গল্প শুরুর আগে আমরা এমন একটা পৃথিবী বা পৃথিবীর এমন অংশ এবং সে অংশের মানুষদের কথা জেনে নেই যা আমাদের কাছে অদ্ভুত ঠেকতে পারে। গল্পে হয়তো অনেক কল্পনাও চলে আসবে, তবে গল্পে উঠে আসা পরিবেশ এবং অন্যান্য ব্যাপার বুঝতে এসব সম্পর্কে আগেভাবে কিছুটা বর্ননা করা থাকলে গল্পটা যেমনই হোক, বুঝতে কিছুটা সুবিধা হতে পারে। গল্পে উঠে আসা অন্যান্য কাল্পনিক চরিত্র, পরিবেশ এবং রীতিনীতিকেও খুব বেশি গাঁজাখুরি মনে হবে না হয়তো।
দীর্ঘ দিন এবং দীর্ঘ রাতের অঞ্চলঃ
আমাদের জন্য সুর্য উঠে পূর্বে, অস্ত যায় পশ্চিমে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন দুটা জায়গা আছে যেখানে কোনো দিক নেই। উত্তর মেরু বিন্দু থেকে আমরা যেদিকেই তাকাই, তাই দক্ষিণ। আবার দক্ষিণ মেরু বিন্দু বা কেন্দ্র থেকে আমরা যেদিকেই তাকাবো, তাই উত্তর দিক।
মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি সূর্য উদয় বা অস্ত বলে কিছু থাকে না দীর্ঘ সময়, যা আমরা পৃথিবীর কিছুটা নিম্ন অক্ষাংশে দেখতে পাই। গ্রীষ্মে সেখানে সূর্য দিগন্তের উপরে একে উঁকি দেয় এবং ৩৬০ ডিগ্রীর একটা বৃত্ত তৈরী করে হারিয়ে যায়। এজন্য প্রায় ১৮৭ দিন সময় লাগে উত্তর মেরুর ঠিক ৯০ ডিগ্রী অক্ষাংশে। শীতের সময় সূর্য দিগন্তের নিম্ন ভাগে অবস্থান নেয় এবং প্রায় ১৬৩ দিন সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে। ২৪ দিনের মত থাকে আবছা অন্ধকার, সে সময় সূর্য দিগন্তের অল্প নীচে থাকে কিন্তু গোধূলীবেলার মত আবছা আলো থাকে। উত্তর মেরুতে যখন দিন, দক্ষিণে তখন রাত। আমরা বলি সেখানে ছয়মাস দিন আর ছয় মাস রাত, এটা সম্পুর্ণ ঠিক না, তবে বলা যেতে পারে।
মধ্যরাতের সূর্য
যেমন, নরওয়ে উত্তর মেরুর খুব কাছাকাছি একটা দেশ। এই দেশের ভ্যালবার্ড, নরওয়ের সবচেয়ে উত্তরের একটা অঞ্চল যেখানে জনবসতি আছে। এখানে ১৯ শে এপ্রিল থেকে ২৩ শে আগস্ট পর্যন্ত কোনো সূর্যাস্ত দেখা যায় না। এবং ১৪ নভেম্বর থেকে ২৯ শে জানুয়ারী পর্যন্ত কোনো সূর্যোদয় ঘটে না। নিশিথ সূর্যের দেশ বলতে আমরা নরওয়েকে জানি, মধ্য রাতেও সেখানে সূর্য থাকে। কিন্তু তারা এটা বলে না, একটা সময় মধ্য দুপুরেও সূর্য থাকে না। আমাদের পৃথিবীটা এমনই অদ্ভুত।
এর কারণ হচ্ছে, প্রতিটি গোলার্ধ গ্রীষ্মে সূর্যের দিকে হেলে থাকে এবং শীতকালে সেখান থেকে সরে যায়। ফলে সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলে বছরের একটি বিশেষ সময় মধ্যরাতেও সূর্য দেখা যায়। শীতের সময় এ অঞ্চল দুটতে দিন আর রাতের পার্থক্য করা যায় না। কারণ, সূর্যোদয় হয় না সেখানে। আবার বিশেষ সময়ে দীর্ঘ কয়েক মাস প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টাই সূর্যালোক থাকে। নিয়ম মেনে সূর্যোদয় ঘটে এবং খুব ধীরে সরে অপরপ্রান্তে যেতে থাকে যেখানে অস্ত যাবার কথা। কিন্তু সম্পূর্ণ অস্ত না গিয়ে আবার উদয় হওয়া শুরু হয়।
চাঁদ একটা জটিল জিনিস। সৌন্দর্য্যে এবং নিজের কক্ষের আবর্তনেও। চাঁদ তার নিয়মমতই আসে আর যায়। তার আচরণ পৃথিবীর সব প্রান্তেই প্রায় একই রকম।
সেই বরফের দেশের অদ্ভুত মানুষদের দেশ এবং আচার আচরণের কিছু তথ্যঃ
চির বরফের দেশঃ
পৃথিবীর এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে সারা বছরই তাপমাত্রা থাকে শুন্যের নীচে। সারা বছরই বরফ পড়তে থাকে। নানা বড় আকারের উদ্ভিদ বাদে অন্যান্য লতা পাতা ফুল বরফের স্তর সরে যাওয়া জমিতে স্বল্প সময়ের গ্রীষ্মকালে দেখা যায়। তবে ফলের গাছ তখনো প্রায় থাকে না বললেই চলে। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মত শস্য আবাদ হয় না সেখানে। সে কারণে তাদের খাদ্য তালিকার ৯০ ভাগের বেশিই থাকে প্রানীজ আমিষ, চর্বি, মাছ, পাখির ডিম এবং এমন খাবার।
বরফের তৈরী ঘরঃ
বরফের তৈরী করে কিভাবে থাকা যায় আমাদের কাছে অসম্ভব কল্পনা। কিন্তু তুষারের তাপ কুপরিবাহী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার কারণে বাইরে তীব্র শীত থাকলেও ভেতরে সেই শীতলতা থাকে না। নিঃস্বাসের, প্রজ্জ্বলিত আগুনের, মানুষের শরীরের উষ্ণতা রয়ে যায়। দরজাগুলো হয় ছোট, যাতে বাইরের বাতাস প্রবেশের সুযোগ একেবারে কম থাকে।
অনেকে ধারনা করেন এসব খুব ছোট ছোট হয়, আসলে তা নয়। ৩-৪ জনের থাকার মত বরফের কুঠিও তৈরী হয়, আবার ২০-৩০ জন একত্রে থাকবার মত বরএর প্রাসাদও তৈরী হয়। বরফের দেয়ালের সাথে সিলমাছ কিংবা ক্যারিবুর চামড়া মুড়ে ঘরের উষ্ণতা যাতে বরফের দেয়ালে শুষে না যায়, তার ব্যবস্থাও থাকে। পশমের বিছানা আর চাদর মুরি দিয়ে তারা নিদ্রা যায়।
নাসিকা চুম্বনঃ
এই পৃথিবীতে এমন জাতির মানুষও আছেন, যারা ভালোলাগার অনুভূতি প্রকাশের জন্য একে অপরের নাকে নাক ঘষেন। এই জাতিগুলোর বাস বরফের দেশে। তারা চুম্বনের বদলে নাকের সাথে নাক স্পর্শের এ রীতির দিকে ঝুঁকেছে তীব্র ঠান্ডার কারণে। চুম্বনের প্রচেষ্টায় মুখ খুললে হয়তো মাইনাস ২০ কিংবা মাইনাস ৩০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় তাদের মুখের লাগা খুব অল্প সময়েই জমে গিয়ে ঠোঁট জিভ জোড়া লেগে বিব্রতকর অবস্থার তৈরী হতে পারতো। কিন্তু ভালোবাসার প্রকাশ, স্পর্শের অন্যরকম ব্যক্তিগত প্রকাশ তো থেমে থাকতে পারে না।
এই নাসিকা চুম্বন কেবল নাকে নাক স্পর্শই নয়। এ সময় যুগল, কিংবা মা যখন তার সন্তানের সাথে নাকে নাক ঘষেন, তখন নাকের এই স্পর্শ মুখ্য ব্যাপার থাকে না। তারা চুল এবং চিবুকের গন্ধ শুঁকেন (মানুষের চিবুকেও গন্ধগ্রন্থি আছে)। এভাবে তারা একে অপরের কাছাকাছি আসেন এবং তাদের শরীর ঘ্রানের সাথেও পরিচিত হন।
চুম্বন হিসেবে একে স্বীকার করি আর নাই করি, তাদের কাছে এটা অন্তরঙ্গ একটা ব্যাপার যা সাধারণত সবার সামনে করা হয় না, বিশেষ করে সেইসব জাতির যুগলেরা করে না।
পরিধেয় বস্ত্রঃ
সিলমাছের চামড়ার তৈরী বুটজুতা ব্যবহার করতো তারা। শীত বেশি হলে জুতোর স্তরের সংখ্যা বেড়ে যেতো। গরমে একটি চামড়ার আবরনই ছিলো জুতো, যা তীব্র শীতে দুটি তিনটি হয়ে যেতো। একটির উপর আরেকটি। শরীরের পোষাকের উপর সিন্ধুঘোটকের দাঁত সারি সারি করে বসিয়ে হিংস প্রানী বা শত্রুর থেকে বাঁচবার বর্ম পরিধান করতো তারা। নানা প্রানীর চামড়ার পোষাক এবং পশমী ঢাকনার মত ব্যবহার করতো তারা মুখমন্ডলকে শীতের হাত থেকে বাঁচবার জন্য। তীব্র ঠান্ডায় তারা কেবলমাত্র চোখ ছাড়া বাকী সব অংশ আবৃত রাখতো সেই পশমী হুড বা ঢাকনায়। পরিধেয় পোষাকগুলো প্রস্তুত করতো নারীরা। এজন্য তারা বড় দাঁত বা হাড়ের তৈরী সুই দিয়ে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত চামড়ার টুকরো সেলাই করতো সুক্ষভাবে কেটে নেয়া চামড়া বা অন্যকিছু দিয়ে। চামড়াকে শুকিয়ে, টেনে এবং পিটিয়ে নরম করে প্রস্তুত করা হতো আরামদায়ক, হালকা এবং আরও বেশি তার কুপরিবাহী করার জন্য। পোষাকের চামড়ার নানা স্তরের মাঝে দেয়া থাকতো পশম যা শরীরের ভেতর বাতাস ধরে রেখে উষ্ণতা ধরে রাখতে খুবই কার্যকর ছিলো। আধুনিকযুগের মানুষও এত তীব্র শীত থেকে বাঁচবার জন্য তাদের মত কার্যকরী পোষাক প্রস্তুত করতে পারেনি অন্যকিছু দিয়ে। খাবার প্রস্তুত সহ পোষাক তৈরীর এ বিশেষ দক্ষতার কারনে নারীর স্থান ছিল তাদের জগতে অন্যরকম। নারী পুরুষে একমাত্র নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কিছুতে তেমন ভেদাভেদ ছিল না।
ধর্মঃ
এ গল্পে আমি একটা বিশেষ গোত্রের ধর্ম কি ছিলো তার ভিত্তিতেই গল্পে ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়গুলো আনবো। সে গোত্রের মানুষেরা বিশ্বাস করতো পরকালে। তেমন বিশেষ ধর্মীয় আচার আচরন ছিল না। তবে তারা রোমশ দেবতায় বিশ্বাস করতো। অপদেবতায়ও বিশ্বাস করতো। ডাকিনীবিদ্যাও তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল হাজার বছর ধরে। বাকী অনেক ব্যাপার (সত্য এবং কল্পনা) গল্পেই উঠে আসবে প্রয়োজনে।
অতিথি পুরুষদের কাছে স্ত্রীকে সমর্পনঃ
সেসব বরফ সাম্রাজ্যের জাতি বা গোত্রগুলোতে ঘরে অতিথি আসতে অতিথি পুরুষের জন্য নিজের স্ত্রীকে সমর্পন করার রীতি চালু ছিল। এমন না যে তা মানতেই হতো সবাইকে। তবে স্বামী তার স্ত্রীকে জোর করতে পারতো। আবার স্ত্রীর যদি স্বামীর কোন সিদ্ধান্ত বা অন্য কোনো ব্যাপারে আপত্তি থাকতো, তবে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা মানেই ডিভোর্স বা আলাদা হয়ে যাওয়া। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবার সম্পুর্ণ অধিকার নারীদের ছিল। যে রীতি আমাদের কাছে অস্বাভাবিক লাগতে পারে, হাজার বছর ধরে চলে আসবার কারণে তাদের মধ্যে ছিল তা স্বাভাবিক।
বিয়ে অনেক সময়ই তেমন ঘটা করে হয় না। জন্মের পরেই অনেক সময় সঙ্গী নির্বাচন করে দেয়া হতো। মেয়েরা ঋতুমতী হবার পর এবং ছেলেরা শিকারের সামর্থ্য সহ অন্য কিছু দক্ষতা অর্জনের পর বিয়ের উপযুক্ত হতো। পুরুষেরা বহুগামীও হতে পারতো। স্ত্রী বা সঙ্গীকে অপর পরিবারর সাথে পারস্পরিক সম্মতিতে বদলেরও রীতি ছিল। পারিবারিক বন্ধন এবং সঙ্গীর উপর পারস্পরিক নির্ভরতা তাদের বেঁচে থাকার জন্যই ছিলো খুব জরুরী।
বরফ সাম্রাজ্যের স্বর্ণকেশী গোত্রঃ
১৯১২ সালে স্টেফানসন নামের একজন অভিযাত্রী এক অদ্ভুত বরফের দেশের গোত্রের সন্ধান পান, যারা ছিলো স্বর্ণকেশী, লম্বা এবং নাক ছিলো স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের মত উন্নত। এই আবিস্কার অনেক কৌতুহলের জন্ম দেয়। বরফের দেশের নানা জাতির উপকথায় স্বর্ণকেশী মানুষদের কথাও আছে। সম্ভবত তারা কানাডিয়ান আর্কটিকে এসে আটকে পরা ভাইকিং বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অভিযাত্রীদের অংশধর হবেন যারা শত বছর ধরে সেখানে আছে। আমার গল্পের একটা প্রধান চরিত্র হবে এমনই এক গোত্রের।
খাদ্যঃ
শাকসব্জি বা উদ্ভিতজাত বা শস্যজাত খাবার ছাড়া পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশের মানুষই জীবন কল্পনা করতে পারে না। কিন্তু এমন কিছু জায়গাও পৃথিবীতে আছে যেখানে তীব্র শীত। শুধু শীতে শীত না, সারাবছরই অলিখিত শীত। সেখানের মানুষগুলো কেবল নানা প্রকার মাংস খেয়েই বেঁচে থাকে। গ্রীষকালীন সময়ে কিছু আঙ্গুর কিংবা সামুদ্রিক আগাছা জাতীয় খাবার তারা খায়, তবে সেটা নামে মাত্রই। তীব্র শীতের সময় তাদের খাদ্যের ৬০-৭০% থাকে চর্বি জাতীয় খাবার। কেবল প্রানীজ আমিষ এবং চর্বির উপর নির্ভর করে তারা বেঁচে থাকে। কিন্তু অলৌকিকভাবে তাদেরই পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্থ্য মানুষ হিসেবে গন্য করা হয়। বিজ্ঞানীদের কাছেও এটা বিষ্ময়ের। তারা সিলমাছ, সিন্ধুঘোটক, তিমির মাংস, মেরু ভাল্লুক, শেয়ালের মাংস সহ নানা মাছ এবং পাখি খায়। কিছু শুকিয়ে খাওয়া হয়, কিছু সিল্মাছের তেলে রান্না করে। আবার কিছু বরফের স্তর সরিয়ে মাটির নীচে রেখে গাজন প্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে প্রস্তুত করে। আবার অনেক খাবার কাঁচাই খাওয়া হয়। বিশেষ করে শীতল মাছ কাঁচা খেতেই তারা বেশি পছন্দ করে।
রুপকথার দানোঃ
তাদের রুপকথায়ও নানা দৈত্য দানো আছে। যদিও তাদের দৈনন্দিন জীবনেই নানা দানোর অভাব নেই। যাদের আশেপাশে বিশালাকার মেরু ভাল্লুক অথবা সিন্ধুঘোটক ঘুরে বেড়ায়, তাদের তো আর সামান্য কিছুর ভয় দেখানো যায় না। তাদের জাতি বা গোত্রেও আছে শিশুদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানোর মত কোয়ালিপিলাক বা এমন দানো। কোয়ালিপিলাক যেমন খু বিশ্রীভাবে মসৃন, প্যাচানো দেহের মানবাকৃতির দানো, যা বরফের স্তরের নীচে পানির ভেতর ঘাপটি মেরে থাকে এবং সুযোগ পেলেই অসতর্ক মানুষদের সাগরের শীতল পানির গভীরে টেনে নিয়ে যায়। বরফ সাম্রাজ্যের মানুষের কাছে পানিতে পড়ে যাওয়া খুব ভীতিকর, যা তাদের কাছে একমাত্র মৃত্যুই বোঝায়।
এর বাইরে বিশালাকার পায়ের রোমশ মানবাকৃতির দানোর কথাও নানা গোত্রের উপকথায় শোনা যায়।
চলন এবং কাজকর্মে ধীর স্থির ভঙ্গীঃ
আমরা মনে করতে পারি যে ঠান্ডার দেশে খুব জোরে দৌড়ালে এবং দ্রুত কাজ করলে শরীর গরম হবে বেশি এবং তা আরামদায়কই হবে। ভুল ধারনা। খুব দ্রুত কাজ করলে বা অতিরিক্ত পরিশ্রমে মানুষের শরীর ঘেমেও যায়। এই ঘাম আবার খুব দ্রুত জমে যেতে পারে বাতাসের সংশপর্শে এসে বা ঠান্ডা হয়ে পোষাকের ভেতর খুব অস্বস্তিকর অনুভূতি দেয়। এ কারণে অসুস্থ্যও হয়ে পরে মানুষ এবং নানা অসুবিধার মুখে পরে। এ কারণে বরফের দেশের মানুষেরা ধীরস্থিরভাবেই হাটে, ধীরে কাজ করে। একমাত্র শিকার করবার সময়ের ক্ষিপ্রতা বাদে সকল সময়ে তাদের আচরনে অসম্ভব ধীরস্থির ভাব দেখা যায়।
ভাষাঃ
বরফের দেশের মানুষদের বেশিরভাগ গোত্রেই দুই ধরনের ভাষা ছিলো। একটা আমাদের মত মৌখিক, এবং আরেকটা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারায় কথা বলা। তীব্র শীতে মুখমন্ডল ঢেকে রাখা হতো সম্পুর্ণভাবে এবং কথা বলতে তার হারাতে হতো, তাই ইশারায় ভাষায় কথা চলতো বেশি। মুখ খুললে দেখা যেতো যে অল্প সময়ে লালা জমে যাচ্ছে এবং অন্যান্য নানা অসুবিধা তো ছিলোই। এসব সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের কিছু এখনো টীকে আছে।
তুষারের প্রতিশব্দঃ
যাদের জীবনে যে জিনিসের প্রভাব বেশি থাকে, তাদের জীবনে এই ব্যাপারগুলোই নানা ভাবে উপস্থাপিত হয়। ওই বরফের দেশের মানুষদের কাছাকাছি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় তুষার বা বরফের প্রায় ৫০ থেকে ৪০০ প্রতিশব্দ আছে। আমার সবগুলোর মানে জানতে ইচ্ছা করে। কিছু তুলে ধরতে চেষ্টা করবো। যদিও মুল শব্দ আসলে অল্প কিছু, বাকীগুলো বিশেষ অবস্থা কিংবা শব্দযুগলও বোঝাতে পারে। যেমনঃ নরম তুষার, শক্ত তুষার, সাদা তুষার, নতুন তুষার, এসব।
অস্ত্র এবং প্রতিরক্ষার নানা সরঞ্জামঃ
অল্প কয় শতাব্দী আগেও বরফের রাজ্যের মানুষ ধাতুর ব্যবহার জানতো না কিংবা ধাতু সহজলভ্য ছিল না দেখে সেগুলো আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়নি। তাদের হাজার বছরের ধরে প্রচলিত অস্ত্রের মধ্যে ছিল খোড়াখুড়ি বা আঘাত করবার জন্য পাথর, প্রানীর হাড় বা কাঠের তৈরী অস্ত্র। যেহেতু ধাতু সেভাবে পাওয়া যেতো তা, তাই বড় আকৃতির প্রানীর হাড় দিয়েই তারা তাদের প্রধান অস্ত্রগুলো প্রস্তুত করতো। হাড় বা পাথরেই তৈরী হতো ছুরি, বর্শা কিংবা হার্পুনের মত অস্ত্র যা দিয়ে তারা শিকার এবং লড়াই করতো। চামড়ার তৈরী নানা জিনিসও তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। উলু নামের ধারালো এবং বাকানো ছুরি দিয়ে তারা মাংস কাটতো। পুরুষেরা ক্যাকিভ্যাক কিংবা এমন নামের ত্রিফলা বর্শা ব্যবহার করতো যার মধ্যের অংশ ছিলো চোখা যা শিকার বা শত্রুর ভেতরে ঢুকে যেতো এবং বাকী দুটো ফলা এমনভাবে তাদের আটকে রাখতে সাহায্য করতো যাতে তারা নিস্তার না পেতে পারে। শিকারের অস্ত্রগুলোই তারা লড়াইয়ে ব্যবহার করতো সাধারণত।
গল্পঃ দিগন্তের প্রান্তে আমাদের সীমান্ত ছিল না
১
(সূচনা)
আমার নাম আরিয়াক, আরিয়াক ইলানাক। আমি যে গোত্রের মানুষ তাদের নামের দুটা অংশ থাকে। প্রথম অংশটা বাবা মা ঠিক করেন, পরের অংশটা গোত্রের নাম। আমাদের আশেপাশে আরও বেশকিছু গোত্র আছে। আমরা তাদের এড়িয়ে চলি। তাদের কথা কিছুটা বুঝলেও আমরা তাদের এড়িয়ে চলাই ভালো মনে করি। ওদের একেক গোত্রের মানুহ শুনেছি একেকরকম। কেউ একেবারে আমাদের মত নয়। আমাদের চুল বাদামী, নাক ছোট। বড়দের কাছে শুনেছি তর্মিগান পর্বতের ওপাশে যারা থাকে ওদের চুল সোনালী, নাক উচু। ওদের দেহ আমাদের থেকে অনেক বড়। ওরা আমাদের মত নয়। আমরা সেদিকে যাই না। আমাদের ওদের এলাকার দিকে যাওয়া, ওদের সাথে যোগাযোগ করা বারণ। অন্য দিকে চলে যাওয়াও বারণ। কেবল, আমাদের এলাকার ধারেকাছের তুন্দায় যদি আর তেমন কিছু না পাওয়া যায়, বরফ আরও কঠিন হয়ে জেকে না বসে কিংবা বরফের উপরের স্তর পাতলা হয়ে গিয়ে বিপদজনক না হয়ে যায়, তবে আমরা এ এলাকা ছেড়ে যাবো না। নতুন এলাকায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন গোত্রের বয়োবৃদ্ধ পুরুষেরা। অন্য সব ব্যাপারে মেয়েদের মতামত নেয়া হলেও এ ব্যাপারে তাদের মতামত নেয়া হয় না। তারা সেভাবে শিকারে যায় না, খুব দূরে কোথাও যায় না। তাই এ ব্যাপারে মতামত দেবার মত যোগ্যতা তাদের নেই।
অন্য গোত্রের অঞ্চলের দিকে যাবার আমাদের কোনো কারণও নেই। আমাদের যা যা দরকার সবই আমাদের দেবতা আমাদের দেন। আমি অনেক ছোট থাকতে একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
- “বাবা, আমাদের সীমানার ওপাশের মানুষদের দিকে যেতে নিষেধ কেন? ওরা কি খারাপ?”
বাবা বলেছিলেন,
- “না, এ পৃথিবীতে কোনো মানুষই খারাপ নয়। তবে ওরা এক রকম, আমরা অন্যরকম। আমাদের পোষা কুকুর আর তুষার প্রান্তরে ঘুরাঘুরি করা শেয়ালগুলো দেখতে অনেকটা একই রকম। কেবল মুখের ডাক কিছুটা আলাদা। অনেকটা কাছাকাছি দেখতে হলেও কি ওরা একসাথে থাকে? কালো পেঙ্গুইনরা এক দলে থাকে, ধুসর পেঙ্গুইনরা আলাদা দলে থাকে। প্রতিটা ভিন্ন গোত্রের মানুষও এমন আলাদা ভাবেই থাকতে হয়। এটা দেবতার বিধান।“
আমরা আমাদের এই জীবনে খুব সুখী। বরফের ইট বানিয়ে আমরা লম্বা রাতের সময় পার করে দেই। আমরা জানি একসময় দেবতা উঁকি দেবেনই। চারদিক আলোয় ভরে যাবে। সে সময়ে আমরা খুব ব্যস্ত হয়ে যাই। আবার দীর্ঘ রাতের প্রচন্ড ঠান্ডার সময়ের খাবারের মজুদ গড়ে তুলি। প্রচুর সিলমাছ আসে সে সময়ে, সিন্ধুঘোটক আসে। ভোঁতা মাথার তিমিকেও ফাঁদে ফেলি আমরা। তিমিমাছ খুব মজার। তিমি আর সিলের মাংস সুর্য উঠবার পর তুন্দ্রা থেকে সংগ্রহ করা সুগন্ধী লতাপাতা আর লবন দিয়ে মেখে বরফের নীচে রেখে দেই। বেশ অনেকদিন পর সেগুলো তুলে বের করে আমরা সেগুলো খাই। আমার মার হাতের পুরোনো তিমি আর সিলের মাংস সবচেয়ে মজাদার। উনি কিভাবে যেন একদম আমার মনের মত পুরোনো মাংস প্রস্তুত করতে পারেন।
দীর্ঘ রাতে আমরা জমিয়ে রাখা মাংস খেয়ে পার করি। বাইরে তেমন বেরই হই না। তবে, মাঝে মাঝেই চাঁদের আলোয় আমাদের পৃথিবী অসম্ভব সুন্দর হয়ে ওঠে। তখন আমরা গোত্রপতির সবচেয়ে বড় বরফের ঘরে গিয়ে কিংবা অন্য কারো কুঠিতে অনেকে একত্রিত হয়ে আনন্দ করি। গান গাই, নাচি। বড়রা গল্প বলেন, আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনি।
আমাদের মধ্যে যারা বৃদ্ধ হয়ে যান, শিকার আর খাদ্য সংগ্রহে যেতে পারেন না, তাদের কাজ নিজেদের মধ্যে আমাদের গোত্রের গল্পগুলো ঝালাই করে নেয়া। তারা অনেক অনেক সময় আগের কথা জানেন। তারা এসব মনে রাখেন যাতে নতুন মানুষেরা সেসব জানতে পারে। আমিও যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবো তখন আমারও এই কাজ করতে হবে। যে যত জানেন তার দাম সবচেয়ে বেশি আমাদের সমাজে। এসবই আমরাও একসময় আমাদের সন্তানদের বলবো। আমাদের রোমশ দেবতার কথা, পূর্ব পুরুষের কথা, কিভাবে আমরা এলাম, মৃত্যুর পর আমাদের সাথে কি হবে, নানা দূর্যোগে কি করতে হবে, এর সবই আমাদের মুখে মুখে বলে তাদের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী করে দিয়ে সব কথা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উপায় জানা নেই।
সবচেয়ে বয়স্ক জ্ঞানী মানুষটাকে আমরা গোত্রপতি বানাই। নানা বিপদে কি করতে হবে সবচেয়ে বয়স্ক গোত্রপতিই সেটা ভালো জানেন। উনি আরও বেশ কয়জন সামর্থ্যবান এবং জ্ঞানী পুরুষের পরামর্শ নেন, তবে কোনো বিবাদে তার কথাতেই সব ফয়সালা হয়। গোত্রপতির অনেক সম্মান। তিনি রোমশ দেবতার সরাসরি অবতার। আমরা সবাই লম্বা সময় বাঁচতে চাই। সবাই চাই একদিন না একদিন নিজেও গোত্রপতি হতে পারবো। রোমশ দেবতার প্রিয় হতে কে না চায়?
আমাদের সমাজের মেয়েরা অবশ্য গোত্রপতি হতে পারে না। তারা কিছুটা দুর্বল। খাবার মজুদ করা এবং সন্তান পালনের কাজ তাদের করতে হয়। শক্তি কম বলে মেরু ভাল্লুক কিংবা ক্ষিপ্র অন্য প্রানী শিকারে তারা দক্ষ নয় তেমন। শিকারের সক্ষমতা একটা বড় গুন আমাদের গোত্রে। মেয়েদের এই গুন কম বলে তাদের গোত্রপতি করা হয় না। আর যেহেতু তারা শিকারে তেমন বের হন না, আমাদের সাম্রাজ্যের সবকিছু তাদের সেভাবে চেনাও হয়ে ওঠে না। কখনো যদি দূর্যোগের কারণে আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয় তবে এর সিদ্ধান্ত নেবেন গোত্রপতি এবং অন্যান্য পুরুষেরা। এ ব্যাপারে মেয়েদের মতামত দেয়ার কোনো যোগ্যতা নেই।
এবার আমি আমার কথা বলি, আমাদের কথা বলিঃ
আরিয়াক ইলানাক বলে তোমরা কাউকে চেনো না, আমিই সে আরিয়াক
সফেদ দেশে ইলানাকদের বাস, অন্য জগতে ইলানাকদের আগ্রহ নেই
আমাদের শুভ্র প্রান্তরের কোনো দরজা জানলা নেই
মাথার উপর বরফের ছাদ, আসলে কোন ছাদ নেই
আমরা বৃষ্টির রুপকথা শুনি, বৃষ্টি হয় না এখানে
এখানে আমরা আমরাই, আমাদের সন্তরনজোড়া সাম্রাজ্য, বরফকুঠিতে আমাদের প্রাসাদ
আমরা তাই দেখি যা বর্তমান আমাদের দিগন্তে, তোমরা তাই দেখো যা তোমাদের দিগন্তে
তোমাদের দিগন্তের প্রান্তে আমাদের যৌথ সীমান্ত নেই
নিয়ম করে একসময় আলোর ঝলকানি উঁকি দেয় এখানেও
উজ্জ্বলতর হয় ধীরে, গোলাকার একটা বৃত্ত হয়ে যায় ক'দিনেই
খুব তীব্র সে, তাকানো যায় না সরাসরি, প্রায় ছয়মাস থাকে
এখানে ভাগাভাগি দিন রাত কম, টানা স্বচ্ছ দিন, দীর্ঘ অলস রাত
দিনে আমরা শিকারে বের হই, সীলমাছের বুদবুদ খুঁজি বরফের নীচে
আমাদের ভাগ্যবিধাতা এক রোমশ দেবতা
তিনি আমাদের সাথে তার অধিকারের পাইক মাছ ভাগাভাগি করেন
তিনি দিন এনে দেয়া আলোর উজ্জ্বল বৃত্তের চেয়ে সহস্রগুণ শক্তিশালী
তার ভান্ডারে সমস্ত ওম, উনি ভাষায় কৃপন, দেবতারা অমনই হন
আমাদের রোমশ দেবতা মানুষ নন, তবু তিনি সবচে ভালোমানুষ
তিনি আমাদের সাথে খাদ্য ভাগাভাগি করেন
ছয় মাস রাত সামলাতে উজ্জ্বল বৃত্ত হয়ে নিজে এসে উঁকি দেন
এ জীবনে তার হাতে দেবার মত আর কিছু নেই
এর বাইরে তার কাছে আমাদের চাইবার কিছু নেই
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১৬ রাত ১১:০৬