কিছুক্ষণ আগেই ঘটে গেল অভাবনীয় ঘটনাটা!
ভোরবেলা হাটছিলাম একাকী রাস্তায়। এভাবেই হাটি মাঝে মাঝে। ঊষালগ্নই মনে হয় দিনের শ্রেষ্ঠ অংশ।কারণ সূর্যোদয় দেখলে প্রেরণা পাওয়া যায়, সন্ধ্যার মত হতাশার নয়। আধখানা সূর্য আর পূর্ণদিগন্তের দেখা পেতে যতদূর হাটা লাগে হাটি। ব্যস্ততার বিষে যখন নীল হয়ে যায়। আপনজনের মাঝে থেকেও যখন একাকীত্বের নিচ্ছিদ্র দেয়ালে বন্দী হয়ে হাপিত্যেস করি। তখন এভাবেই বেরিয়ে পড়ি।
কাল রাতে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। মনে হল, একজীবনে এত সুখ রাখব কোথায় আমি! সেইক্ষণে বিশ্বাস হল এ পৃথিবী সত্যিই স্বর্গের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আসলে কি তাই? তবে যে কখনো কখনো মানুষের আচারণেই নরকের প্রতিধ্বনি শুনি? নিয়তিই হয়ত ব্যক্তিকে একেক সময় পৃথিবীর একেক রূপ দেখায়।
নিজের সাথেই এভাবে গল্প করছিলাম আর হাটছিলাম।
এর মাঝেই কানে এল নারী কন্ঠে গান!!
রাখিলেন সাঁই কূপজল করে,
আন্ধেলা পুকুরে..
কবে হবে সজল বরষা?
রেখেছি মন সেই ভরষা..
খানিকটা আগ্রহ নিয়ে তাকালাম, কোন পাগলি টাগলি কিনা দেখার দেখার জন্য।
এই জীবনে।নারী গোত্রের সুস্থ কাউকে আমি রাস্তায় উচ্চস্বরে গান গেয়ে হাটতে দেখিনি।
না। তিনি সুস্থ।
সামনে রাস্তার কাজ চলছে ওখানকার শ্রমিক, কাপড় বাধা খাবারের পাত্র হাতে নিয়ে হাটছেন আর গাইছেন।
দাঁড়িয়ে গেলাম আমি।
নিন্ম মধ্যবিত্তের প্রতিটি ভোর হচ্ছে তীব্র হতাশার এক রাশ দুর্গন্ধ। কিন্ত বিষয় হল তিনি কি আসলেই হতাশা ভুলতে চাইছেন গান গেয়ে?
নাকি, কাল রাতে তার স্বামী দশ টাকার বাদাম এনে বলেছিল “আই বউ পার্কে বসা জোড়াগো মত আমরাও বাদাম খাই”? সেসব ভেবে মনের সুখ গলায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন আনমনে?
নাকি তার স্বামী, সন্তান, মা, বাবা কেউ নেই? ভালবাসা দেয়ার বা পাওয়ার কোন চরিত্র নেই তার জীবনে? নাকি আশা হতাশা নামের কোন কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন তিনি? এমনিতেই গাইছেন?
এরকম শত প্রশ্ন উকি দিয়ে গেল আমার মনে! সাথে এক অদ্ভুত ভাল লাগায় আমিও মুখ হা করে গাইতে গেলাম।
নাহ! পারলাম না। ভদ্রতার কাশি দিয়ে আশপাশে তাকিয়ে সে চেষ্টা বন্ধ করলাম। লোকে কি বলবে! কথাটি বার দুয়েক আউড়ে মাথা নিচু করলাম।
এরকম কত যে আত্নার আকাঙ্ক্ষা খুন করেছি লোকের কথা ভেবে তার হিসাব জানলে লোকেই হয়ত আমায় গোল্ড মেডেল দিত। হা হা হা!
“লোকে কি বলবে” এই কথাটি জীবনে একবারও শোনেনি অথবা ভাবে নি এরকম মানুষ বোধ হয় এদেশে পাওয়া যাবে না।
আমিও মাঝে মাঝে লোকেদের কাতারে চলে যায়। একটা মেয়ে যখন জোর গলায় কোন কিছুর প্রতিবাদ করে। তখন আমি বলতে থাকি “ভারী বেয়াদব ত! মেয়েদের গলায় এত জোর ভাল না” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কথার ভয়ে মেয়েটা থেমে যায়।
একটা ছেলে যখন পড়ালেখা শেষে তার ভাল লাগে তাই আদর্শ কৃষক হতে চায়, তখন টিটকারি করি। আমার ভয়ে ছেলেটা ভাল চাকরী খুঁজতে থাকে। এভাবেই আমার দৃষ্টিভঙ্গি আর কথা দিয়ে অন্যের আত্নার চাওয়াগুলোকে বিক্ষত করি!
অথচ তিনি কি অবলীলায় নিজের ইচ্ছা হল তাই গেয়ে গেলেন! একবারও আমার দিকে তাকালেন না। লোকের কথা ভাবলেন না! কয়জনই বা পারে লোকের কথার তোয়াক্কা না করতে? আত্মার আহবান শুনতে?
সেই চোখে আপন শক্তির এক রশ্মি দেখেছি, নিজের মনের মত চলার এক প্রত্যয় দেখেছি, আত্মার আহবান শোনার সুখ দেখেছি।
আজকে আর সূর্যোদয় দেখার প্রয়োজন ছিল না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৫০