হঠাৎ করেই দেশে ছোটখাট একটা ট্যুরের সময়ও সুযোগ পেয়ে গেলাম । জানুয়ারীর ৭ তারিখ স্টুটগার্ট এয়ারপোর্ট থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুল হয়ে ঢাকার পথে তাই তার্কিশ এয়ারের টিকেট কেটেই ফেললাম। ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ারের কাজের প্রেসারের পরে একটা ব্রেক মৌলিক অধিকারে পরিনত হয়েছে যদিও মাত্র ৩ সপ্তাহের জন্য তার পরেও খারাপ কি , প্রায় আড়াই বছর পরে দেশে যাবার সুযোগের সাথে আর কিছুর তুলনা হতেই পারে না।
যেহেতু জানুযারী মানেই স্নো পড়ার সম্ববনাই বেশি আর মাশআল্লাহ ব্ল্যাক ফরেস্টেতো আরো একটু বেশিই তাই আগাম প্রস্তুতি হিসেবে কিছুটা সময় হাতে নিয়ে বের হবার প্ল্যান আমাদের আগেই ছিল। আমাদের বাসা থেকে এয়ারপোর্টের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের মত , তাই ৭০ মিনিটের মত সময় লাগে গাড়িতে বলে জানাল আমার বস। আর আমার এয়ারপোর্টে আনা নেবার দায়িত্ব আমার বসই স্ব-ইচ্ছায় নিজের কাধে তুলে নিতে চাইতেই আমিও সানন্ধ্ রাজি হয়ে গেলাম ।একেতো শীতের দিন , তার উপর স্নো আর এই সাতসকালে লাগেজ নিয়ে ট্রেন আর বাসের ঝামেলার চেয়ে আরাম করে গাড়ির সামনের সিটে বসে যাওয়া আসা মজাই আলাদা। স্টুটগার্ট থেকে ফ্লাইট সকাল ১১.৪০ হলেও আমরা সকাল ৮টা দিকেই বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম । যেহেতু আমরা ব্ল্যাক ফরেস্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আর মাঝে মাঝেই সমতল থেকে চার /পাচশ মিটার উচু পাহারী এলাকা/বন পেরুতে হচ্ছে তাই স্নো এর মাঝ দিয়ে এগুতে হচ্ছে ।আর স্নো মানেই গাড়ির গতি কমাতে হবে আর সতর্ক হয়ে চালাতে হবে। আর এই জন্য হাইওয়েতে গিয়ে স্পীড বাড়াতে হবে ।
অনেকতো বকবক হল চলুন এবার ছবিতে ছবিতে আমার সাথে ঢাকা পর্যন্ত। যেহেতু স্নো এর জন্য আমাদের গাড়ির স্পীড কমাতে হয়েছিল তাই হাইওয়েতে উঠার পরে গাড়ীর স্পীড কততে উঠানো হল তা দেখুন ।
বেশি না ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটার মাত্র। এইতো সামনের রোড সাইনে দেখা যাচ্ছে স্টুর্টগার্ট এয়ারপোর্ট আর মাত্র ১ কিলোমিটার ।
আমরা প্রায় চলেই এসেছি এয়ারপোর্টে
এইতো সামনে দেখা যাচ্ছে পার্ক হাউজ ।এখানে গাড়ী রেখে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকে পড়া যাক ।
এইতো তার্কিস এয়ারের কাউন্টার দেখা যাচ্ছে । লোকজন এখনও আশা শুরু করে নি ।আর কাউন্টারও খালি দেখা যাচ্ছে।
যাক অবশেষে লোকজন আশা শুরু হয়েছে, চলুন তাহল বোর্ডিং পাস নিয়ে নেই।
বোর্ডিং পাশতো নেয়া হল এবার দেখে নেওয়া যাক কোন গেটে যেতে হবে। গেট ১০৯ ।তার আগে সিকিউরিটি চেকপোস্ট পার হতে হবে।
যাক কোন রকম ঝামেলাছাড়াই সিকিউরিটি চেকপোস্ট পার হতে পারলাম । এইতো সামনের সাইনে ডিরেকশন দেয়া আছে।
মনে হয় আমরা চলে এসেছি।
হ্যা আমরা ঠিক জায়গায়ই এসেছি। এখনও সময় থাকায় লোকজনের সমাগম এখনও হইয় নি।
যেহেতু হাতে সময় আছে বসে বসে ফেসবুকিং করা যায়
সময়তো হয়ে গেছে কিন্তু বোর্ডিংতো দুরের কথা প্লেনেরইতো খবর নাই , দেখিতো বোর্ডিং পাশ চেক করে। না ঠিকইতো আছে। ও আচ্ছা বোর্ডে দেখাচ্ছে ফ্লাইট ৫০ মিনিট ডিলে ,বলে কি আমার পরের ফ্লাইটের আগেতো ১ ঘন্টা ২৫ মিনিটের মত সময় আছে । তাইলে…ধুর পরে দেখা যাবে নে ।
যাক প্লেন চলে এসেছে আর বোর্ডিং ও শুরু হয়েছে ।চলুন এবার প্লেন উঠা যাক।
যাক সিট পাওয়া গেল এমনিএ প্লেন দেরি করে আসছে তার উপরে আবার যদি সিট না পাই তাইলেতো অবস্তা কাহিল । একি কান্ড সিটের সামনে দেখি টিভি ও আছে
সিটেতো বসলাম কিন্তু জানালোতো দেখি খোলা যায় না। তাইলে কেমনে কি, যদি মাঝ রাস্তায় গরম লাগে তাহলে ? মেঘের ভেতর দিয়ে যাবার সময় মেঘ ধরব সেটা আমার ছোট বেলার শখ ।
যাক প্লেন এইবার চলা শুরু করছে আর আমাদেরকে দড়ি (দুঃখিত সিট বেল্ট) দিয়ে সিটের সাথে নিজেকে বেধে নিতে বলতেছে।
একে প্লেনতো উপরের দিকে উঠা শুরু করছে, দেখিতো জানালা দিয়ে নিচের মানুষ জন কেমন দেখা যায়
আস্তে আস্তে আরো উপরে উঠতেছে দেখি। আর নিচের দিকের বাড়িঘড়ও ছোট হয়ে যাচ্ছে।
এইতো দূরে আমাদের বাসা দেখা যাচ্ছে , ব্ল্যাক ফরেস্টের মাঝে আমাদের বাসার ছাদ
এই বারতো আমি স্পস্টই দেখতে পারতেছি আমাদের বাসার পাশে সাদা সাদা তুশারের স্তুপ ।
যাক অনেকতো জানালা দিয়ে বাসা দেখা হল , এদিকে সকাল বেলা ২পিছ ব্রেড কোনরকম খাইছি , পেটে এতক্ষনে সিগনাল দেয়া শুরু করছে । প্লেনের লোকজন মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারছে আর দুপুরের খাবারের ও টাইম হয়ে আসছে , তাড়াতাড়ি দেইখা নেই কি দিব দুপুরে খাইতে ।
ওমা বেভারেজে দেখি হুইস্কি , জিন, ভোদকা সবই আছে, সব কয়টাই দিব নাকি ? হায় আমি না টিকেট কাটার সময় ভাল ছেলে সেজে মুসলিম ফুড সিলেক্ট করে রাখছিলাম । আচ্ছা এটা কি তাদের মনে আছে?
যাক খাবার চলে এসছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নেই যদি পরে আবার ফেরত নিয়ে নেয় ।
যাক ভাত, চিকেন আর বিফ স্টেক ,সাথে সবজি আর ডেসার্ট ও ছিল । ভালই একটা খাবার হল ।এবার বাইরে একটু দেখে নেয়া যাক সবকিছু ঠিক ঠাক আছে কিনা।
নাহ পরিচিত কোন বাড়িঘর চোখে পড়তেছেনা। খালি তুষার আর তুষার দেখি ।। আমরা মনে হয় তুরস্কের কাছা কাছি চলে এসছি। প্লেনের ম্যাপ আর ঘোষনায় তাইতো বললো । কিন্তু নিচে খেলনার মত দেখতে এইগুলা কি ?
ও আচ্ছা , ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্ট মার্মার সাগরের ঠিক পাশে হওয়ায় সাগরের মাঝ দিয়ে যে সব জাহাজ যাচ্ছিল সেগুলো দেখা যাচ্ছিল । আমিতো মরুভুমি ভাইবা বসে আছি।
না মরুভুমি না এতো দেখি রীতিমত তুষার পাত হচ্ছে । যেখানে স্টুর্টগার্ট এয়ারপোর্টের তুষার নাই সেখানে এই খানে তুষারে ঢাকা রানওয়ে । হায় রে, কপালে কি জানে আজকে।
আচ্ছা এই তুষারের মধ্যে প্লেন যদি পিচ্ছিল খায় তাইলে কি হবে? আপনারা ভাবতে থেকেন এদিকে আমার পরের প্লেনের সময় আছে মাত্র ৫০ মিনিট আর প্লেনের কানেটেট ফ্লাইটের ইনফোতেতো আমার ঢাকার ফ্লাইটের কোন ইনফোই দেখতেছিনা ।
টেনশন বাড়তেছে আর পরের প্লেনে উঠুম কি তুষারের জন্য এই প্লেনই কি আজকে নামতে পারব কিনা সেটাই কথা ।
প্লেন থামতে দেরি কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পরের প্লেনের জন্য দৌড় দিতে দেরি নাই । হাতে আগে থেকেই পাসপোর্ট আর রেসিডেন্ট পার্মিট আর টিকিট নিয়ে দে দৌড়।
ও আইচ্ছা , এই তাহলে কাহিনী । বেশি না মাত্র সাড়ে পাচ ঘন্টা। হায় রে এতদিন জানতাম খালি ঢাকার বাস আর ট্রেনেরই দেরি হয়, এখন দেখি প্লেলেনেরও দেরি হয়। কি আর করার একটু ঘুইরা আসি এয়ারপোর্ট থেকে…
ডিউটি ফ্রি হইলে কি হবে দেখিতো খালি সিগারেট আর বাহারী রকমের অ্যালকোহলের পসরা আর পেমেন্টতো সব লিরায়(তার্কিশ মুদ্রায়) দিতে হবে ,আর ইউরোতে পেমেন্টের সুবিধা সবার কাছে নাই, থাকলেও এক্সচেঙ রেটের যা করুন অবস্তা।
কথায় আছে না অভাগা যেদিকে যায় ম্যাগডোনাল্ডস, বার্গার কিং ও সেদিকে যায়। যেহেতু আমাদের পরের প্লেনে ডিনারের ব্যাবস্তা ছিল, আর প্লেন প্রায় সাড়ে পাচ ঘন্টা ডিলে তাই ডিনার হিসেবে ঢাকার সব যাত্রিদের জন্য বার্গার কিং এর খাবারের ব্যাবস্তা।
বার্গাং কিংয়ে গিয়েতো দেখি ওয়াসার পানির লাইন আর ডেসকোর বিদ্যুত বিলের লাইন ও ফেল মারবে এই লাইনের কাছে। বেশির ভাগই তার্কিস এয়ারের ডিনারে আসছেন। চারপাশের বাংলা কথপোকথন শুনে যে কেউ হঠাত করে বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারেন যে তিনি কি ঢাকায় না ইস্তামবুলে ?
একি বার্গার আর কোক খাওয়ায়া দেখি ফ্লাইট আরো ২ ঘন্টা পিছাইয়া দিল। মেজাজতো চরমে এতক্ষনে দেশের কাছাকাছি থাকার কথা আর এখন বার্গার খাওয়াইয়া বসাইইয়া রাখছে।
কি আর করার বসে বসে বাইরে প্লেনের আসা যাওয়া আর চারপাশে বিশ্লেষন ধর্মী মাঝ রাতের টকশোর আলোচনা শুনছি।তুরস্কের ইস্তাম্বুলের এই টকশোর আলোচনার সম্মানিত আলোচকের একেক জন একেক দেশের প্রবাসী বাংলাদেশী । তবে আজকের টকশোর কোন নির্ধারীত বিষয় নেই। প্রবাসে থেকেও যে দেশের রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক চিন্তিত আর প্রবাসের শ্রম বাজার নিয়ে গুরুগম্ভীর সব আলোচলা।
যাক অবশেষে তার্কিস এয়ারের লোকজনের মনে সহানুভূতির উদয় হইল নাকি মাঝ রাতে আবার বার্গার না হয় বিরিয়ানী দিতে হবে এই ভয়ে প্লেনের সিডিওল আর পিছাল না। অবশেষে প্লেনে উঠতে পারলাম । কিন্তু উঠার আগে ও উঠার সময় এবার সত্যি সত্যিই ভয়ে ছিলাম আমার সিট আছে তো নাকি আমাকে রেখেই চলে যাবে। চার পাশের সবাই এইত তাড়াহুড়ু আর ধাক্কা ধাক্কি করছিল মনে হচ্ছিল কার আগে কে সিট দখল কবরে । দেশের থাকার সময় বনানী টু মতিঝিল ৬ নাম্বার বাসের মতই লাগছিল । যাক না এবারো সিট পাইলাম ।
বাইরে তখন মাঝরাত
কিছুক্ষন পরে রাতের খাবার আসল,সকালের আসার সময়ের সেই এনার্জি আর নাই আর বার্গারের এনার্জি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে ।
যাক ভাল একটা খাওয়া হল । প্রায় সাড়ে ৬ ঘন্টার জার্নি এবার যদিও সাড়ে ৮ ঘন্টার কথা ছিল । এসব ভাবার সময় নেই এবার ঘুমের সময়।
বাইরে ইতি মধ্যে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে আর সকালের নাস্তারও সময় হয়ে গেছে।
সকালের সোনালী আলো
দেখতে দেখতে আমরা প্রায় ঢাকার কাছাকাছি চলে এসেছি। আর কিছুক্ষন পরেই আমাদের প্লেন ল্যান্ড করবে।
এইতো নিচে ব্যস্ত ঢাকার জনবহুল বাড়ীঘর দেখা যাচ্চে
ল্যান্ড করার আগ মুহুর্তের দৃশ্য
১২ ঘন্টার ফ্লাইটের জায়গায় প্রায় ২৫ ঘন্টার দীর্ঘ যাত্রার পরে ইমিগ্রেশনে ৩ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরে আর কোন ছবি উঠানোর মত এনার্জি আর ইচ্ছা কোনটাই ছিল না। ধন্যবাদ এতক্ষন ধৈর্য ধরে সাথে থাকার জন্য। আর এখাইনেই শেষ হচ্চে স্টুটগার্ট টু ঢাকার জার্নি। ভাল থাকবেন।
লেখাটি পুর্বে জার্মান প্রবাসে ওয়েবে প্রকাশিত হয়েছে -http://www.germanprobashe.com/archives/3515