জগৎ ও জীবনের স্বরুপ উৎঘাটনের প্রচেষ্টাই হলো দর্শন। এ প্রচেষ্টা সর্বকালে সর্বজাতিই করে আসছে বলে দর্শন কোন ব্যাক্তি, জাতি, দেশ বা যুগের একচেটিয়া সম্পদ নয়। অন্যান্য জাতির মত মুসলিম জাতির মধ্যে এরকম প্রচেষ্টা সর্বযুগে লক্ষ্যনীয়। তবে আমার মতে, মুসলিম দর্শন ও ইসলামিক দর্শনের মধ্যে ফারাক বুঝতে পারাটা জরুরী।
সাধারনত ইসলামিক দর্শন বলতে কুরআন ও হাদিসের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ন কতগুলো দার্শনিক চিন্তাধারাকে বুঝায়। অন্যদিকে মুসলিম দর্শন বলতে আমরা জগৎ ও জীবন বিষয়ক এমন একটি সর্বাঙ্গীন ধারনা বুঝি যা কুরআন হাদিসের সাথে সঙ্গতিপূর্ন অথচ মুসলিম জাতির ইতিহাসে বিভিন্ন পর্যায়ে যুগের আলোকে আলোচিত। এদিক দিয়ে বলতে গেলে ইসলামিক দর্শনের চেয়ে মুসলিম দর্শনের পরিসর অনেক ব্যাপক।
আমাদের বাংলাদেশের পার্সপেক্টিভেও এই দ্বান্দিক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার ভিউস, নর্মস, রিচুয়াল, আচার ঐতিহ্য আমরা পালন করে আসছি বর্ন ধর্ম নির্বিশেষে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের পুর্বপুরুষগণ ছিলো বৌদ্ধ ও সনাতনি ধর্মের অনুসারি। বর্তমানে মুসলিম অধ্যুষিত হবার পরো আমরা এই সংস্কৃতির বাহিরে যেতে পারিনি। এটাই আমাদের শিকড়। আমাদের পাঞ্জাবী, ধুতি, পহেলা বৈশাখের ধরন, গায়ে হলুদ, ভাষ্কর্য কিংবা মোমবাতি প্রজ্জলন সবকিছুই এর অন্তর্গত। সমস্যা হচ্ছে সকল ধর্ম নির্বিশেষে আচার অনুষ্ঠান পালনের এই বাঙ্গালী রীতি ইসলামিক দর্শন ও ঐতিহ্যের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক যা জাতিগত ভাবে আমাদের দোটানায় ফেলে দেয়। এ কারনেই পহেলা বৈশাখে নাচ গান করা নিয়ে সৃষ্টি হয় নানা ইস্যু। এমন কি অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাষকর্য কিংবা লালনের মূর্তি নিয়েও আমরা প্রশ্ন তুলতে দ্বিধা করিনা।
লালনের মূর্তি নিয়ে যেহেতু কথা উঠলো, বাউল এবং সুফিজম নিয়েও কিছু কথা বলা লাগে। মুসলিম দর্শনে আমাদের উপমহাদেশে সুফিজমের একটা বিরাট যায়গা রয়েছে।
বাংলাদেশে দশম শতাব্দীতেই সুফিজমের আবির্ভাব। ঐ সময় হতেই এ উপমাহাদেশে ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান ও আরব থেকে অনেক সুফিগন আমাদের দেশে এসেছিলেন। কালের আবর্তনে আদী সুফি দর্শনের সাথে এদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাবধারার সংমিশ্রন ঘটে। অন্যদিকে বৈষ্ণববাদ এবং সুফিবাদের মত বাউলবাদও বাংলাদেশের প্রেম দর্শনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রেখেছিলো। সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন লাভ অফ গড রাদার দেন ফিয়ার অফ গড - এই কনসেপ্ট কে আমরা ইসলামিক দর্শনের দৃষ্টিতে বিচার করতে চাই। এ ব্যাপারে অন্যকোন দিন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
যাই হোক, আমি আসলে কিছুটা চিন্তায় আছি। আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নেগেটিভ ব্যাপারগুলো এত প্রকট ছিলোনা আগেও। আমরা নিজেরাও ধর্মগত দিক থেকে এত সেনসেটিভ ছিলাম না। এখন পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে, এক ধর্মকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় দাঙ্গা হাঙ্গামা, ভোটিং রাজনীতি, হেফাজত- শাহবাগ, মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুর মাঝে একটা লাইন টেনে দেয়া হয়। অথচ ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, মুক্তবুদ্ধির চর্চাতে মুসলিম রা কিন্ত এই উপমহাদেশে বেশ অগ্রগামী ভুমিকা পালন করেছিলো।
সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তিকালে নবাব আব্দুল লতিফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন "মহামেডান লিটারারি সোসাইটি", মুসলিম জাতিগোষ্ঠির উন্নয়নে তার এজেন্ডা ছিলো- মুসলমান দের মধ্যে মুসলমান দের পাশ্চাত্য ভাবধারার সাথে পরিচয় করিয়ে সেখানে একটা একটা অবস্থান তৈরি করা। যদিও তার এই প্রচেষ্টা দরিদ্র মুসলমান সমাজে তেমন সুফল বয়ে আনেনি, তবে মুক্তবুদ্ধির ক্ষেত্রে এই অরগানাইজেশন ফার্স্ট মুভার হিসেবে একটা প্রাক্টিস তৈরি করে দিয়েছিলো। পরবর্তিতে নবাব আমীর আলী খান এর প্রতিষ্ঠায় "ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন" এই প্রিন্সিপাল ধরে এগিয়ে যায়। শিক্ষাখেত্রে মুসলমান দের অগ্রসরতা কিন্ত এই প্রাক্টিসের ই ফল।বাংলাদেশে মুসলিম সমাজে মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনে সবচাইতে বেশি অবদান রাখে মুসলিম সাহিত্য সমাজ যা এমন কি বর্নবাদ হিন্দুদের ও অনেক টা প্রভাবিত করে।
আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, টা হলো যুগে যুগে মুসলমান রা অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধরে রেখে মুক্তবুদ্ধির যে চর্চা শুরু করেছিলো, টা একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেমন যেন উলটো হয়ে গেছে। এখন আমরা পাশাত্যের হুজুগে ইউটিউব বন্ধ করে দিতেও দ্বিধা করিনা। কাজেই আমাদের ধর্ম সম্পর্কে সেন্টিমেন্ট কে লিমিটে রেখে বাঙ্গালীয়ানার চর্চা করলে হয়তো নিজেদের সমস্যার দিকে আরো বেশি করে নজর দেয়া যেতো।
আজকে আসলে কোন কিছুই আমি ডিটেইলিং করিনি। আমার উদ্দেশ্য ছিলো আউটলাইনে একটা ম্যাসেজ দেয়া, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন পুরন করতে গেলে আমাদের বাঙ্গালী ঐতিহ্য, মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামিক ঐতিহ্য তিন ধরনের দর্শন সম্পর্কেই ধারনা থাকা প্রয়োজন। এ ধারনা শুধুমাত্র কর্পোরেট বিজ্ঞাপনে সীমিত না রেখে ইতিহাস ভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিৎ। পরবর্তি কোন পোস্টে হয়তো পয়েন্ট ধরে ধরে আলোচনায় যাওয়া যেতে পারে।
সবার আগে আমাদের মাঝে সহনশীলতা বাড়াতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে মনের মাঝে ধারন করে বাঙ্গালী ও মুসলিম দর্শোনের মাঝে একটা সেতুবন্ধন টানতে পারলেই কেবন মাত্র ধর্মভিত্তিক ইস্যুগুলোকে আমরা গৌন করে দেখতে পারবো। শিক্ষা বুদ্ধি ও যুক্তি হোক আমাদের সম্ভাবনা পাথেয়। তাতে করে আমরা হয়তো ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করা হতে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবো, আমাদের সংস্কৃতিকে বাচিয়ে রাখতে পারবো।
আমার বিচ্ছিন্ন ভাবনাগুলো সময় নিয়ে পড়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:০২