হঠাৎ করেই আমার দেশে আসার সিদ্ধান্ত হলো। বাবা বেশ ক' মাস থেকেই অসুস্থ। তাকে দেখার জন্যই ৩ সপ্তাহের ছুটিতে নিয়ে ঢাকায় ফেরা। যেমন কথা তেমন কাজ। খোঁজ খবর করে পাওয়া গেল গালফ এয়ার-এর টিকেট। স্ত্রী আর সন্তান সন্ততিকে দেশে রেখা একা দেশের বাড়ীতে আসার মধ্যে যতোটা রোমাঞ্চ, ততোটাই কস্ট। বুধবার দিন অফিস করার কথা বেলা ১টা পর্যন্ত। তারপর বাড়ী ফিরে বাক্স-পেটরা নিয়ে বিমান বন্দরের দিকে ছুটতে হবে বিকেল পাঁচটার মধ্যে। শেষ মুহুর্ত্বে অফিসের কাজ শেষ করতে করতে বেরোলাম আড়াইটা। ফোনে স্ত্রীকে বললাম, লাগেজের ভেতরটা আরেকবার গুছিয়ে রাখতে। বাড়ী ফিরলাম সোয়া তিনটা। স্ত্রী'র হাত থেকে লাগেজ ওজন করতে গিয়ে দেখি ওজন ৫০ এর চেয়ে কয়েক পাউন্ড বেশী। মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। বললাম, যা হবার হয়েছে। বিমান বন্দরে গিয়েই ওজনের ঝামেলা মেটাব।
স্ত্রী বলল, মুখে কিছু দিতে। আমি বললাম, মুখে বিমান বন্দরে গিয়েও কিছু দেয়া যাবে। ফ্লাইট মিস করলে মহা সর্বনাশ। সময়ের যখন অভাব তখন কিন্তু ঘড়ির কাঁটা একটু জোরেই ঘুরে। বাড়ী থেকে বেরুতে বেরুতে বাজল সোয়া চারটা। ছোট ছেলেটাকে ডে কেয়ার থেকে নিয়ে গাড়ী ছুটল। বাড়ী থেকে বিমান বন্দর ৩৫ মাইল। কিন্তু রাস্তায় গাড়ী নিয়ে উঠে দেখি গাড়ী চলে না। প্রচন্ড জ্যাম। যদিও এখানে অফিস ফেরতা লোকরা বেরোয় ৫টার পর। কিন্তু কিছু করিৎকর্মারা একটু আগেই বেরিয়ে যায়। তাই ডিসির পথে অফিস ফেরত মানুষের ভীঁড় শুরু হয় দুপুর ৩টার পর থেকেই। ডালেস বিমান বন্দরের একসেস রোডে উঠতে উঠতে ৫টা বেজে গেল। স্ত্রীকে বললাম, ডিপারচার লাউঞ্জে আমাকে নামিয়ে দিতে। বিমান বন্দরে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ঢোকা মানে, তাদেরকে আরও যন্ত্রণা দেওয়া। এমনিতেই বাবা চলে যাচ্ছে, তাদের মন খারাপ। তার মধ্যে তাদের সামনে থেকে যেতে আমারও কস্ট লাগবে। গাড়ী থেকে লাগেজ নামিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত বিমান বন্দরের ভেতরে ঢুকে পড়ি।
কিন্তু ইউনাইটেড-এর চেক-ইন কাউন্টারের সামনে এসে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। কোন লোক পক্ষীরও সাক্ষাত পাই না। কি ব্যাপার? ফ্লাইট কি ক্যানসেল হয়ে গেল? অনেকক্ষণ পর এক বিমান কর্মীকে দেখে জিগ্যেস করলাম, কি ব্যাপার লোকজন নেই। সাতটার ফ্লাইটের যাত্রী নেওয়া কি শেষ হয়ে গেছে? ভদ্রমহিলা একটু অবাক হয়েই বলল: দেখছ না, সেলফ চেক ইন কাউন্টার। নিজে গিয়ে চেক-ইন শুরু করো। আমি আসছি। এখান থেকে এক বছর আগে দেশে গিয়েছি। চেক-ইনের লম্বা লাইনে অপেক্ষা করেছি। এর মাঝেই আবার সব বদল হয়ে গেল। এগিয়ে এলাম অটোমেটেড চেক-ইন মেশিনের সামনে। লেখা আছে: চেক-ইন শুরু করার জন্য পাসপোর্ট বা ক্রেডিট কার্ড ঢুকাতে। আমি পাসপোর্ট হাতে নিয়ে প্রমাদ গুণলাম। সংশয়ী হয়ে উঠলাম। ভাবলাম, মেশিনটা যদি পাসপোর্ট গায়েব করে দেয়? ঝুঁকি না নিয়ে তাই ক্রেডিট কার্ড বের করলাম। ঢুকিয়ে টাচ-ইন স্ক্রীনে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে এক পর্যায়ে একটা কার্ড বের করে অপেক্ষা করতে বলল। কারণ, লাগেজের ওজন করতে হবে।
ইতিমধ্যে ইউনাইটেডের বিমান কর্মী এসে হাজির। সে চেক-ইন কার্ডটা নিয়ে তার কম্পিউটারে গুতোগুতি শুরু করল। পাশের থেকে একটা মহিলা এসে বলল: লাগেজ তোল ওজনের মেশিন। তার কন্ঠের রুক্ষতা দেখে ভাবগতিক ভাল ঠেকল না। আমি তুলে দিতে বলল: ৫৩ পাউন্ড। এটা নেওয়া যাবে না। কমাতে হবে। অন্যটা তোল। তোলার পর বলল: এটাও ৫২ পাউন্ড। তোমার লিমিট কিন্তু ৫০ পাউন্ড। আমি কি করে বলি: আমরা ইমিগ্রান্টরা যখন দেশে যাই, তখন এই লাগেজগুলো ঠাঁসা থাকে অনেক ভালবাসার পণ্য। আপনজনকে একটু তৃপ্ত করার চেস্টা। যদিও দেশের মাটিতে বড়ো বড়ো স্টোরে ঢুকে বিদেশী পণ্যের রকমারি বাহার দেখি, তখন প্রতিবারই প্রতিজ্ঞা করি, কোন লাগেজ নিয়ে দেশে আসব না। শুধু বিদেশী টাকা নিয়ে আসব। কিন্তু তারপরও কেন যে এই ভুলটা হয়, আর এই ঝকমারির মধ্যে পড়তে হয় তা নিজেও বুঝতে পারি না। তারপরও যখন নিরুপায়, তখন মুখ শুকিয়ে কপালে টেনশনের ভাঁজ ফেলে শ্বেতাঙ্গিনীর হৃদয়ে দয়া বর্ষাবে না, তা তার চাহনীতে দেখেই আমার মালুম হয়ে গেল। সমস্যা হলো, লাগেজে কি আছে তা নিজেও জানি না। স্ত্রী যত্ন করে লাগেজ গুছিয়ে দিয়েছে। শেষ অবধি, চাবি হাতড়ে লাগেজ খুলে উপরে সাজানো ঢাউস মার্কা একটা ভিটামিনের বোতল হ্যান্ড লাগেজে সরিয়ে বললাম, "দেখ তো, ওজন এখন কতো"? মুখটা বাংলার পাঁচ করে বলল: ৫১ পাউন্ড। ঝামেলা না বাড়িয়ে মহিলা লাগেজগুলো কনভেয়ার বেল্টে তুলে দিল। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এবার গেট খুঁজে সিকিউরিটি চেকের লাইনে দাঁড়ালাম। টিএসএ'র লম্বা লাইন। সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে। তার মধ্যে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছি ছাড়া পাওয়ার। টিএসএ'র কর্মী পাসপোর্টের উপর নীলাভ আলো ফেলে নিশ্চিত হলেন, পাসপোর্ট ভুয়া না। এবার স্ক্যানার ভেতর দিয়ে বের হওয়া। অবশেষে ৬টা নাগাদ শেষ হলো বিমান আরোহনের সকল পূর্বযজ্ঞ। হাতে এক ঘন্টা। লম্বা টার্মিনালে পায়চারি করতে লাগলাম। একটা পে ফোন থেকে স্ত্রীকে ফোন করে জানালাম, কোন ঝামেলা ছাড়াই বিমানে উঠতে যাচ্ছি।
যেমনটা আগেই বলেছিলাম, তাড়া থাকলে ঘড়ির কাঁটাও চলে জোর কদমে আর অপেক্ষার সময় তা একেবারেই সরে না। ঘড়ির কাঁটা ৭টা ছুঁতে সময় লাগল মনে হয় একটু বেশী। জানালার পাশে সীটে বসলাম। পাশের সীটে এক শ্বেতাঙ্গিনী, সম্ভবত জার্মান তরুণী। হাতে জার্মান বই দেখেই বুঝলাম। পাশে বসেই বই-এর দিকে নজর। অন্যকে পড়তে দেখে নিজেরও বই পড়ার সাধ জাগে। পায়ের কাছে রাখা হ্যান্ড ব্যাগ থেকে মুজতবা আলী রচনা সংগ্রহের ১ম খন্ড হাতে নিয়ে পড়ার চেস্টা শুরু করেছি। বিমান সাড়ে সাতটায় ছাড়েনি। বিরক্তি বাড়ছে। একসময় ওয়াশিংটন ডিসি'র ডালেস এয়ারপোর্ট থেকে পাখা উড়িয়ে আকাশে পাড়ি দিল। বিমানের জানালা থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে মনে হলো রাতের ডিসি দ্রুত ছোট হচ্ছে। একসময় মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল মাটির উপর লাইন ধরে জ্বলে থাকা সোডিয়াম লাইটগুলো। মনটা স্ত্রী-সন্তানদের জন্য একটু খারাপ হলো। বাচ্চাদের স্কুল। না হলে হয়তো তাদেরকে নিয়েই পাড়ি দিতাম। ভাবলাম, বিয়ে করে সংসার হয়। সংসারের আয়তন বাড়ে। শেকড় গজায়। তারপর সেই শেকড়ের টানে সংসারে ডুবে থাকতে হয়। জীবনের এই চিরায়ত ধারায় কোন ব্যত্যয় নেই। আমার বাবা জীবন আর জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়ে এসেছিলেন ঢাকায়। আর আমি উচ্চ শিক্ষা শেষ করে চাকরি নিয়ে আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এসে অন্তরীণ হয়ে রয়েছি বহু বছর ধরে। জীবন আর সংসারের শেকড়গুলো বোধ হয় খুব দ্রুত গজায়। তাকে সরিয়ে পাশ কেটে সরে আসা যায় না। ফেরা যায় না উত্তরণের কেন্দ্র বিন্দুতে।
রাত সাড়ে দশটার দিকে বিমানবালা খাবারের ট্রলি নিয়ে রাতের খাবার পরিবেশন শুরু করলেন। যদিও প্রায় প্রতি বছর দেশে আসি, কিন্তু সাধারণত: বিমানের টিকেটগুলো কেনা হয় মধ্যপ্রাচ্যীয় কোন এয়ারলাইন্স থেকে। এবারও তাই। কিন্তু শুধু ওয়াশিংটন ডিসি থেকে যাত্রার প্রথম ভাগ শুরু ইউনাইটেড দিয়ে। আমেরিকার এয়ারলাইনসের সাথে মধ্যপ্রাচ্যীয় এয়ারলাইনসগুলোর আতিথেয়তার আকাশ পাতাল ব্যবধান। বিশেষ করে আমরা যারা ভোজনবিলাসী তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যীয় তেলে সিক্ত এয়ারলাইনসগুলোর বাড়তি আকর্ষণ তাদের অপূর্ব আতিথেয়তা আর দিলদরাজ খাবারের বরাদ্দ। কিন্তু ইউনাইটেডের খাবার খেয়ে খুব যে খুব তৃপ্ত হয়েছি তাও না, তবে বিষোদগারের কোন কারণও দেখি না। খাবার শেষে একটু বাথরুম বিরতি নিয়ে সীটে ফেরত আসলাম। কিন্তু রাতে যে বারবার সীট ছেড়ে উঠা সম্ভব না তা ঠাউরে একটু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলাম। বারবার বাইরে যাবার অজুহাত দেখিয়ে পাশে বসে থাকা তরুণীকে তোলা ঠিক হবে না বলে মনে হলো। পাছে মহিলা যদি ভাবেন আমি ডায়াবেটিসের রুগী। সাধারণত: আমি রাতের ফ্লাইটে বেশ ক'বার উঠে হাত পা ছড়িয়ে হাঁটার চেস্টা করি। পানি বা ড্রিংকস খাওয়ার অজুহাত দিয়ে বিমানবালাদের সাথে খানেক মিঠে আলাপ সেরে আসি। তবে এ যাত্রায় তা হচ্ছে না। সীটে ফেরত এসে কম্বল জড়িয়ে তে-কোণা স্টাইলে পা ছড়িয়ে চোখ বোঁজার চেস্টা করছি। একসময় ক্লান্তি ভরা চোখ ঘুমের ভার সহ্য করতে না পেরে বন্ধ করে দিল চোখের পাতা। ভোর ৫টার দিকে যখন ঘুম ভেঙ্গেছে তখন মনে হয়নি রাতে দু'একটা হালকা খোঁচা ছাড়া তেমন কোন ঝামেলা বাদেই রাত কাবার করেছি।
হঠাৎ করে ফ্রাঙ্কফুট বিমানবন্দরে পৌঁছাবার ঘোষণা দিলেন বৈমানিক। এখানে নেমে ঘন্টা দু'এক বিরতি নিতে হবে। তারপর শুরু হবে গালফ এয়ার দিয়ে দেশের পথে যাত্রা। বিমানবন্দরের বাইরে এসে বিমান থামল। বাসে করে সব যাত্রীদের টার্মিনালে নেওয়া হলো। সেখান থেকে আবার গালফ এয়ারলাইনসের টার্মিনাল ধরার জন্য ট্রেনে চাপতে হলো। এগুলো খুঁজে বের করা অনেকটা পাজল খেলার মতো। কিন্তু এখন আর খুঁজে পেয়ে রোমাঞ্চ পাই না। জীবনে এতে বেশী বিমান ভ্রমন করেছি যে, এখন এসব ট্রানজিট খুব পানসে মনে হয়। গালফ-এ চাপার জন্য সিকিউরিটি লাইন পার করতে গিয়ে ছোকরা সিকিউরিটি কর্মী আমাকে আটকে দিল। বলল: হ্যান্ড লাগেজ খুলতে হবে। আমি নির্বিকারভাবে হাত ব্যাগ খুলে দিতেই ব্যাগের ভেতর আধা শিশি পানির বোতলের লেবেল পড়তে পড়তে বলল: "নো লিকু্ইড"। আমি বললাম, বোতলটা আমার হাতে দাও। আমি এক চুমুকে পানিটা শেষ করে দিই। ছোকরা বিরক্ত হয় বলল: স্যার নো ড্রিংকি এন্ড ইটিং হিয়ার। এবার আমার দেশী মেজাজটা বিগড়ে গেল। বললাম, ঠিকাছে, এটা তুমি ট্রাশে ফেলে আমাকে নিষ্কৃতি দাও। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। শুরু হলো গালফ দিয়ে বাহরাইন-এর দিকে যাত্রা। (চলবে)