গল্পটা বর্ষার কিন্তু করছি গ্রীষ্মে...করলাম না হয় অসময়ের গল্প...সুসময় কবে আসবে সেই আশায় না থেকে...
চারদিকে থইথই পানি...পানির মাঝখানে জেগে থাকা ছোট ছোট গ্রামগুলোকে দ্বীপের মতো মনে হয়...বিদ্যুত নেই...সন্ধ্যে হলেই হারিকনের আলো আর কুপিই ভরসা...চুপচাপ কান পেতে বসে থাকলে হাওরের দিক থেকে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দটা কানে আসে...ভারী আনন্দ হয় তখন...ভেজা মাটি আর পঁচা পাতার গন্ধটাও মিষ্টি লাগে এক আধটু...
একটু অবস্থাপন্ন গেরস্থ হলে হ্যাজাকের দেখাও মিলে...বিকেলর আলো মরে এলে পাটক্ষেতে শিয়ালের করুণ সুরে কান পাতা দায়...তবে রাত গভীর হলে এই মরাকান্নাও কমে আসে...হাওরের রীতিই এমন...রাত যতো বাড়ে মায়াও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে...
আজ এ বাড়িতে গানের আসর...আমি বড় অতিথি...আমার সম্মানেই...অাসর শেষে আল্লোরার আয়োজনও আছে...আল্লোরা জানেন তো কি???না জানলেও ক্ষতি নেই...আরেকদিন লিখব এ নিয়ে...শুধু জেনে রাখুন রাতে মাছ ধরার মতো একটা ব্যাপার স্যাপার আরকি...
অবস্থাপন্ন গেরস্থ বাড়ি...উঠোনে পাঁচটা হারিকেন একটা হ্যাজাক...তবে অন্ধকার দূর হয়নি...গাইয়ে দলের চারপাশে জ্বলছে এগুলো...হারিকেনের মরা হলদে আলো আর হ্যাজাকের উজ্জ্বল সাদা দুয়ে মিলে ঘোলাটে অন্ধকার...নাম না জানা পতঙ্গরাও ঝাঁপ দিচ্ছে খুব...আমার চোখ কিছুই এড়ায়না...
শাহ্ আব্দুল করিম দুটো গাওয়া শেষ...এবারে চলছে রাধা রমেন...এসবই আমার অনেকবার শোনা...তবুও যতোবার শুনি তৃষ্ণা মেটেনা...মূল গায়কের বয়েস বোঝা দায়...জোড়া ভ্রু পেকে সাদা ধবধবে...তুবড়ানো গাল...ষাট কিংবা সত্তরও হতে পারে বয়েস...ভাঙা জড়ানো গলায় গাইছেন গান...সুরটা কোনরকম তবে দরদ ভরা...
কেনো গো রাই ঘুরছ তুমি পাগলিনী হইয়া...লাইনটা বলেই টান দিয়েছে...সঙ্গে হাওরের দিক থেকে দমকা হাওয়া উঠল...ঠান্ডা শীতল দমকা হাওয়া...চুলের গোড়া থেকে ঠান্ডা জল ঘাড়ে গড়িয়ে পরলে যেমন অনুভূতি হয় তেমন একটা অনুভূতি...
অনুভূতিটুকু না মেলাতেই অামার পাশে বসা তরুণী খুব সন্তর্পণে সবার অলক্ষে আমার হাতটা চেপে ধরলো...এ তো রাখঢাকের প্রয়োজন ছিলো না তবুও...এ সময় গা শিরশিরে অনুভূতি জাগার কথা...কিন্তু আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো...
কারণ এ হাত চেপে ধরায় উষ্ণতা নেই...আছে বিদায়ের গন্ধ...বুক ঠেলে কান্না উঠে আসা বিশ্রী বিদায়ের সুর...আমি বুঝে গেলাম এই আমাদের শেষ...এখানেই ইতি...
আমার কখনো বুঝতে ভুল হয়নি...হবেও না...
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ রাত ৯:৩১