ে প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতা দেখে মনে হচ্ছিল, আমাদের চলচ্চিত্র যেন ডিজিটালের পথে পাঁ রাখতে যাত্রা শুরু করল। স্ক্রিপ্ট ছাপিয়ে যেহেতু সিনেমাটি নড়ে চড়ে বসতেই বাধ্য করল, তাই এর গল্প বিদেশী সিনেমা ‘কলম্বিয়ানা’র ছায়া অবলম্বনে হলেও তা নিয়ে আমার তেমন কোন আপত্তি নেই।
‘অগ্নি’কে ডিজিটাল, এ্যাকশনধর্মী নারীপ্রধান (তথাকথিত) একটি সিনেমা বলা চলে। ‘গ্লাসটি অর্ধেক ভর্তি’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লিখতে বসলেও প্রথমেই ‘তথাকথিত’ শব্দটির ব্যাখা করে নিতে চাই। সিনেমার মূল চরিত্র মাহি ( সিনেমায় তানিশা)।
তানিশা তার বাবা-মায়ের হত্যাকারীদের হত্যা করার জন্য পূর্বকৌশল হিসেবে নিজের দেহের প্রলোভন বা ধর্ষণের প্রলোভন দেখায়। এরপর হত্যা। এভাবেই সে ৪-৫টি হত্যার প্রতিশোধ নেয়। প্রশ্ন জাগে, পরিচালক কি একজন পুরুষপ্রধান চলচ্চিত্রে হত্যার প্রতিশোধ নিতে এ ধরনের কৌশলের কথা ভাবতে পারতেন? এ সীমাবদ্ধতায় আটকে না রেখে নারীকে কি আরও অধিক শক্তিধর ভূমিকায় দেখানো যেতো না। সুসান ব্রাউনমিলার তার ‘এগেন্সড্ হার উইল’ গ্রন্থে বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি, আদিমকাল থেকে এখন পর্যন্ত ধর্ষণ একটি সূক্ষ ভূমিকা পালন করছে। এটা জুজুর ভয় দেখানোর প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই না, যার মাধ্যমে সকল পুরুষ ভীতিজনক পরিস্থিতি সঞ্চার করে নারীকে বশে রাখে।”( ব্রাউন মিলার ১৯৭৫, উদ্বৃত যোগাযোগ সংখ্যা ১১, পৃষ্ঠা ৯৪)।
ব্রাউনমিলারের উল্লেখিত এ প্রথম লাইনটি এ সিনেমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে দ্বিতীয় লাইনটির ব্যাখা এ সিনেমায় কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। এখানে ধর্ষণের প্রলোভনকে হত্যার পূর্বকৌশল হিসেবে দেখানো হয়েছে।
হাস্যরসের জোগানও কোন অংশে কম হয়নি, কখনো হয়েছে হাস্যতামাশাও। ড্রাগনের (আরেফিন শুভ) মামা, মামীর কান্ড-কারখানা আমাকে ভালই হাসিয়েছে। যদিও হাসিটা আমার একটু বেশিই। হাসতে হাসতে মনে হয় মরতে বসেছি অবস্থা, আরেফিন শুভর প্রপোজ দেয়ার পূর্বপ্রস্তুতির দৃশ্যটুকু দেখে। বস্ শুভ বরাবরের মতো এ সিনেমায়ও অসধারাণ অভিনয় প্রতিভা দেখিয়েছে। কিন্তু পরিচালকের তৈরি এ ড্রাগনের কর্মকান্ড প্রায়শই আমায় হতাশ করেছে। তিনবারের বক্সার চ্যাম্পিয়ন ড্রাগনের দায়িত্ব ছিল, আয়নালদের (মিশা সওদাগর, আলী রাজ সহ অন্যান্য) নিরাপত্তা দেয়া আর হত্যাকারী তানিশাকে খুজে বের করা। বেচারা ড্রাগন হিল জুতা সহকারে দৌড়ানো মাহিকে দৌড়ে ধরতে তো পারেই না, কখনো এ বোঁকা ড্রাগন মাহীর সহজ কৌশলকেও ধরতে পারে না। তবে এটা আমার বোধগম্য হল না, মাহী যেখানে ১০-১২ জনকে একাই ঘায়েল করছে, তখন কেন প্রথম দেখাতেই ড্রাগনকে দেখে পালাতে উদ্যত হয়। এটা কি পরিচালক প্রথমেই স্পষ্ট করতে পারতেন না।
বোঁকাকে আর কত ধোঁকা। সিনেমার এক পর্যায়ে তো দেখতেই হল ড্রাগনের পাসওয়ার্ড দেয়া নোটবুক কোন জাদুকরী শক্তিতে তানিশা খুলে গোপন আস্তানার ঠিকানা নিয়ে নেয়। শেষ পর্যন্ত ড্রাগনের কাছে তানিশার গোপন পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। তানিশা ফিরে যায় ফ্ল্যাশব্যাকে, তার বাবার ব্যবসায়িক পার্টনাররা তার বাবা- মাকে হত্যা করে। বাবার থেকে প্রাপ্ত ব্যবসায়িক পার্টনারদের গোপন রেকর্ড নিয়ে যায় পুলিশ অফিসার আয়নালের কাছে, কিন্তু আয়নালও হত্যাকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে তানিশাকে তাদের হাতে তুলে দিতে চায়। ততক্ষণে তানিশা পালিয়ে ওর মামার কাছে চলে আসে। এ দৃশ্যে দেখলাম, আয়নাল তানিশার সামনেই ফোনে বলছে, ওকে ভুলিয়ে, ফুলিয়ে- ফাঁসিয়ে আপনাদের হাতে তুলে দেব। পুলিশটার আর এ বোকাঁ আচরণে আমি বোকাঁ বনে গেলাম। যাহোক, তানিশার মামা তানিশাকে সুপ্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলে। আর তানিশা তার বাবা -মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই এ পথে আসা।
অগ্নি সিনেমায় দেখি, মাহি (তানিশা) আরেফিন শুভর ( শিশির) সাথে কৌশলের অংশ হিসেবে শিশুসুলভ আচরণ করে। অস্ত্র দেখলেই ভয় পায়। শিশির তানিশার প্রেমে পড়ে যায়। এদিকে আয়নাল যখন জানতে পারে শিশির তানিশাকে ভালবাসে, তখন আয়নালের লোকজন শিশিরকে হত্যা করতে এসে শিশিরের সবচেয়ে কাছের মামা-মামীকে হত্যা করে। আর আয়নালরা তখন একই সাথে তানিশা আর শিশির দুজনের টার্গেট হয়। আয়নালরা তানিশাকে আটক করলে, শিশিরও তার মামা-মামীর হত্যার প্রতিশোধ নিতে সেখানে এসে হাজির হয়। দুজনের হাতে অবসান ঘটে আয়নালদের। শেষ দৃশ্যে পরিচালকের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করার মতো। প্রচলিত সিনেমাগুলোতে শেষ দৃশ্যে দেখি নায়ক রক্ষাকর্তার ভূমিকায় নায়িকাকে উদ্ধার করে। এ সিনেমায় পরিচালক বলতে চেয়েছে, নায়িকা আসলে আটক হয়নি, সে গোপন আস্তানা বের করতেই কৌশলে এখানে এসেছে আর নায়কও নায়িকাকে উদ্ধার করতে নয়, মামা-মামীর হত্যার প্রতিশোধ নিতেই এখানে এসেছে। চিরাচরিত নিয়ম (নায়ক নায়িকাকে উদ্ধার করবে) ভাঙতে পরিচালকের বিচক্ষণতা ইতিবাচক ছিল বলেই মনে হয়েছে।
সবমিলিয়ে অগ্নির প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতা, গান, নারীপ্রধান করার প্রচেষ্টা সব ছাপিয়ে দর্শকমুখ টেনে আনার সফল এক প্রয়াস। ভাবছি, অগ্নি দেখার জন্য আরও একবার হলে যাবো। তবে আমার অস্থির লেখা আর এলোমেলো বর্ণনা যেন সিনেমাটির প্রতি হলমুখী দর্শকদের কোনভাবেই অনাগ্রহ তৈরি না করে সে প্রত্যাশাই রইল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:০৫