যামিনী দৌঁড়ায়ে এসে পুকুরের পুর্বপাড়ে একটা ঝোপের মাঝে ঢুকলো, একটা খেজুর গাছের আড়ালে বসে পুর্ব দিকে তাকিয়ে রলো; বুঝলো এরা পাকী সৈন্য; মনে ভয়, এরা কি রাস্তা থেকে নেমে মাঠে আসবে, মাকে কি গুলী করে মেরে ফেলবে? মাকে নিয়ে আসার মতো সময় ও শক্তি ওর ছিলো না সেই মহুর্তে; ট্রাংকরোডের দিক থেকে আবারো ব্রাশ-ফায়ার করলো দুইবার; সে গাছের নীচে শুয়ে পড়লো। একটু পরে, পুরো এলাকা দিনের মত আলোকিত হয়ে উঠলো; তার অবস্হান থেকে পুর্বদিকে আকাশে ৩টি লাল আলোকের গোলক বাতাসে ভাসছে, সে বসে পুরো মাঠ দেখলো; কোথায়ও কেহ নেই; তার মা, বাবা ও শফির দেহগুলো স্পস্ট দেখা যাচ্ছে; সে পুকুরটাকে ভালো করে দেখে নিলো, প্রায় পুরো পুকুরটা কচুরি পানায় ভরে আছে; তার থেকে একটু উত্তরে একটু যায়গা পরিস্কার; সে বুঝলো, পিপাসায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। প্রায় দুই তিন মিনিট পর, আলোকের গোলকগুলো নীচের দিকে নেমে এলো, নিভে গেলো; সে পানিতে নেমে পানি খেলো, মুখে ও মাথায় পানি দিলো। সে খেজুর গাছের নীচে এসে অবস্হা বুঝার জন্য পুর্বদিকে তাকিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো; তাকে ফিরে গিয়ে, মা বেঁচে থাকলে মা'কে এখানে আনতে হবে; যেই করে হোক এখানে নিয়ে আসতে হবে।
সে পুকুর পাড় থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে মাঠে নামলো; সেই সময় আবার টর্চের আলো দেখলো পুর্বদিকে; সে আগের যায়গায় ফেরত গেলো; দুইটি টর্চের আলোক ক্রমেই এদিকে আসছে; এরা কি পুকুর এলাকায় আসবে? সে একটু উত্তর দিকে সরে গেলো, ওরা যদি এইদিকে আসে সে কচুরী পানার নীচে পালিয়ে যাবে, ভাবলো। আবার ভাবলো গ্রামের দিকে পালাবে নাকি? তর্চের আলো দেখে, মনে হচ্ছে, লোক দুইজন হবে; ওরা এসে বাবা ও শফির উপর আলো ফেললো, তারপর মায়ের উপর। সে চোখ বন্ধ করে বসে রলো, মনে মনে বললো, " বিধাতা, আমাকে শক্তি দাও"। কতক্ষণ সে চোখ বুঁজেছিল তার মনে নেই; ছোখ খুলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রলো ঐদিকে; ষে দেখলো আলোগুলো ট্রাংকরোডের দিকে সরে গেছে। সে উঠে আবার পানিতে গেলো, গায়ের শার্টটা খুলে প্রথমে ধুয়ে নিল, তারপর, ভেজা শার্টে পানির রক্ষা করার জন্য পানিসহ শার্টিকে দুই হাতের তালুর মাঝে ধরে মায়ের দিকে এগুতে লাগলো; তার মন ক্রমেই ভয়শুন্য হয়ে উঠলো, সে ভাবলো, মাকে বাঁচাতে হবে, এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে; এবং আমি পারবো।
যামিনী মায়ের নিশ্বাস অনুভব করে দেখলো, মা'র শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত বইছে; সে শার্টকে চিপায়ে মায়ের চোখে-মুখে পানি দিলো; ভেজা শার্টকে কপালের উপর চেপে ধরলো; কিছুই ঘটলো না। সমগ্র শক্তি দিয়ে মাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পা পা করে পুকুরের দিকে রওয়ানা হলো; সে নিজের মনের ও শরীরে অফুরন্ত শক্তি অনুভব করলো; তার বিশ্বাস, সে মাকে বাঁচাতে পারবে; মাকে এনে খেজুর গাছের নীছে রেখে ভেজা শার্টটি ভিজিয়ে পানি এনে মায়ের মাথায় দেয়ার শুরু করলো; কয়েকবার পানি দেয়ার পর, মায়ের মুখ থেকে আওয়াজ পেলো; মায়ের মাথাকে কোলে নিয়ে, মুখে একটু পানি দিলো; সে অনুভব করলো মা পানি খাবার চেস্টা করেছে; সে আবার পানি এনে মায়ের মুখে দেয়ার সময়, মা অস্ফুটভাবে বললো, "যামিনী, মা তুই কোথায়?" যামিনী উত্তর করলো, "মা আমি আছি তোমার সাথে"।
যামিনী মায়ের চোখে মুখে আরো পানি দিলো; মাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো; সে অনুভব করছে, মা হাত নাড়ছে, বসার চেস্টা করছে। মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, " মা তুমি শুয়ে থাকো, নড়িও না, আমি আছি"। কিছুক্ষণ পর, মা বললো, "যামিনী আমার কি হয়েছে"? যামিনীর বুক ফেটে যাচ্ছিল, মায়ের কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, " মা তুমি সামান্য ব্যথা পেয়েছ, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি আছি তোমার সাথে"। যামিনী উঠে গিয়ে কোমর থেকে টাকা ও স্বর্ণের বেল্টটগুলো খুলে ঝোপের ভেতরে লুকায়ে রাখলো; পানিতে নেমে লুংগিটাকে ধুয়ে নিলো; ফিরে এসে মাকে বললো, "মা, তুমি ভয় পেয়ো না, আমি কিছুক্ষণের জন্য থাকবো না; তুমি এভাবে শুয়ে থাকো। মা বললেন, "তোর বাবা ও শফি কোথায়?"
-ওরা আছে মা; আমাদের উপর গুলি করেছে সৈন্যরা, ওরা ঐদিকে পালিয়ে আছে।
-যামিনী, আমি বসতে পারছছি না কেন, মা?
-মা তুমি শুয়ে থাক, এখন কথা বলিও না, আমি বাবাকে খুঁজে আনি।
যামিনী মাঠে নেমে, পশ্চিম দিকে গ্রামের দিকে দৌড়াতে লাগলো; ওরা যেই বাড়ীতে এই কয়দিন ছিল, সেই বাড়ির উত্তর দিকের কয়েকটা বাড়ীতে মানুষ ছিল; মাকে বাঁচাতে হলে মানুষের সাহায্য দরকার; গত আড়াই মাসে, সে বুঝেছে যে, এদেশে হাজার হাজার মানুষ আছে যাঁরা নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও সাহায্য করেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ৩:২২