নগরের পথে পথে ঘুরে ক্লান্ত হই আমরা। দিন গড়িয়ে সন্ধে নামে। ঘামে ভেজা শ্রান্ত শরীর জুড়িয়ে নিতে নিজেদের অজান্তেই পা রাখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। এখানে আজ লোকসমাগম তুলনামূলক কম। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক কম হইচই, হট্টগোল। ঘাসের আঁচল বিছানো মাঠে বসে থাকি দীর্ঘ সময়। সন্ধে গাঢ় হতে হতে রাতে রূপান্তরিত হয়। বাড়ি ফেরার তাড়া কড়া নাড়ে বুকের ভেতর। কিন্তু মনের অবচেতনে যে অন্য সুর! ভিন্ন হাওয়ার গান! মাথার অনেক ওপরে খোলা আকাশের মায়াবী পিছুটান! বাড়ি ফেরা না-ফেরার বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বে আমরা নিপতিত হই অবচেতনে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখগুলো সমর্পিত করি চাঁদ-তারা-নক্ষত্রের তীর্থক্ষেত্রে।
প্রথমেই নজর কেড়ে নেয় সুদর্শন চাঁদের অতিপরিচিত মুখটি। তারপর অন্যান্য নক্ষত্রে চোখ বোলাই।
আচ্ছা, চিত্রা নক্ষত্র কোনটি? না, জানা নেই আমাদের।
শুধু চিত্রাই নয়, দক্ষ রাজার কোনো কন্যাকেই চিনি না আমরা। অথচ দক্ষ রাজার কন্যাদের নামানুসারেই প্রতিটি বাংলা মাসের নামকরণ। চিত্রা নক্ষত্রের নাম থেকে এসেছে চৈত্র মাসের নাম। বিশাখা নক্ষত্রের নাম থেকে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ—এভাবেই এসেছে অন্য মাসের নামগুলোও।
দক্ষ রাজা ও তাঁর কন্যাদের নিয়ে হিন্দু পুরাণে সুন্দর একটি গল্প আছে।
গল্প অনুযায়ী দক্ষ রাজার কন্যার সংখ্যা এক কিংবা দুই নয়, ২৭। রূপে, গুণে ও সৌন্দর্যের বিবেচনায় রাজার ২৭ কন্যাই ২৭টি উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই নক্ষত্রদের বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র চাই। দক্ষ রাজা অনেক খুঁজেও চন্দ্রদেব ছাড়া উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পেলেন না। তাই অনন্যোপায় হয়ে তিনি চন্দ্রদেবের সঙ্গেই তাঁর ২৭ কন্যার বিয়ে দিলেন।
মহাসমারোহে বিয়ে সম্পন্ন হলেও চন্দ্রদেব পড়লেন মুশকিলে! কারণ, একা একজন স্বামী হয়ে ২৭ স্ত্রীর ঘর কী করে সামলাবেন তিনি? সমস্যাটি নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করলেন চন্দ্রদেব। অবশেষে খুঁজে বের করলেন একটি অসাধারণ সমাধান। হ্যাঁ, চন্দ্রদেব স্থির করলেন, ১২টি চক্রের ভেতর ২৭ জন স্ত্রীকে এমনভাবে ঘর বেঁধে দেবেন তিনি, যাতে প্রতি মাসে অন্তত একবার সাক্ষাৎ দেওয়া যায় তাঁদের। হিসাবমতো সে ব্যবস্থাই হলো। যে ১২টি চক্রে চন্দ্রদেব বাঁধলেন ২৭ নক্ষত্রকে, সেই চক্রগুলোই জ্যোতিষশাস্ত্রমতে ‘রাশিচক্র’।
১২টি রাশি ও ২৭টি নক্ষত্র ঘুরে আসতে চন্দ্রদেবের সময় লাগে ২৭ দিন। তারপর তিন দিন বিশ্রাম নেন তিনি। চন্দ্রদেবের একেকবারের রাশি পরিক্রমণকেই আমরা ‘মাস’ বলি। আর যে মাসে চন্দ্রদেব রাশিচক্রের যে নক্ষত্রের ওপর দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা উদ্যাপন করেন, সেই নক্ষত্রের নামানুসারেই মাসটির নামকরণ করি আমরা। যেমন, এ মাসে চন্দ্রদেব পূর্ণিমা উদ্যাপন করছে চিত্রা নক্ষত্রের ওপর দাঁড়িয়ে। সুতরাং রীতি অনুযায়ী এই মাসের নাম চৈত্র।
চৈত্র বাংলা বছরের শেষ মাস। এরপর শুরু হবে নতুন বছর। চন্দ্রদেব বা চাঁদের ১২ রাশি পরিক্রমণকে আমরা যেমন মাস বলি, তেমন সূর্যের ১২ রাশি পরিক্রমণকে আমরা বলি ‘বছর’। দিন ফুরোলেই নতুন বছরের প্রথম মাস হিসেবে যাত্রা শুরু করবে বৈশাখ।
বাংলা সনের এই প্রথম মাসের অবস্থান আদিতে কিন্তু প্রথম ছিল না। বৈদিক মতে, ঋতুচক্রে বৈশাখের অবস্থান দ্বিতীয়। ব্রহ্মাণ্ডে পুরাণের অনুষঙ্গপাদের একটি শ্লোক অনুযায়ী মাসচক্রে বৈশাখের স্থান চতুর্থ। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ আর পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের মতে বৈশাখের অবস্থান বছরের মাঝামাঝি স্থানে।
বৈশাখকে বাংলা সনের শীর্ষপাদে তুলে আনার কৃতিত্ব মোগলসম্রাট আকবরের। বছরের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখের প্রতিষ্ঠাই শুধু নয়, নতুন আঙ্গিকে বাংলা সনের প্রবর্তনও হয় তাঁর হাত ধরেই। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মোগল-সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার আগে আমাদের এই গাঙ্গেয় ভূখণ্ডে সৌরমতে বছর গণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী বছর গণনা সৌরমতে হলেও মাস গণনার পদ্ধতি ছিল চান্দ্রমতে। একই সঙ্গে দুই ধরনের গণনা-পদ্ধতির অনুসরণে প্রতিবছরই সৃষ্টি হতো ১০-১১ দিনের একটি সুস্পষ্ট তফাত। প্রতি তিন বছরে এই তফাত তৈরি করত প্রায় এক মাসের গরমিল। অনাকাঙ্ক্ষিত এই গরমিলকে ‘মলমাস’ নাম দিয়ে বছর থেকে বাদ দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল তখন। চলমান গণনাপদ্ধতির অসংগতি দূর করার এই রীতি ‘শাবনমিতি’ হিসেবে পরিচিত ছিল। সম্রাট আকবর ‘সুবে বাংলা’য় খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে নতুন ধরনের ফসলি সন প্রর্বতনের জন্য বিজ্ঞ রাজজ্যোতিষী আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে অনুরোধ করেন।
সম্রাটের অনুরোধে ফতেহ উল্লাহ সিরাজী প্রচলিত সন গণনার পদ্ধতির সঙ্গে হিজরি চান্দ্র সনের অনুকরণে সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণের বছরের সমন্বয় ঘটিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে প্রবর্তন করেন নতুন সন গণনার পদ্ধতি। পুরোনো সন গণনার পদ্ধতির জটিলতা ভেঙে মাসগুলোর পুনর্বিন্যাস করেন তিনি। ঐতিহাসিক এই পুনর্বিন্যাসের সূত্র ধরেই বাংলা সনের প্রথম মাস হওয়ার মর্যাদা লাভ করে বৈশাখ।
ছবি: সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:০৬