বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর TRP অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে ভারতীয় ও পশ্চিমা চ্যানেলগুলোর জাঁকজমকপূর্ণ উপস্থাপন, দেশের চ্যানেলের দুর্বল মান ও অব্যবস্থাপনার কারনে। এরপরও ঈদ এর সময় দেশের চ্যানেলগুলো বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি দর্শকদের সাড়া পায় । ৩০ মিনিট এর নাটকে যোগ হয় ৪৫ থেকে ৬০ মিনিটের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনজনিত সমস্যার কারনে এই সময়েও মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মেধাবি অভিনেতাদের আর সেভাবে মূল্যায়ন করা হবে না , দেশের পণ্যগুলো প্রচারে কোটি কোটি টাকা খরচ করেও ভোক্তাদের কাছ থেকে সেরকম সাড়া পাবে না। পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতির উপরও একটা বড় প্রভাব পড়বে। এ জন্য বিশ্বায়নকে রুখে দিলে চলবে না, পরিবর্তন করতে হবে দেশের বিনোদন মাধ্যমগুলোর মান।
আমাদের দেশের দর্শক মুলত কয়েক ধরণের আছে।
১) যারা সাড়া বছর ভারতের সিরিয়াল দেখে ঈদ এর সময় হাতে গোনা কিছু প্রোগ্রাম এর জন্য চিরকালের নিয়ম ত্যাগ করে বাংলা চ্যানেল চোখ দেয়। মুলত নারী।
২) টক সো, দুর্নীতি বিষয়ক কিছু প্রোগ্রাম ও সংবাদ দেখে আর বাকি সময়ের প্রতি তাদের কোন আগ্রহ নেই তাই রিমোট গিন্নির হাতে ছেড়ে দিয়ে কোনক্রমে বাচে আরকি
৩) উদীয়মান তরুনসমাজ। এরা ভারতীয়, ইংরেজি গানের চ্যানেলে বেশি চোখ দেয়। তাছাড়া গবেষণামূলক চ্যানেল যেমন ঃ ডিসকভারি, NATGEO, History ইত্যাদি, তাছাড়া ইংরেজি সিরিয়াল দেখার দিকেও তাদের আগ্রহ আছে।
৪) ক্রীড়াপ্রেমী । এই গ্রুপে দেশের অধিকাংশ মানুষ পরে যখন দেশের খেলা হয়। তাছাড়া তরুন বয়সের অনেকে নিয়মিত খেলার চ্যানেলগুলোর দিকে বেশি চোখ রাখে। তবে এই চ্যানেলগুলো সব বিদেশী। English-Spanish League, IPL, UEFA ইত্যাদি দেখা হয়।
( Sidenote: IPL এর সময় দেশের TRP সবচেয়ে কম হয়ে আসে)
উপরের ৪ শ্রেণীর মানুষই ঈদ এর সময় দেশের প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে দেশের মায়ায় সবসময় চলে আসা একটা ট্র্যাডিশন এর মতো সবাই এক সাথে বাংলা চ্যানেলে অনুষ্ঠান দেখতে চায়।
ঈদ এর কিছু দিন আগে থেকে অনুষ্ঠানের চোখ-ধাঁধানো বিজ্ঞাপন দেখে ও জনপ্রিয় অভিনেতাদের উপস্থিতি দেখে আমরা নির্ধারণ করি এই নাটক বা অনুষ্ঠানটা দেখা উচিত। ধরুন তা শুরু হবে ২ টা ৩০ মিনিটে। আর পরের প্রোগ্রাম ধরেন ৪ টায়। অর্থাৎ ৯০ মিনিটের প্রোগ্রাম। তাহলে ধরে নিতে পারা যায় এ প্রোগ্রাম আসলে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের বাকি সময়টুকু বিজ্ঞাপনের দখলে। দেশের বিজ্ঞাপনব্যাংক পরিচিত কিছু সবুজ লোগোর চ্যানেলে ৯০ মিনিটের প্রোগ্রামে ৬০ মিনিট বিজ্ঞাপনের দখলে থাকে।
বিজ্ঞাপন দৈরাত্বের প্রভাব ঃ
অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের কারনের যে সকল সমস্যা হয় তা হল
১) সাধারন দর্শকরা হতাশ হচ্ছে। কোন প্রোগ্রাম ঠিকভাবে দেখতে পাচ্ছে না। ঈদ এর সময়ও ভারতীয় ও পশ্চিমা চ্যানেলের দিকে চোখ যায়। আর ওদের উপস্থাপন কৌশল এতোটাই ভিন্ন যে কোন অংশ শেষ না হলে চ্যানেল বদলাতে ইচ্ছা করবে না
কারনঃ দেশের ভাল মানের নাটক করার জন্য প্রয়োজন ভাল বাজেটের। আর ৩০ মিনিটের প্রোগ্রাম এ ৩০ মিনিটের বিজ্ঞাপন দিয়ে পোষায় না । ফলে নাটক নির্মাতারা বাধ্য হচ্ছে এমন করতে।
২) আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের দেশের বিজ্ঞাপনগুলো অনেক মান সম্মত, কম পক্ষে ভারতের জোড় করে হজম করানো বিজ্ঞাপন থেকে অনেক ভাল।
কারনঃ এটা আসলে আমাদের মেধার ফসল। তবে এর পিছনে সবচেয়ে বড় হাত দর্শক। আমাদের দেশের দর্শকদের বিজ্ঞাপনগুলো অনুষ্ঠানের মতো উপভোগ করানোর জন্য এই ষড়যন্ত্র। ( এটাই একমাত্র পজিটিভ প্রভাব )
৩) ভারতীয় চ্যানেলে এই সময়েও দর্শক চলে গেলে প্রথমত ঈদ এর সময় চলে আশা বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ও ব্যয়বহুল নাটকগুলো ব্যবসা সফল হবে না কারন TRP কমে গেলে বিজ্ঞাপনের মূল্য কমে যাবে আর অভিনেতাদের ও নাটক ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করা সবভব হবে না।
৪) দেশের বিজ্ঞাপনগুলো না দেখলে দেশের পণ্যগুলোর জ্ঞানমূলক প্রতিবন্ধকতা আর দূর হবে না। ফলে দেশি পণ্য পাবে না ভোক্তাদের সাড়া । ফলে দেশের পণ্য হারাবে তাদের দাম
৫) আজ বিদেশী প্যাকেটজাত পণ্য দেশের বাজারে ভরে গিয়েছে আর অনেক ক্ষেত্রে কিনাও হচ্ছে দেশের পণ্য থেকে অনেক বেশি। এর মূল কারন ওদের চ্যানেল। আমরা যখন ওদের চ্যানেল বিজ্ঞাপনগুলো যখন দেখি তখন কিছু পণ্যের জন্য এক অপ্রয়োজনীয় চাহিদার সৃষ্টি হয়। এভাবে সীমানা ছাড়িয়ে সেই পণ্য জায়গা করে নেয় আমাদের ঘরে। চিপস, চকলেট, লজেন্স থেকে শুরু করে লাখ টাকা দামের পোশাক,গয়না।
আসলে বিদেশী ( বিশেষ করে ভারতীয়) চ্যানেল বন্ধ করে কোন লাভ নাই, আমরা কয়টা চ্যানেলই বা বন্ধ করবো। বিশ্বায়নকে বন্ধ করা সম্ভব না। YouTube, Facebook বন্ধ যেমন জনগন মানতে পারেনি। চ্যানেল বন্ধ করলেও এটা মানতে পারবে না।
আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো এখন একটা পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করছে। তবে এতে কোন ভাল ফল দিবে বলে মনে হয় না। তা হল ভারত অনুসরণ। ভারত আসলে আমেরিকা ও ইউরোপ এর অনুষ্ঠানগুলো নকল করে আর একটু মসলা যোগ করে যা আমাদের উপমহাদেশ এর মানুষের চিন্তাভাবনা ও সংস্কৃতির সাথে মানানসই । আপনারা iifa award( india) আর British Academy Award মিলিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন। ভারত বেশি বিনোদনমূলক করে, আর পশ্চিমারা করে অনেক অভিজাত।
আমাদের ভারত অনুসরণ না করে তৈরি করতে হবে আমাদের সংস্কৃতির সাথে মানানসই অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশের নাটক বা বিজ্ঞাপনের মানের তেমন একটা দোষ দিব না। আমরা এমন অনেক নাটক বানাই যা আক্ষরিক অর্থে ভারতীয় অতিরঞ্জিত অনুষ্ঠানগুলো থেকে অনেক ভাল। কিন্তু সমস্যা হল দেশে ভাল নাটকের সংখ্যা অনেক কম। আর এই কারন বাজেট। সেই বাজেট বেশি করতে গিয়ে নাটক নির্মাতারা বাধ্য হচ্ছে বিজ্ঞাপনের সময় বাড়াতে, টাকা অসুল করার জন্য। অন্যদিকে এই টাকা উসুলের জন্য অতিরিক্ত সময় বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে এর কারনও কিন্তু বিদেশী চ্যানেল। TRP কমে যাওয়ার ফলে দেশের বিজ্ঞাপনের দাম কম। যার ফল পড়ছে প্রথমে নাটক নির্মাতাদের, এরপর অভিনেতাদের, দেশিয় পণ্যদের আর সবচেয়ে সবচেয়ে বড় ক্ষতিতে পড়ছি আমরা ও দেশের অর্থনীতি।
এখন এমন বিদেশী (বিশেষ করে ভারতীয়) চ্যানেলের কারনে দেশের বিনোদন মাধ্যমগুলো অনেকটা জিলাপির প্যাচ এর মধ্যে পড়েছে। এখান থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য প্রথমে পোহাতে হবে লোকসান , এর পর দেশের Electronic Media গুলো যখন একটা ভাল অবস্থায় আসবে যখন এভাবেই চলবে রমারম ব্যবসা।আলাদা করে হিন্দি চ্যানেলকে গালি দিতে হবে না । কিন্তু কেউ এই ঝুঁকি নিতে নারাজ।
এক সুন্দর ভবিষ্যতের আশার বিদায় নিচ্ছি। ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:৪৯