বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীকার আন্দোলনের যে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিলেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে জয়দেবপুরেও সৃষ্টি হল চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি। সেদিন থেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রাম শুরু হল সেখানে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চূড়ান্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হবার আগেই পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলল জয়দেবপুরের জনতা।
১৯ মার্চ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে রুখে দাঁড়াল তাঁরা। শুরু হল বাংলাদেশের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ।
ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়িতে সে সময় অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। এই রেজিমেন্টের অল্প কয়েকজন অফিসার-সৈনিক বাদে বাকি সবাই ছিলেন বাঙালি। এই রেজিমেন্টের বাঙালি অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হোসেন খান আর সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর শফিউল্লাহ। এই রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সব বাঙালি অফিসার ও সৈনিক মনেপ্রাণে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। বিশেষত সৈনিক এবং নিচের স্তরের অফিসারদের এ মনোভাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কমীরাও।
বাঙালিদের আন্দোলন দমন করার জন্য যে নীলনকশা প্রণয়ন করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, তার মধ্যে বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সৈন্যদের কৌশলে নিরস্ত্র করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যে কোন সময় দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের নিরস্ত্র করা হতে পারে এমন একটি আশঙ্কা সে সময় দানা বেঁধে উঠেছিল এই রেজিমেন্টের অফিসার সৈনিকদের মাঝে। মহাকালের অনিবার্য নির্দেশে সেই আশঙ্কাটি অচিরেই পরিণত হল সত্যে। ১৫ মার্চ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩০৩ ক্যালিবার রাইফেলগুলো সদর দপ্তরে জমা দেবার নির্দেশ এল। কিন্তু অফিসার-সৈনিকরা অস্ত্র জমা দেবার বদলে কৌশলে কালক্ষেপণ করা শুরু করলেন। সৈনিকদের এই মনোভাব টের পেয়ে পাঞ্জাবি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব ১৯ মার্চ নিজেই দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিদর্শনে আসবেন বলে জানিয়ে দিলেন। বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করার এই অপকৌশলের কথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। ১৯ মার্চ সকাল থেকেই লাঠিসোঁটা, তীর ধনুক, এমনকি বন্দুক নিয়েও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, আশপাশের সাধারন মানুষ আর সমরাস্ত্র কারখানার শ্রমিকরা দলে দলে এসে জড়ো হতে লাগলো জয়দেবপুরে।
ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব এক কোম্পানী পাঞ্জাবি সৈন্যসহ রাজবাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। সামগ্রিক পরিস্থতি বিবেচনা করে অস্ত্র সংগ্রহের আশা ছেড়ে দিলেন তিনি। হতোদ্যম হয়ে সঙ্গী সৈন্যসহ বিকেল ৩টার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন জাহানজেব আরবাব। কিন্তু হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এরই মধ্যে রাস্তায় গড়ে তুলেছে দূর্ভেদ্য ব্যারিকেড।
জয়দেবপুর রেল ক্রসিংয়ে মালগাড়ির একটা ওয়াগন এনে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে রাস্তা। ক্রুদ্ধ ব্রিগেডিয়ার রাস্তা পরিষ্কার করার নির্দেশ দিলেন রেজিমেন্ট কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদকে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। তাই তিনি এই ব্যারিকেড অপসারণে গ্রহণ করলেন নমনীয় কৌশল। তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দ মোঃ হাবিবুল্লাহ, আ ক ম মোজাম্মেল হক ও নজরুল ইসলাম খানকে ডেকে রাস্তা পরিষ্কার করার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাড়া দিলেন না অনুরোধে। জাহানজেব এবার গুলি করে রাস্তা পরিষ্কার করার নির্দেশ দিলেন।
জাহানজেবের সঙ্গী পাঞ্জবি সৈন্যরা গুলি করতে করতে অগ্রসর হলে বীর জনতাও পাল্টা জবাব দিল। তাঁরাও পাল্টা গুলি চালাল। লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুক হাতে গড়ে তুলল তীব্র প্রতিরোধ। এসময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ট্রাক টাঙ্গাইলে রেশন পৌঁছে দিয়ে রাজবাড়ি ফিরছিল। ৩ টন ক্ষমতাসম্পন্ন এই ট্রাকটিতে হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমানসহ ৫ জন বাঙালি সৈনিক ছিলেন। তাঁদের সাথে ছিল ৫টি এস এম জি। মুক্তিসংগ্রামের সমর্থক এই ৫ জন সৈনিক সিদ্ধান্ত নিলেন জনগণের পাশে দাঁড়াবার। নির্দ্বিধায় পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর গুলি চালালেন তাঁরাও। প্রতিরোধ যুদ্ধে যুক্ত হলো ভিন্ন মাত্রা।
অসম এই প্রতিরোধ যুদ্ধে জয়দেবপুর বাজারে শহীদ হলেন মনু মিয়া, নিয়ামত। আহত হলেন সন্তোষ মল্লিক, ইউসুফসহ অগুণিত মানুষ। পাকিস্তানি সৈন্যরা এবার অগ্রসর হল চান্দনা চৌরাস্তার দিকে।
চান্দনা চৌরাস্তায় পৌঁছে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হল পুনরায়। এখানে হুরমত আলী নামে এক বীর যুবক একজন পাঞ্জাবি সৈন্যকে জাপটে ধরে কেড়ে নিলেন রাইফেল। কিন্তু অপর এক পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হলেন তিনি। এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা অগ্রসর হল টঙ্গির দিকে। টঙ্গিতেও প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হল তারা। টঙ্গির প্রতিরোধ ভেঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যরা বহুকষ্টে প্রত্যাবর্তন করল ঢাকায়।
জয়দেবপুরের প্রতিরোধকামী জনতার এই বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। সমগ্র বাঙালি জাতি অনুপ্রাণিত হল অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে আওয়াজ উঠল, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:২৭