শুধু ওপর থেকে নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিল পুলিশ-র্যাব-বিজিবি। একটা ‘ইয়েস কল’ আসার অপেক্ষা মাত্র। কলটি আসা মাত্রই ওরা নড়ছে না। তারপর ওপাশ থেকে যেই বলা হল- ‘আক্রমণে যাও’। এরপরে শুরু হলো সর্বাত্মক আক্রমন!! হাজার হাজার রাউন্ড গুলি টিয়ার গ্যাস ও গ্রেনেড ছুড়ে আগাতে থাকে যৌথবাহিনী।
গোলাবারুদের হিসাব:
৫ মের ওই অপারেশনে প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ খরচ হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের হিসাবে ৮০ হাজার টিয়ার শেল, ৬০ হাজার রাবার বুলেট, ১৫ হাজার শটগানের গুলি এবং ১২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে পিস্তল এবং রিভলবার জাতীয় ক্ষুদ্র অস্ত্রের গুলি খরচ হয়েছে মাত্র সাড়ে ৩০০ রাউন্ড। সরকারের ৫ মের অপারেশনে র্যাবের ১ হাজার ৩০০ সদস্য, পুলিশের ৫ হাজার ৭১২ এবং বিজিবির ৫৭৬ জন সদস্য সরাসরি অংশ নেয়। এর বাইরে বিজিবির ১০ প্লাটুন ছাড়াও র্যাব এবং পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য ‘স্টাইকিং ফোর্স’ হিসেবে তৈরি ছিল। রাত ২টা ৩১ মিনিটে মূল অপারেশন শুরু হলেও রাত ১২টার পর থেকেই মূলত আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা তিন দিক থেকে ধীরে-ধীরে শাপলা চত্বরের দিকে এগুতে থাকে। পুলিশের পক্ষ থেকে ওই অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা’। র্যাবের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট’।
আক্রমন পরিচালনা :
ঘটনার রাত ১০টার দিকে তার নেতৃত্বে র্যাবের একটি দল বেইলী রোড দিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে এগুতে থাকে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন মোড়ে গিয়ে তারা প্রথম ‘ফায়ার ওপেন’ করেন। এ সময় তারা সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছুড়ে জমায়েতে থাকা লোকজনের মধ্যে আতংক সৃষ্টির চেষ্টা করেন। এ সময় হেভি ভেহিকেল মুভমেন্ট করে তাদের মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তিনি জানান, ধীরে-ধীরে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত যাওয়ার পর তারা প্রথম বাধার সম্মুখীন হন। এ সময় এপিসি থেকে একের পর এক গ্যাস চার্জ করা হয়। কিন্তু বাধ সাধে উল্টো বাতাস। বাতাসের কারণে গ্যাস চার্জের পর তারা সামনের দিকে এগুতে পারছিলেন না। এভাবে তারা নটরডেম কলেজ পর্যন্ত যান।
রাত ১টার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছিলেন। সমঝোতা ব্যর্থ হওয়ার পর রাত দেড়টার দিকে অপারেশনের পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরেই তারা টেলি কনফারেন্সের মাধ্যমে অপারেশনের কৌশল ও প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশ এবং বিজিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। রাত আড়াইটার দিকে শুরু হয় মূল অপারেশন।
অপারেশন শাপলার অজানা কথা :
৫ মে রাত ১০টা। পল্টন মোড় থেকে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত থেমে থেমে পুলিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সংর্ষষ চলছিল। একপর্যায়ে পুরো এলাকা দখলে নিয়ে নেয় পুলিশ। তখন র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেননি। এলাকা দখলে নেয়ার পর পুলিশ চলে যায় মতিঝিল থানার সামনে। এই সময় হেফাজতের নেতাকর্মীরা অবস্থান করে থানা থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে। নেতাকর্মীরা মাইকে স্লোগান দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে রাখে। পানির জার ও থালা-বাসন দিয়ে পিটিয়ে কর্মীদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করেন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা। বারবার মাইকে ঘোষণা দিতে থাকেন-পুলিশ বা র্যাব আসলে তাদের কঠোরভাবে প্রতিহত করতে হবে। তাদের কিছুতেই ছাড় দেয়া হবে না। এসব ঘোষণা আসার পর কর্মীরা নানা রকমের স্লোগান দিয়ে পুলিশের দিকে আসার চেষ্টা চালায়। এদিকে অপারেশন শাপলা কিভাবে করা হবে তা নিয়ে পুলিশ-র্যাব ও বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেন।
এরপরে সরকারের হাইকমান্ড নির্দেশ আসে, যতই প্রাণহানি হোক না কেনো হলেও অভিযান চালাতে হবে। রাত সাড়ে ১২টায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়- অভিযান চালানো হবে। র্যাব-পুলিশ জানায়, তিনভাগে ভাগ হয়ে অপারেশন চালানো হয়। একটি অংশ নয়াপল্টন থেকে দৈনিক বাংলা হয়ে শাপলা চত্বরের দিকে, ২য় অংশটি নটরডেম কলেজের সামনের দিক থেকে শাপলা চত্বরের দিকে। আর ৩য় অংশটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে বের হয়ে মূল মঞ্চের দিকে চলে যাবে। আর টিকাটুলি দিকে যাওয়ার রাস্তাটি শুধু খোলা রাখা হয়। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর রাত ২টা ২০ মিনিটে র্যাব সদস্যরা এসে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয়। আর বিজিবিকে রাখা হয় মতিঝিল জনতা ব্যাংক ভবনের সামনে।
অভিযান চলে যাদের নেতৃত্বে :
অভিযানে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান, র্যাব-১০-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান ও র্যাব-৩-এর অধিনায়ক মেজর সাব্বির, র্যাব-১-এর পরিচালক লে. কর্নেল কিসমত হায়াত র্যাব- ৪ এর পরিচালক কামরুল আহসান। বিজিবিকে নেতৃত্ব দেন কর্নেল এহিয়া আজম খানসহ ৫ কমান্ডো অফিসার। আর পুলিশের পক্ষে ছিলেন- যুগ্ম কমিশনার শেখ মারুফ হাসান, উপ-পুলিশ কমিশনার (হেডকোয়ার্টার) আনোয়ার হোসেন। তারা মাঠপর্যায়ে সদস্যদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। সবার হাতে থাকে এসএমজি, একে ৪৭ রাইফেলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।
আইন প্রয়োগকারী সদস্য সংখ্যা :
ওই অভিযানে র্যাবের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০। পুলিশের ছিল পাঁচ হাজার ৭১২ জন। আর বিজিবির ছিল ১৮ প্লাটুন। তাছাড়া যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পিলখানায় প্রস্তুত রাখা হয় বিজিবির আরও ১০ প্লাটুন সদস্য। হামলা রোধ করতে সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে বিজিবি ও র্যাব।
অভিযানের সঠিক সময় :
সিন্ধান্ত অনুযায়ী রাত ২টা ৩১ মিনিটে অভিযান শুরু হয়। প্রথমে পুলিশের ২টি এপিসিকে সামনে রাখা হয়। তারপর র্যাব ও পুলিশ ফায়ার করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুহুর্মুহু টিয়ার শেল আর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু। এ সময় হেফাজতের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়, কোন কর্মী শাপলা চত্বর ছাড়বে না। তারপরও চলে তাদের বিদায়ী ভাষণ। অল্প সময়ের মধ্যে মঞ্চ লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়। একই সঙ্গে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও শটগানের গুলির প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে মতিঝিলসহ আশপাশ এলাকা। গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের তোপের মুখে মঞ্চ ছাড়তে শুরু করে হেফাজতের সদস্যরা। কেউ কেউ চলে যায় টিকাটুলির দিকে। আবার কেউ চলে যায় সোনালী ব্যাংকের ভেতরে, কেউ পাশের ভবনে, কেউ বা অলিগলিতে। হেফাজতের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে র্যাব-পুলিশের পরনে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। অভিযানের সময় প্রস্তুত ছিল ফায়ার সার্ভিসের একাধিক গাড়ি ও কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স। ৪০ মিনিটের মধ্যেই পুরো শাপলা চত্বর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। কিন্ত পুলিশ-র্যাব ও বিজিবির অভিযান শেষ হয় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে। অভিযান শুরুর পর থেকেই কন্ট্রোল রুমে থেকে গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ। বিজিবি ও র্যাব মহাপরিচালকও তার বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে-ওয়্যারলেসে দফায় দফায় কথা বলেন। ওই দিন অঘোষিতভাবে সব র্যাব সদস্যের ছুটি বাতিল করে সদর দফতরে ডেকে আনা হয়।
যখন অপারেশন শুরু হয় টেলিভিশন চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়ার রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানরা ছিলেন অনেকটা আতংকে। তাদেরকে একমন স্থল থেকে আধা কিমি দূরে নিয়ে রাখা হয়। তাছাড়া অভিযান শুরু হওয়ার পর হামলার ভয়ে অনেকেই সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তাও করেনি। তাছাড়া ওইদিন দিনের বেলায় হেফাজত কর্মীদের হামলায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হওয়ার পর অন্য সাংবাদিকদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছিল।
রক্তক্ষয়ী সাড়াশি আক্রমনের পরে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা হেফাজত কর্মীদের খুঁজে খুঁজে বের করে গুলি করে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। হাজার হাজার হতাহতের মধ্যে নিহতদের লাশ আইনশৃঙ্খলার কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ট্রাকে করে সরিয়ে ফেলা হয়। সিটি কার্পোরেশনের সুইপার ও ফায়ার ব্রিগেডের হোসপাইপ দিয়ে রাস্তায় জমে থাকা রক্ত পরিস্কার করে সব সাফ করা হয়।
একুশে টিভির ক্যামরোম্যান জানিয়েছেন, লাশের সংখ্যা হবে প্রায় ২৫০০, এমনকি ৫ ট্রাক লাশ যেতে তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। এসময় ভিডিও করার কারনে তাকে ও তার সহকর্মীকে মারধর করে একুশে টেলিভিমনের ক্যামেরা ভাঙচুর করেছে র্যাব। সময় টিভির কাছে লাশবোঝাই ট্রাকগুলোর ছবি আছে। বেসরকারী হিসাব মতে ২৫ ট্রাক লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মাতুয়াইলের দিকে, ১৬ ট্রাক লাশ যায় পিলখানায়।
এই বর্বরোচিত গণহত্যার দায়িত্ব স্বীকার করেনি সরকার। বরং প্রেস নোট দিয়ে অবৈধ সমাবেশের জন্য হেফাজতকে দায়ী করেছে। বলা হয়, ঘটনার সময় কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি এমনকি কোনো কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। অপরদিকে, দু’দিন আগে হাটহাজারিতে গণমোনাজাতে আল্লামা শফি শাপলা চত্তরের গণহত্যার জন্য সরকারকে দায়ী করে জালিম সরকারকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আল্লাহর গায়েবী মদদ কামনা করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:২০