somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রথম শহীদ মিনারের গল্প

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গল্প শ্রবণের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু অভ্যস্ততা আছে। সেই অভ্যস্ততা মেনেই শীতকালে শীতের গল্প শুনি আমরা, গ্রীষ্মকালে গরমের, ডিসেম্বরে শুনি বিজয়ের গল্প, মার্চে যুদ্ধের।
কিন্তু গল্প কথন রীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পেশাদার বক্তা বাদে বেশিরভাগ মানুষের গল্পই পরম্পরাহীন। পরিস্থিতির প্ররোচনায় স্মৃতির পাঁজর আঁকড়ে ধরে জীবনের গল্পগুলো উঠে আসে সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে। সময় কিংবা কালের প্রচলিত চলন উপেক্ষা করেই বর্ণিত হয় তারা । গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্তের সীমারেখা ভেঙে যায়। ভেঙে যায় সন, তারিখের পর্যায়ক্রম মেনে চলার অভ্যস্ততার গণ্ডি। ঠিক তেমনটিই ঘটল আমাদের আলাপচারিতার ক্ষেত্রেও।
রাজশাহীর শাহ মখদুম কলেজের অধ্যক্ষ ড. তসিকুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহীতে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের গল্প শুরু করলেন বর্ষপঞ্জীর মধ্যমাসে। গল্প শুরু হতে না হতেই গজিয়ে উঠল তার শাখা-প্রশাখা। ঘটল প্রসঙ্গান্তর। গল্পের মধ্যে অন্য গল্প উঠে এল। প্রাসঙ্গিকভাবেই জানা গেল তসিকুল ইসলামের ছোটবেলার গল্পও।



১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গল্প বর্ণনাকারী তসিকুল ইসলামের জন্ম কিন্তু ১৯৫৩ সালের ১১ জানুয়ারি। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার বালিয়াঘাটা গ্রামে জন্ম তাঁর। বাবা সাজ্জাদ আলী ছিলেন কৃষিজীবী। মা জায়েদা খাতুন গৃহিনী। বাবা মায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান তসিকুল ইসলামের ছোটবেলার গল্প তাই কষ্টের মলিন কাগজে মোড়ানো। শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরেই কাশিমপুর ফজলুল হক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে এস.এস.সি. পাস করলেন তিনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ থেকে অতিক্রম করলেন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু করলেন নানা ধরনের সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। সেই সব কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে দেশ ও দশের প্রতি সৃষ্টি হল দায়িত্ববোধ।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে অধ্যাপনায় যোগ দেবার কিছুদিন পর ভাষা আন্দোলন বিষয়ক গবেষণাকাজ শুরু করলেন তসিকুল ইসলাম। রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের একটা স্বচ্ছ চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করলেন তিনি। ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন বই পুস্তকের সাহায্য নিলেন, পর্যালোচনা করলেন তৎকালীন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন, পরীক্ষা করলেন প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত, দলিল দস্তাবেজ। এছাড়াও রাজশাহীর বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামীদের সাথে পৌনঃপুনিক কথোপকথনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত বেশ কিছু অপ্রকাশিত সত্যের কাছে পৌঁছলেন তিনি।
সে সব সত্যের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য কোনটি? জানতে চাইলাম গবেষক তসিকুল ইসলামের কাছে।
উত্তরে তিনি জানালেন একটি শহীদ মিনার নির্মাণের কথা। তসিকুল ইসলামের গবেষণালব্ধ তথ্যানুসারে রাজশাহী কলেজের নিউ মুসলিম হোস্টেলের প্রধান ফটক সংলগ্ন সামান্য অভ্যন্তরে নির্মিত সেই শহীদ মিনারটিই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার!
তসিকুল ইসলামের উচ্চারিত বাক্যটি কৌতূহলের জন্ম দিল আমাদের মধ্যে। সেই কৌতূহল নিবারণের দায় নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন তিনি। নিস্তরঙ্গ গল্পটি এবার বাঁক বদল করল। শুরু হল উত্তেজনায় ভরা নতুন গল্প!

নতুন এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র স্বাভাবিকভাবেই রাজশাহীর ভাষাসংগ্রামীরা। এ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, এ্যাডভোকেট মহসীন প্রামাণিক, এ্যাডভোকেট সৈয়দ আমীর হোসেন স্পেন, ডাক্তার এস. এম. এ. গাফফার, সাংবাদিক সাইদউদ্দিন আহমদ, আবদুল মালেক খান, এ্যাডভোকেট মো. আব্বাস আলীসহ রাজশাহীর প্রায় সকল ভাষাসংগ্রামীদের বক্তব্য অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ক্রোধে উন্মাতাল ছিল সংগ্রামমুখর রাজশাহীর রাজনৈতিক অঙ্গন।
ঢাকায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহতের খবর রাজশাহীতে এসে পৌঁছানো মাত্রই শুরু হয়েছিল খণ্ড খণ্ড মিছিল। সন্ধ্যা গাঢ় হবার পর রাজশাহী কলেজের নিউ মুসলিম হোস্টেলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি ছাত্রসভা। সেই সভায় পরদিনের কর্মসূচী হিসেবে রাজশাহীতে সর্বাত্মক হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত তো হয়ই, এছাড়াও গৃহীত হয় ভাষা শহীদদের স্মরণে একটি মিনার কিংবা স্তম্ভ নির্মাণের ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত।
অনন্য সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তখনই কাজ শুরু করে ছাত্ররা। তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে এলাকার বেশ কিছু সাধারণ মানুষ। ২১ ফেব্রুয়ারি সারা রাত ধরে কাজ করে তাঁরা। ইট এবং কাদা দিয়ে নিউ মুসলিম হোস্টেলের প্রধান ফটকের সামনে নির্মিত হয় বাংলাদেশের প্রথম শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ।

স্মৃতির অতলে চাপা পড়া এই গল্পের ভিত্তি কি শুধুই রাজশাহীর ভাষাসংগ্রামীদের প্রদত্ত বক্তব্য কিংবা গৃহীত জবানবন্দী? খানিকটা সংশয় ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করি আমরা।
না, প্রশ্নের উত্তরে দৃঢ়স্বর তসিকুল ইসলামের। তিনি একটি আলোকচিত্রের প্রতি দৃষ্টি দেবার অনুরোধ জ্ঞাপন করলেন এবার। প্রয়াত ভাষাসংগ্রামী এ্যাডভোকেট মহসীন প্রামাণিকের সৌজন্যে প্রাপ্ত সেই আলোকচিত্রটি বিস্ফারিত চোখে প্রত্যক্ষ করলাম আমরা।
হ্যাঁ, একটি শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ প্রতিভাসিত সেখানে! এবং ড. তসিকুল ইসলামের গবেষণালব্ধ তথ্যানুসারে এটিই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার!




সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৪১
২৭টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×