১৯৭১ সাল একটি ভয়াবহ দানবের মত এদেশের বুকে চেপে বসেছিল। তখনকার সময়ে যেসব বাঙ্গালী রাজাকার নাম নিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ চালিয়েছে তাদের বিচার দুইশত বছর পরে হলেও হতে হবে। আর যেসব নরপশু বাঙ্গালী হয়েও খেটে খাওয়া মানুষের উপর নির্যাতন চালিয়ে এখন জীবিত নেই তাদের বিচার আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম।
৭১ এ আমার বাবা ছিলেন নিরুদ্দেশ, আমার বৃদ্ধ দাদা চারজন নাতী নাতনী নিয়ে মাদারিপুরের গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। আমার মা দাদীরা রোজা থেকেছেন বঙ্গবন্ধুর শুভ কামনায়। পাকিস্থানীরা যেন তাঁর কোন ক্ষতি করতে না পারে এটাই তাঁদের প্রধান চাওয়া। সেইদিন গুলো কেমন ছিল আসলে যারা উপস্থিত ছিল তাঁরাই অনুভব করতে পারে। আর আমরা যারা গল্প শুনি তাঁদের সেই অনুভুতিটা আসেনা। যেসব নেতারা ভারতে পালিয়ে থেকেছেন তাঁরাও সেইদিনটা কেমন ছিল বলতে পারবেনা। আসলে বাঙ্গালীরা একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল ৭১ এর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে। এরই মাঝে আশেপাশের অতি পরিচিত মানুষজন রাজাকার নাম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়! রাজাকারেরা আমাদের বাসায় এসে দাদাকে বিভিন্ন হুমকি ধামকি দিয়ে যায়। কি মোল্লা তোমার ছেলে নাকি অস্ত্র নিয়ে সেনা ব্যারাক থেকে পালিয়েছে? মজা বুঝবা দাড়াও...!! বৃদ্ধ মানুষ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারেনা। তাঁরা পুত্র বেঁচে আছে কিনা সেটাও জানেনা।
একদিন খবর পেল আমাদের জমির সব ধান কেটে নিয়ে গেছে রাজাকারেরা! কিছুই করার নেই, নিজ বাসায় খাবার সঙ্কটের সময় এই ধানের কথা ভেবেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন। দুই একদিনের ভিতর কাটবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তারপর একদিন আমাদের কাচারি ঘরের চালের টিন খুলে নিয়ে গেল প্রকাশ্যে। কিছু বলতে গেলেই, বেশি কথা বইলোনা মোল্লা। তোমার ছেলে কিন্তু মুক্তি হইছে। তুমি আপনজন তাই পাকিস্থানী সেনাদের এখনও সেই খবর দিইনি। এটাই তোমার ভাগ্য। দাদাও তাঁর সুন্দর ভাগ্য মেনে নিয়ে চুপচাপ থাকে।
বাসায় কোন চাল নেই, ভাত রান্না হচ্ছেনা চারদিন ধরে। ঘরের চালে লাউ গাছে প্রচুর লাউ ধরেছিল সেবার। আর আছে নিজের পালন করা দুধ দেওয়া গরু। চারদিন ধরে বাসার সদস্যরা দুধকদু রান্না করে খাচ্ছে। বাসার বাচ্চারা এখন বিরক্ত প্রতিদিন এই মিষ্টি জিনিস খেতে খেতে। দাদী একদিন দাদাকে বললো, কিছু লাউ আর ঐ গাছের পাকা কলা নিয়ে একটু বাজারে যেয়ে দেখোনা! যদি বিক্রি করে কিছু চাল আনতে পারো! বাচ্চাদের কান্না আর দেখা যায়না! এগুলো বিক্রি করতে গেলে তোমার ইজ্জত চলে যাবেনা, আগে জীবন বাঁচাও। আমার দাদী শিক্ষিত মহিলা ছিলেন। দাদীর কথায় তিনি বাজারের দিকে রওনা দিলেন। পথে দেখা হয়ে গেল টিএনওর সাথে। দাদাকে দেখেই বলে উঠলো, কি মোল্লা সাহেব! আপনার ছেলে কোথায়? আমি জানিনা বাবা, উত্তর দিলেন দাদা। হাতে এইগুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? আমরা খাওয়ার কিছু পাচ্ছিনা আর আপনি তো দেখি সুখেই আছেন! এগুলো এখানে রেখে চুপচাপ কেটে পড়েন...
আমার বাবা ও সঙ্গীরা যখন টেকেরহাট ব্রিজের যুদ্ধ জয় করে নিজ এলাকায় ঢুকেন সেদিন এই রাজাকার টি.এন.ও সবার আগে অভিনন্দন জানাতে সামনে এগিয়ে এসেছিল। এই রাজাকারের বিচার সেদিন আমার পিতাই করেছিলেন।
সেইদিন যারা লুটতরাজ, বিনা অপরাধে হত্যাকান্ড চালিয়েছিল তাঁদের বিচার অবশ্যই হওয়া উচিৎ। এই বিচারকার্য পরিচালনা করার জন্য যোগ্যবান কিছু লোকের দরকার ছিল। বর্তমান পরিচালিত মানবতাবিরোধী ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়া এমন ত্রুটিপূর্ণ কিছু বিষয় এসেছে যেটাকে অনেকে বিচার না বলে হত্যাকান্ড বলতে প্রয়াস পাচ্ছে। আমরা হত্যাকান্ড চাইনা, আমরা অপরাধীর বিচার চাই। শুরুতেই স্কাইপি ক্যালেংকারীতে প্রকাশ হয়ে যায়, শুনানী যাই হোক রায় একটা দিয়ে দাও! সাক্ষী আছে কি নেই এইসব দেখার দরকার নেই! এটাকে বিচার বলেনা, এটা পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড ...
এরপর যেকয়জনের বিচারের রায় বাস্তবায়ন হয়েছে তাঁর প্রতিটা ছিল বিতর্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ। যেমন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্থানী এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যয়ন পত্র জমা দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছেন ৭১ এ তিনি এদেশেই ছিলেন না। তাঁর বাবা এখানে থাকলেও তিনি পাকিস্থানে লেখাপড়া করায় সেখানে ছিলেন। বিচারপতি সাহেব তাঁর প্রত্যয়ন পত্র নাড়াচাড়া করে বললেন, এটাকে ভুয়া মনে হচ্ছে। সুতরাং ঝুলিয়ে দেওয়া হোক। আমার প্রশ্ন হলো এমন একটা জনদাবির বিচারে কেন আমি প্রশ্ন রাখার সুযোগ দিবো? বিচারপতি যদি সার্টিফিকেট বিশারদ হয়ে যান তাইলে তো সমস্যা। এই সার্টিফিকেট জাল এটা প্রমানের অনেক উপায় ছিল। সরকার পাকিস্থানী দুতাবাস মারফত সরাসরি ভার্সিটি থেকে প্রত্যয়ন পত্রের খোঁজ নিতে পারতো। এতে হয়তো ফাঁসিটা দুদিন পরে হতো। তাতে সমস্যা কোথায়? আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তাঁরাও মনে শান্তি পেতাম। হাজারও ছলচাতুরী করেও সাকা শেষ রক্ষা পায়নি। এখন কি হচ্ছে? মনের ভিতর প্রশ্ন আসছে সাকাকে কি আমরা খুন করলাম? আর সার্টিফিকেট মিথ্যা প্রমান করে ফাঁসি দেওয়া হলে বুক উচা হয়ে বলতাম অপরাধীর শাস্তি হয়েছে আজ।
আজ লেখাটা লিখতে বসেছি মতিউর রহমান নিজামীর শুনানীর খবর দেখে। সেখানেও সরকারের আনাড়ী লোকের কর্মকাণ্ড দেখে বিরক্ত লাগছে। তারপরেও তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হবে তারপর আমাদের খাওয়ানো হবে আমরা বিচার করেছি। নিজামীর মামলায় এমন কিছু স্বাক্ষী হাজির করা হয়েছে তাদেরকে আমার কাছে দুমুখো সাপ বলে মনে হচ্ছে। একেক যায়গায় একেক ধরনের কথা বলে তারা সুন্দর একটা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিচ্ছে। টাকা খাওয়া স্বাক্ষী না এনে ঘটনার প্রক্রিত স্বাক্ষীদের হাজির করা হলে এমন পরিস্থিতির হাজির হতোনা।
আজ মাওলানা নিজামীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন আইনজীবী এসএম শাহজাহান। তিনি আদালতে বলেন, এ মামলার প্রথম অভিযোগ মাওলানা কসিমউদ্দিন হত্যাকাণ্ড। এই অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রসিকিউশনের চতুর্থ সাক্ষী হাবিবুর রহমান বলেছে কসিমউদ্দিনের ছেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিবলী তাকে বলেছে মাওলানা নিজামী তার বাবার হত্যার সাথে জড়িত। অথচ এই শিবলী বলেছে হাবিবুর রহমানের সাথে তার পরিচয় নেই। সে আরো বলেছে তার বাবাকে নিজামী মেরেছে এটা সে বলেনি।
এছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগের সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে যে অভিযোগ করেছে তা মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তার কাছে বলেনি।
মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ হলো পাবনার সাঁথিয়ার গণহত্যা। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এসএম শাহজাহান আদালতে বলেন, এই অভিযোগে প্রসিকিউশনের চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছে। এরমধ্যে একমাত্র নবম সাক্ষী আইনুল হক ঘটনা দেখার কথা বলেছে। তবে তার দেখার কথা মামলার শুরুতে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীতে বলেননি। ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী দেয়ার সময় প্রথম বলেছেন। এজন্য তার কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই অভিযোগে প্রসিকিউশনের ১১তম সাক্ষী এডভোকেট শামসুল হক নান্নুর একটি ভিডিও টেপ ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। ওই ভিডিও টেপে নান্নু বলেছেন, ১৯৭১ সালে তিনি মাওলানা নিজামীকে দেখেননি। সাঁথিয়ার গণহত্যার ঘটনার সাথে নিজামী জড়িত এটা সে দেখেনি। এছাড়া এই অভিযোগের রাষ্ট্রপক্ষের ১৭ ও ১৮তম সাক্ষী শোনা সাক্ষী, তারা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীতে মাওলানা নিজামীর জড়িত থাকার কথা বলেননি।
তৃতীয় অভিযোগের বিষয়ে এসএম শাহজাহান বলেন, মামলার তৃতীয় অভিযোগে দুইজন সাক্ষী বিচ্ছু জালাল এবং রোস্তম আলীর জবানবন্দীর মধ্যে গরমিল রয়েছে। বিচ্ছু জালাল বলেছে, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ঘটনা রোস্তমের কাছ থেকে শুনেছে। আর রোস্তম বলেছে, সে তাকে বলেনি।
অপর দিকে আদালতের এক প্রশ্নের জবাবে এসএম শাহজাহান বলেন, মাওলানা নিজামীকে আলবদরের প্রধান বলা হলেও এ বিষয়ে কোন এভিডেন্স নেই।
এইসব নেই নেই করে ফাঁসি দেওয়ার ভিতর আমাদের কোন মর্যাদা নেই, সব আছে আছে করে ফাঁসি দেওয়ার ভিতর প্রানের ক্ষুধা মেটানোর তাগিদ আছে। ৭১ এ যারা হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, লুটতরাজ চালিয়েছে তাদের বিচার চাই। বিচারের নামে কোন হত্যাকাণ্ড চাইনা।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৬