কুলসুমির বয়স হয়েছে। আগের মতো আর গায়ে জোড় নেই। ঝুলে পরেছে গায়ের চামড়া, বক্ষদেশ, নিতম্ব। তবুয় সারাদিন সস্তা লিপস্টিক, আলতা, একগুচ্ছ চুড়ি আর পুরনো একটা মেকাপ বক্স
দিয়ে চলে বয়সটাকে ৩৫ থেকে ২৩শে আনার চেষ্টা। সফল হয় কতটুকু তা সে নিজেও জানে না। তারপরও করতে হয় খদ্দরদের জন্য।
সাজতে সাজতে পুরনো দিনে ফিরে যায় কুলসুমি...
জোয়ান কালে বেশ দাপট ছিল তার। প্রতিদিন ৩-৪ জন খদ্দর আসতো। এখন তার ভাত পরেছে। ১-২ জন খদ্দর আসে মাত্র। তাও বেশিরভাগ বুড়ো। রেইটও কমে গেছে বেশ খানিকটা।
ছোটবেলায় কুলসুমির স্বপ্ন ছিল পাড়ার মাস্টার আপার মতো একজন মাষ্টার হবে। মানুষকে শিক্ষিত করবে। বড় মাঠের মাঝে বট গাছটার নিচে দাড়িয়ে মানুষকে আলোর পথ দেখাবে।
মুখে গুরুগম্ভীর আওয়াজ তুলবে...
‘শিক্ষা মানে মুক্তি। এর মানে আলো আর স্বাধীনতা। এর মানে নিজের আত্মাকে সত্যের আলোয় আলোকিত করা, একমাত্র সে সত্যই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে।’
এই ভাবে স্বপ্ন দেখিয়ে একটা সুন্দর সমাজ গড়বে।
কিন্তু সে জানেতো স্বপ্নটা সত্যি হবে না দরিদ্রতার কারনে। তবুয় সে হাল ছাড়েনি।
স্কুলে যাওয়ার পথে মুন্সি চাচার ছেলে জনু মুন্সি প্রতিদিন তার পিছু নেয়ে। সুন্দর সুন্দর গান গায়, ছড়া শুনায়। এভাবে একদিন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় জনু। জনুর সচ্ছ চোখের দিকে তাকিয়ে মানা করেতে পারেনা কুলসুমি।
তারপর থেকে প্রতিদিন বিকেল বেলা পুকুর ঘাটে দুজন মিলে স্বপ্ন আঁকে। কিছু সস্তা স্বপ্ন। একসাথে ঘড় করার, রাতের বেলা জোছনা দেখার। আর কিছু বাধ ভাঙ্গা স্বপ্ন।
একদিন হঠাৎ করে জনু বলে
-- চল আইজ তোরে নিয়া পালাই যাই।
কুলসুমি :- কই যাইবা.??
-- অনেক দূরে।
কুলসুমি :- ক্যান যাইবা..??
-- তোরে বিয়া করুম আজকা।
কুলসুমি বেশ অবাক হয় কিন্তু মানা করেনা। কারন সে জানে তার মতো গরীব মেয়েকে বিয়ে করলে জনুর বাপ কিছুতেই মেনে নিবে না। তাই
তাকে পালিয়েই বিয়ে করতে হবে।
তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধা। জনু আর কুলসুমি হাজির হয় বড় রাস্তার মোড়ে।
কুলসুমি :- কই যাইবা এহন.?
মজন :- বিল্টু ভাইগ বাইত। ঐ খানে বিয়ার সব ব্যবস্থা করা আছে।
কুলসুমি :- ত দাড়াইয়া আছ ক্যান.? চলো যাই।
জনু :- খারাও। বিল্টু ভাই গাড়ি লইয়া আইব। ঐ গাড়ি দিয়া যামু দুই জনে।
একটু পরে ঠিক ঠিক একটা গাড়ি এসে হাজির হয় বড় রাস্তার সামনে। ভিতরে ২-৩ জন। কুলসুমির বেশ ভয় লাগে। জোড়ে চেপে ধরে জনুর হাত। জনু বুঝতে পেরে সান্তনা দেয় কুলসুমিকে।
-- ডর পাও ক্যান.? কোন ডর নাই। আমি আছিতো। এরা সবাই আমাগো বিয়ার সাক্ষি। এহন গাড়িতে উঠত দেহি...
কুলসুমি কিছু বলে না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে যায়। নিচে দাড়িয়ে থাকে জনু।
কুলসুমি :- গাড়িতে উঠ না ক্যান.?
জনু :- কিছু বিয়ার বাজার সদাই আছে। তোমি যাও আমি এখনই আইতাছি।
বন্ধ হয়ে যায় গাড়ির দরজা। গাড়ির কলো কাচের ভিতর আটকে থাকে কুলসুমির ঘড় বাধার স্বপ্ন। গাড়ি থেকে নেমে তার যায়গা হয় এক মাসির বড়ি। পরে সে জানতে পারে তাকে ১৫হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়া হয়েছে যৌনদাসী হিসাবে। সেই থেকে এখানে বসবাস তার।
এইসব ভাবতে পারতে দরজায় টোকা পরে।
-- কইরে ছেমড়ি.? আছসনি ঘড়ে।
= > পয়াতি নাকি..?? অহ ঘড়ে।
পয়াতি তার পুরনো কাস্টমার। বৌ মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করেনি সন্তানের কথা ভেবে। তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে ২-১বার আসে কুলসুমির কাছে।
-- অনেক দিন উপোস আছি। খাটে আয়। তোরে নিয়া খেলি কতক্ষন।
= > হুহ.. বুড়ার শখ কতো। গায়তো জোর নাই তারপরও আহে আল্লাদ করতে।
-- আরে আহল্লাদ নারে। নেশা..নেশা... কথা কম কইয়া আয়তো দেহি। শরীর গরম আছে আজকা।
কুলসুমি আর কথা বলে না। তারপর.......
তারপর সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসে। অন্ধকারে ধর্ষিত হতে থাকে ছোটবেলার মুখ আওড়ানো বানী...
মানুষের মৌলিক আধিকার ৫টি।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা আর চিকিৎসা। ( যার কোনটাই কুলসুমি পায় না। )
সেই সাথে ধর্ষিত হয় গনতন্ত্র আর স্বাধীনতা। যাদের মনে সুন্দর ভাবে বেচে থাকার নিশ্চয়তা। যাদের মানে নাগরীকদের অধিকার।
ভাঙ্গা খাটের মরমরানি শব্দ ভেসে আসে মাস্টার আপার দেখানো স্বপ্নের আহাজারি...
অনেক বড় হতে হবে তোমাকে। শিক্ষিত হতে হবে।
‘শিক্ষা মানে মুক্তি। এর মানে আলো আর স্বাধীনতা। এর মানে নিজের আত্মাকে সত্যের আলোয় আলোকিত করা, একমাত্র সে সত্যই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে।’
কুলসুমির ভারি নিঃশ্বাসেরা আওয়াজ তোলে...
তার মতো গোলাপীদের ঘড়ে খদ্দরের বসবাস। আর ভদ্রপল্লিতে ঈশ্বরের... কারন তারা গরীব। কারন তারা অসহায়।