দিন বদল আসলেই হয়ে গেছে তলে তলে। আমরা বেকুব বলে টের পাচ্ছি না। আজকাল পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে লাগছে দিন বদলের তুফানী ঝাপটা। সাদাসিধে ভ্যাবলা কিসিমের তুফান না, রীতিমত কালবৈশাখী। তা বে সবই ল ভ , মিসমার। বিদ্যুত্ নিয়ে হিমালয়তুল্য তুঘলকি কা কারখানা দেশে চলমান। কত কিচ্ছা কাহিনী, নাটক, হম্বিতম্বি। এই যে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্টাফরা ৭০ লাখ টাকা, ৫ বোতল বিদেশি মদসমেত ধরা খেল, তার মতো চাঞ্চল্যকর অবশ্য নয়। এই খাতের কালো বিড়াল প্রায় অদৃশ্য, ধরা বহুত বহুত কঠিন। বিদ্যুত্হীন অন্ধকারে মহা বিল্লির তড়পানির খেসারত দিচ্ছে পাবলিক। বিদ্যুত্ বাঁচানোর জন্য ঘড়ির কাঁটার কান মুচড়ে এগিয়ে আনা হয়েছিল। এক ঘণ্টা। সে প্রকল্প লেজে-গোবরে হয়ে কেলেঙ্কারির একশেষ। জল ঘোলা হয়েছিল অনেক। শেষতক ঘড়ি দেবতার কাছে মাফটাফ চেয়ে তাকে যথাস্থানে বহাল করা হয়েছিল।
সেই কেলেঙ্কারির ভূত রূপ বদল করেছে। দিন বদলো তরিকা মোতাবেকই এই ভোল পাল্টানো। সেই ভূত সরকারকেও বেইজ্জত করেছে। একই সঙ্গে ঠ্যাঙানি দিচ্ছে পাবলিককেও। খতরনাক ভূত। যে সে ভূত না সে, মহাভূত। অতএব তার কাফফারাও যে ‘মহা’ আকারের হবে, তাতে আর সন্দেহ কী! দেশে এখন চলছে এইচএসসি পরীক্ষা। আজীব এক খবর এসেছে কুমিল্লার লাকসাম থেকে। সেখানকার এক পরীক্ষা কেন্দ্র এ খবরের উত্পত্তিস্থল। পরীক্ষার্থীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন সঙ্গে করে মোমবাতি ও দেয়াশলাই আনে। কারণ? সরল কারণ—বিদ্যুত্ বাবাজির (নাকি দুলাভাইয়ের) মশকরা। পর্যাপ্ত বিদ্যুত্ সরবরাহ নাই। সে কারণে এই ফরমান জারির আবশ্যকতা।
গত ৯ এপ্রিল ২০১২ইং সোমবার ছিল ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরুর আগে বিদ্যুত্ তেলেসমাতি। আকাশে ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা। চাদ্দিকে আন্ধাইর। অনুমান করি, আকাশে হয়তো বিদ্যুত্ চমকাচ্ছিল। তবে সেই মুহূর্তের বিদ্যুত্ ঝলকানিতে যে পরীক্ষার কাজ চলে না—সেটা হলফ করে বলা যায়।
প্রকৃতি বৈরী—বিদ্যুত্ সরবরাহ সিস্টেমও বেলাইনে। পরীক্ষার্থী বেচারারা পড়ল মহাবিপাকে। একে তো পরীক্ষার টেনশন, তার ওপর অকস্মাত্ বিদ্যুতের চটকনা। একেই বলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া। কর্তৃপক্ষ মুশকিল আসানের ব্যবস্থা করলেন। সেটার মাশুল গুনতে হলো দুর্ভাগা পরীক্ষার্থীদেরই। তাদের চাঁদা দিতে হলো। সেই চান্দার টাকায় মোমবাতি কেনা হলো। মোমের নরম আলোয় (উফ্ জানটুস, কী রোমান্টিক!) পরীক্ষা। কর্তৃপক্ষের উদারতা ও উপস্থিত বুদ্ধির কিঞ্চিত্ প্রশংসা করতে হয়। তেমন ইচ্ছা না থাকলেও করছি। ব্যস, ঘটনা একখান ঘটে গেল। জারি হলো ফরমান। এরপর থেকে মোমবাতি ও ম্যাচ বাক্স নিয়ে হাজির হতে হবে। অবশ্য যেসব ছাত্র ধূমপায়ী—তাদের পকেটে তো ম্যাচ/লাইটার এমনিতেই মওজুদ থাকে।
বিদ্যুত্ নিয়ে অসন্তোষ, গণরোষ, বিক্ষোভ বাড়ছেই। বর্তমান সরকারের হানিমুন পিরিয়ড ওভার হয়ে গেছে। কোন্ কবে! বিদ্যুত্ সঙ্কটের জন্য বিরোধী দলকে (যারা ক্ষমতায় ছিল সাড়ে পাঁচ বছর আগে) দুষে আর লাভ নাইক্যা। এতে কল্কে পাওয়া যাবে না। উদোর পি িবুধোর ঘাড়ে সব সময় কি চাপানো যায়? গেলে তো ভালোই ছিল। হা ভগবান! বিদ্যুতের দাবিতে জমির আইলে কৃষকরা মানববন্ধন করছেন। দিন বদলানির মতো কর্মসূচিও বদল হয়েছে, হচ্ছে। ভোটের মাইর আসল মাইর, চ্যাংদোলা মাইরও বটে—যা কিনা আসন্ন।
রাজশাহী শহরে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, মানববন্ধন হয়েছে বিদ্যুতের দাবিতে। ছিল গ্যাসের দাবিও। জ্বালানি উপদেষ্টা ও বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে; তারা রাজশাহীতে কোনো কর্মসূচিতে যোগ দিতে এলে প্রবেশপথে বাঁশের লাঠি দিয়ে (লগি-বৈঠা? ছি: ছি ঠেকানো হবে। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি এমনকি হরতালও ডাকা হবে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুত্ সরবরাহের দাবিতে সোচ্চার ভুক্তভোগী নাগরিকবৃন্দ। আর পানির ব্যাপার? বিদ্যুত্ নাই তো পানিও নাই। কান টানলে মাথা আসবেই। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলন। হ্যারিকেন, মাটির চুলা, গোবরের ঘুঁটে, খালি গ্যাস সিলিন্ডার, গাছের পাতা, ডালপালা নিয়ে শত শত নারী-পুরুষ নেমেছিল রাজপথে। হয়েছে মানববন্ধন ও অবরোধ কর্মসূচি। এই যন্ত্রণা বিক্ষোভ শুধু রাজশাহীতেই না— সারা দেশেই। এমএলএম সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিদ্যুত্ নিয়ে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। চাপাবাজিতে চাউর হচ্ছে তা। বাস্তবে বিদ্যুত্ মিলছে না। বেচারা বোধহয় ক্রসফায়ারে জান খুইয়েছে। কবে সেই মরদেহে প্রাণ সঞ্চার হবে, আল্লামালুম। চৈত্র-বৈশাখের ধুন্ধুমার গরম চলছে। মাঝখানে অঝোর বিষ্টি রিলিফ দিয়েছে বটে। তবে সেটা ছিল সাময়িক। সামনে তাতাপোড়া সময়।
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে—এরকম একটা কথা চালু রয়েছে। সরকারি দলের হোমরাচোমরারাই এখন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিচ্ছেন। এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে! বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা। তিনি বলেছেন, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব যখন আনা হয়, তখন সংসদীয় কমিটি এর জোরালো প্রতিবাদ করেছিল। এ পদ্ধতিটি বিনা টেন্ডারে করা হয়েছে। এখন এ খাতে কী হচ্ছে—সে ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমরাও সুবিদ আলীর মতোই কোনো মন্তব্যে যাব না। দায় কার—দুই শব্দের সংক্ষিপ্ত এই প্রশ্নটুকুই শুধু জাতির সামনে রাইল। এই খাতের কালো বিড়াল কবে ধরা খাবে?
মূল লেখকঃ হাসান হাফিয
আমার দেশ থেকে শেয়ার করা হল।