বন্ধুদের একটা সার্কল! সবাই মিলে ওরা সাত জন।
এদের মধ্যে পাঁচজন ছেলে দুইজন মেয়ে, মেডিক্যাল সায়েন্সে পড়ছে। ফার্স্ট ইয়ার।
ছেলে বন্ধুদের মধ্যে কেউ একজন জ্বীন! তবে এটা বাকি ছয়জন বন্ধুর অজানা।
হিশাম নামের ছেলেটাকে বেশ ফুর্তিতে থাকতে দেখা যায় সব সময়।
সকল বন্ধুদের ও মাতিয়ে রাখে আনন্দে। Rap গান শোনে, থ্রি কুয়ার্টার প্যান্ট এর সাথে সাদা টি-শার্ট পড়ে।
এমনকি তাকে পান খেতেও দেখা গেছে!
হাসি আনন্দ আর গানের সুরে সুন্দর সময় কাটে ওদের।
কলেজের পাশে সুন্দর একটা বাগান আছে, সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়ানো সে বাগানের পুরো মাঠ।
শায়ান ভালো গীটার বাঁজায়,ফার্নান গান করে, হিশাম এমনভাবে ড্যান্স করে যেন ওদের গানকে ব্যঙ্গ করছে।
সবাই আনন্দ পেয়ে হাত তালি দেয়, হইচই করে।
একটা হলো গানের আনন্দ আরেকটা হলো হিশামের ফানের আনন্দ!
ওদের সার্কলকে অন্যরা জিলাস করে, ওরা এসব নিয়ে একদমই মাথা ঘামায় না।
ওরা বেশ শপিং প্রিয়, একটা কলম কিনতে গেলেও দল বেঁধে সবাই যায়।
অরোরা নামে মেয়েটা বেশ ফ্যাশন সচেতন, চোখটা তার দারুণ সুন্দর, মিষ্টি কন্ঠ,
বেশি কথা বলে না। অধিকাংশ সময় চুপচাপ থাকতে দেখা যায়।
নাহিন বেশ পড়ুয়া স্টুডেন্ট চোখে তার ভারী লেন্স এর চশমা।
জিমি বেশ দূর্দান্ত জ্ঞানী একটা ছেলে, নতুন নতুন আইডিয়া তার মাথায় সব সময় ঘুরপাক খায়।
যে কোন সমস্যার সমাধান চট করে বের করে ফেলে।
ইওনা মেয়েটা খুব চঞ্চল, এমন ভাবে হাসে যেন সারাদিন শুধু হাসিটাই তার প্রধান কাজ।
স্টাডির সাথে তাদের নেগোসিয়েশন নেই, আগে পড়া তারপর সব।
রুটিনবদ্ধ হয়েও তারা স্বাধীনভাবে আনন্দময় দিন পার করে। এমন করেই চলছে তাদের দিনক্ষণ।
চলতে চলতে হিশামের সাথে কেমন করে যেন ইওনার প্রেম হয়ে যায়, শুরু হয় রোম্যান্স।
উরন্তমনা ছেলের সাথে দূরন্ত মেয়ের লাভ রিলেশান বলে কথা।
বন্ধুদের ঠাট্টা বা পিঞ্চে তাদের কিছুই হয়না কানকথা-প্রুফ প্রাণিতে পরিণত হয়েছে এই দুজন।
বন্ধুরা মিলে ওদের সেলেব্রেট করলো বেশ জাকজমকভাবে।
মাঝে মাঝেই চাইনিজ, থাই, ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টে পার্টির মত করে আড্ডা চলে ওদের।
প্রতি রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ছুটির দিন ওরা লাঞ্চ শেষ করেই বেরিয়ে পড়ে প্রকৃতির সন্ধানে।
দূর-দূরান্তে চলে যায় নাহিনদের মাইক্রোবাসে করে।
বন্ধু-মহলে এমন কেমিস্ট্রি চলতে লাগলো।
কিন্তু একদিন ভাগ্য খারাপ।
ইওনার বাসায় জেনে গেছে হিশামের সাথে সম্পর্কের কথা।
মোবাইল সিজড, ইন্টারনে ডিসকানেক্টেড।
ইওনাদের বাসার গেইটে গার্ড রাখা।
গার্ডকে বলে দেয়া হয়েছে যে, অপরিচিত কোন মানুষ যেন কোনভাবেই ভেতরে ঢুকতে না পারে।
এমন কি কোন জিনিসও ইওনার বাবার অনুমতি ছাড়া ঢুকতে পারবে না।
বাসা থেকে বের হওয়া ইওনার সম্পূর্ণভাবে নিষেধ।
হিশাম খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, তার জন্য মেয়েটি কত কস্টই না পাচ্ছে।
একটা পাখিকে খাচায় বন্দী রাখলে যেমন কষ্ট পায় তেমনি করে মেয়ে টা কষ্ট পাচ্ছে।
-এই ভাবনা গুলো ছেলেটিকে ব্যাথাতুর করে দিলো।
আনন্দে মাতিয়ে রাখে যে ছেলেটা সেই চুপসে গেলো,
যে সবাইকে আনন্দে উতসাহ যোগাতো তাকেই এখন অন্যরা সান্ত্বনা দেয়।
হিশাম ইওনাকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি লিখলো, যার ভাবার্থ এমন
"তোমার বাবা মা যদি আমাদের সম্পর্ক না মেনে নেন তাহলে আমাদের আলাদা হয়ে চলাই ভালো।
বাসায় তোমাকে যেমন বকা, শাসন আর প্রেশারের উপর রেখেছে তার চেয়ে তোমার বাবা মাকে বলে দাও যে,
আমার সাথে তুমি আর সম্পর্ক রাখছো না। যাতে করে তোমায় আর খাচায় বন্দি থেকে কস্ট পোহাতে না হয়।"
চিঠি পকেটে করে হিশাম ঘোরাঘুরি করে কিন্তু পৌঁছে দেয়ার সব পথই যে বন্ধ...
ছেলেটার ভীষণ মন খারাপ, কোন যোগাযোগ নেই, মনভর্তি চাপা আর্তনাদ, নিরব হাহাকার আর নিভৃত যন্ত্রণা..
চিঠিটা দেয়ার খুব প্রয়োজন বোধ করছে ও।
সামনে প্রফেশনাল এক্সাম, মেয়েটাকে তার বাবা মা পড়ালেখাই বন্ধ করে দেবে নাকি?
কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। ফ্রেন্ড সার্কলজুড়েই একধরণের বোবা কান্নার মত শোক।
সবাই মিলে যতই প্ল্যান করছে সবকিছুর ফলাফল হচ্ছে শূণ্য।
হঠাৎ একদিন ছেলেটার চিঠি হারিয়ে গেল ..
ওদিকে মেয়েটার মন ভালো নেই, পড়ার টেবিল থেকে বই ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে মানসিক অসহ্য যন্ত্রণা থেকে।
কয়েকটার পর আরো একটা বই ছুড়ে মারতেই বইয়ের পেইজের ভেতর থেকে লাল রঙের একটা কাগজ বেরিয়ে এলো।
ইওনা একটু অবাক হলো, এই টাইপের কোন কাগজ তো সে কোন বইয়ের ভেতর রাখেনি কখনো।
এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিলো কাগজটি, সে আবিষ্কার করলো যে এটা একটা চিঠি।
হাতের লেখা দেখে চিনতে ভুল হল না, হিশামের লিখা।
অদ্ভুৎ ব্যাপার, চিঠিটা কে দিয়ে গেল ? কাজের বুয় কি?
চিঠি পড়লো ইওনা। পড়তে পড়তে দুচোখ বেয়ে জলধারা গড়িয়ে পড়ছে তার।
অনেক ভাবনা চিন্তা করলো নিজে নিজে। মনটা তার পাল্টে গেল।
কিছুদিন পর মেয়েটা তার বাবা মার কথা মত চলতে রাজি হল।
বাসা থেকে অনুমতি পেয়ে বহুদিন পর কলেজে এলো সে।
ক্লাস করছে নির্লিপ্তভাবে, কারো সাথে কোন কথা নেই।
চিঠিতে কি লেখা ছিল তা হিশাম বন্ধুদের জানায়নি কখনো।
ইওনা চিঠি পড়ে ভেবে নিয়েছিলো যে হিশাম তার সাথে ফেইক রিলেশন করেছে,
তা না হলে সম্পর্ক না রাখার এমন চিঠি দিতে পারে?
একদিন হিশাম ক্লাস শেষে ইওনাকে পেছন থেকে ডাকলো, ও শুনলো না।
হিশাম দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ইওনার হাত ধরলো।
ইওনা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হিশামকে অনেক ব্লেইম করলো। বলল কোন প্রকার যোগাযোগ না করতে,
এমনকি কথা বলতেও নিষেধ করে দিলো।
হিশাম বুঝে উঠতে পারছে না যে আসলে কি ঘটেছে।
মেয়েটার ভেতর আরো ঘৃনা বাসা বাঁধলো। মনে মনে ভাবলো ফেইক রিলেশন করেছে, আবার এসেছে ভাব দেখাতে!
এরপর থেকে ইওনা হিশামকে দেখলেই অন্য পথে ঘুরে যায়। তাদের পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলেই একটা ভজঘট পাকিয়ে গেল।
চিঠিটা কে দিলো এই প্রশ্নটাই সবার ভেতর।
চিঠি প্রেরকের প্রতি সবার একটা ক্ষোভ কাজ করছে।
কেউ ভেবে বের করতে পারছেনা যে চিঠিটা কিভাবে গেল মেয়েটার কাছে।
এমন মূহুর্তে ওদের মধ্যে একটি বন্ধু অন্যদের চেয়ে আরো ভীষণভাবে অনুতপ্ত হলো।
সে বলল, আমি জানি কে চিঠিটা দিয়েছে, তবে একথা প্রকাশ করা হলে তার ভিষণ বিপদ হবে।
যে দিয়েছে তার ফ্যামিলি তাকে দূরে নিয়ে যাবে, আর কোনদিন আসতে দেবে না। আর এটাই তাদের ফ্যামিলির নিয়ম।
সে বন্ধুটা পরেরদিন সবাইকে একত্রে জড়ো করলো, কলেজের বাইরে এক রাস্তার পাশে।
রাস্তার পরেই বিশাল মাঠ, দূরে গাছ-গাছালী নীল আকাশের সাথে মিশে গেছে।
জিমি বলল : আমি তোমাদের বন্ধু, আমি ওদের উপকার করার জন্য নিজেই এই চিঠি টা পৌঁছে দিয়েছি।
বন্ধুরা একে অপরের মুখের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কয়েকবার তাকালো। এটা কি করে সম্ভব?
তা ছাড়া মেয়েটা চিঠি পেয়েছে তার বইয়ের ভাঁজে!
মেয়ের রুমে তো দূরের কথা বাসার ভেতরেই তো কোন ভাবেই যাওয়া সম্ভব না।
তখন ছেলেটি বললো, আমি আসলে তোমাদের মতই দেখতে, কিন্তু আমি সত্যিকারের মানুষ নই, আমি জ্বীন!
সবাই সমস্বরে হো হো করে হেসে উঠলো ..
কেউ বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করলো না।
বন্ধুরা বলল এই যুগে কেউ জ্বীন ভুতে বিশ্বাস করে গাধা? ফান করছিস আমাদের সাথে এই সিরিয়াস মূহুর্তেও?
আচ্ছা তুই জ্বীন হয়ে থাকলে উড়ে দেখা তো?
জিমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে, তার চেহারা চিন্তগ্রস্থ দেখাচ্ছে।
তারপর সে সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা দিলো এবং প্রমাণ করে দেখালো যে জ্বীন সত্যিই আছে।
তার ব্যাখ্যার সারমর্ম এমন, জ্বীন হলো আগুনের তৈরি, আগুন হচ্ছে তাপ। তাপ যে কোন পদার্থেই প্রবেশ করতে পারে।
যে পাত্রে তাপ প্রবেশ করে তাপ সে পাত্রেরই আকার ধারণ করতে পারে।
যেমন একটা চামচ আগুনে ধরলে সম্পূর্ণ চামচ গরম হয়ে যায়। ফ্রাই প্যান আগুনে রাখলে তাও সম্পূর্ণটা গরম হয়।
যে পদার্থে তাপ/ আগুন প্রবেশ করে, সেই পদার্থের শেইপটাই তাপ/ আগুন পেয়ে যায়।
তেমনি জ্বীন আগুনের তৈরি হওয়ায় তারা অন্যদের শরীরেও প্রবেশ করতে পারে। তাদের আকার ধারন করতে পারে।
জ্বীন যেহেতু প্রাণি, তাদের প্রান আছে , সেহেতু তারা করো শরীরে প্রবেশ না করেও যে কোন আকৃতি ধারণ করতে পারে। প্রয়জনে মানুষেরর ছদ্মবেশ ধারণ করে।
তার কথায় লজিক খুজে পেলো সবাই। হাইপোথিসিসে প্রমাণ হলো যে জ্বীন এর এক্সিস্টেন্স আছে।
ছেলেটা আরো বলল যে, মানুষের মতই মানুষের আশে পাশে অসংখ্য জ্বীন বসবাস করে
স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে পড়ে। অফিস করে, আদালতে প্র্যাক্টিস করে, চিকিৎসকও আছেন। কিন্তু মানুষ তাদেরকে নিজেদের মত মানুষ ভেবে ভুল করে।
বললঃ শুধু সাধারণ মানুষই নয় আমি স্টার সেলিব্রেটি, এ্যাক্টর-এ্যাক্ট্রেস, সঙ্গীত শিল্পিদের মধ্যেও অনেক জ্বীনকে চিনি, তারা মানুষের বেশেই থাকে।
আসলে মানুষ নয় তারা জ্বীন। প্রাইভেসি রক্ষার্থে আমি তাদের নাম বলছি না। জ্বীনদের আদম শুমারিতেও গণনা করা হয়।
আশে পাশে থেকে অনেক মানুষের জটলা বেধেছে সেখানে।
এরপর জ্বিনটার কাছে একটা ফোন আসলো.. সম্ভবত তার ফ্যামিলি থেকে।
কথা বলতে বলতে তার গলা জড়িয়ে এসেছে আর দুচোখে জল গড়িয়ে পড়ছে।
কিছুক্ষন পড় চোখ মুছে তাকালো ছেলেটা, তার চোখ টলটলে জলে ভরা, টকটকে লাল।
সবাই একটু ভয় পাচ্ছে, জ্বীন বলে কথা। সবাই একটু নড়েচড়ে সরে দাড়ালো।
কেউ বুঝে ওঠার আগেই হঠাত জ্বিনটা মানুষের ভীড়ের মধ্যে খানিকটা ফাঁক পেয়ে দ্রুত পাশের মাঠে নেমে পড়লো।
নেমেই সে দৌড় শুরু করেছে।
মাঠের মাঝখানে গিয়ে সে সবাইকে আশ্চর্যান্বিত করে হাওয়াও মিলিয়ে গেল।
সবার মুখ তখন হা.. বন্ধুদের অতর্কিতভাবে মন খারাপ হয়ে গেল।
সবাই বুঝতে পারলো যে তার ফ্যামিলি থেকে তাকে হয়তো চলে যেতে বলেছে, প্রাইভেসি রক্ষার্থে।নিশ্চয়ই কোনদিন আর ফিরবে না।
সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হলো অরোরার।
ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেঁয়ে। হুট করে সাবার থেকে দূরে সরে এলো সে।
রিকশা করে বাসায় ফিরে গেলো, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো।
শুয়ে শুয়ে নিরবে কান্না করছে। মেয়েটি তখন জিমিকে গভীরভাবে ফিল করছে।
সে রিয়ালাইজ করলো যে,ওই ছেলেটার প্রতি নিজের অজান্তেই তার গভীর ভালোবাসা ছিলো।
কান্না চোখে ঘুমিয়ে গেল। সুন্দর এক স্বপ্ন দেখলো সে।
জিমি ফিরে এসেছে, সবাই আগের মতই হই হুল্লোড়, জমজমাট আনন্দ উল্লাস করে কক্স'স বাজার যাচ্ছে।
কক্স'স বাজারে পৌঁছে মেয়েটা জিমির হাত ধরে সমূদ্র সৈকতে পা ভিজিয়ে হাটছে ..
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৪৬