(ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর রায়)
শ্রধ্যেয় হুমায়ুন স্যার,
আমরা বাঙ্গালীরা অদ্ভুত এক হিপোক্রেট জাতি। চোখে ভারি পাওয়ারের চশমা পরে এবং কাশ্মিরী শাল কাধে চড়িয়ে অনায়াসে সাহিত্য সমালোচনা করতে পারি, অথচ সবার আগে লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার লেখাই পড়ি। অন্য কাওকে দিয়ে বই কিনিয়ে নেই, পাছে কেউ আবার কিছু বলে বসে সস্তা লেখকের বই পড়ছি। সবার সামনে স্বীকার করলে উচুস্তরের সাহিত্যিক/সমালোচক হিসেবে দাম কমে যাবে যে, কোনটা বাজারি আর কোন টা অন্তসারশুন্য লেখা তা বিচারের দায়িত্ব যে তাদের হাতেই। বাজারি বা সস্তা লেখার সংগা তারা সাহিত্যের কোন মানদন্ডে বিচার করেন, জানতে খুব ইচ্ছা করে।
বাজারি বইয়ের ব্যাপারটাই আমার কাছে পরিষ্কার না। সব বইয়িত বাজারে আসে, পাঠক তা কিনে পড়ে। তাহলে যার বই যত বেশী বক্রি হবে, যত বেশি পাঠক পড়বে, তার বই ততই বাজারি ? এমন তো না, কেউ বই লিখে তা সিন্দুকে লুকিয়ে রাখে। অথবা বিক্রি করার চিন্তা করেনা। তাহলে বাজারি কথাটা কি শুধুমাত্র জেলাসি থেকেই এসেছে ?
স্যার, আপনি দেখিয়ে দিয়েছেন সহজবোধ্যভাবে কিভাবে পাঠকের মন ছুয়ে যেতে হয়, অতি সহজ লেখা দিয়েও জীবনের কঠিনতম দর্শন কে কিভাবে পাঠকের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হয়। ব্যাকরনের কঠিন ভাষায় না লিখে একজন সাধারন মানুষের বোঝার মত করে লিখতেন বলেই কি আপনার লেখা কে সস্তা বলা হত ? নাকি এটা বাকি লেখকদের ইর্ষার বহিপ্রকাশ ? আপনি তো আপনার একটা লেখায় নিজেই স্বীকার করে গিয়েছেন- টাকার জন্য বা জনপ্রিয়তার জন্য লেখা দোষের কিছু না, সকল লেখক ই তাই করে, নিজের লেখাকে ছড়িয়ে দিতে চায় পাঠকের মাঝে।
আপনি তো অন্তত স্বীকার করেছেন। কাকে আমরা সত্যকার পাঠক তৈরির কারিগর বলবো, যার ভারি, কঠিন নিয়ম ও ব্যাকরন মেনে লেখা যা লেখকের নিজের ঘরেই শুধুমাত্র শোভা পায় তাকে, নাকি যার বই সবার ঘরে ঘরে, এমন কি সমালোচকদের ও সর্বোচ্চ পাঠতালিকায়, তাকে। বাংলাদেশে বই পড়ার যে একটা অভ্যাস আপনি তৈরি করে দিয়েছেন, যে বিপুল সঙ্খক পাঠক আপনি তৈরি করে দিয়েছেন তাতে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারেই আমাদের যত লজ্জা।
স্যার আমি জানি, আপনি অনেক মেধাবী একজন মানুষ ছিলেন, অনেক পড়ুয়া ছিলেন যা আপনার বই পড়লেই বোঝা যায়। অনেকেই বলে আপনার কিছু লেখা চুরি করা। এর উত্তর কিভাবে দেই আমি। চুরির সঙ্গা আর সব কিছুর বেলাতে এক হলেও লেখা আর ফিল্মের বেলায় তা অন্যভাবে বিচারযোগ্য, এ আমি কিভাবে বুঝাই আপনার সমালোচকদের।একজন হিমু, শুভ্র কিংবা মিসির আলির মত ক্যারেক্টার মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া সব লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়, সম্ভব নয় বাকের ভাই নামক একটি চরিত্রের জন্য পাঠক সমাজের রাস্তায় নেমে আসা। এ কেবল একজন মহান লেখকের বেলাতেই সম্ভব। এই রকম লেখকের লেখা সস্তা হলেও আমার পড়তে কোন অসুবিধা নেই।
বিশাল এক তরুন সমাজকে আপনি বাউলা বানালেও বখাটে বানান নি।
প্রশংসা করি আপনার সেন্স অফ হিউমারের। আমার ক্লাশ ফাইভে পড়া বোন টা যেমন আপনার গল্প পড়ে হাসে, তেমনি বুড়ো দাদুও মুখ টিপে হাসে আর মাথা নাড়ে। দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাগুলোকেই কি অসাধারন বর্ণনাতেই না আপনি উপস্থাপন করেছেন। অনেকে আবার তুলনা করে অন্য লেখকদের সাথে আপনার। এর চেয়ে হাস্যকর আর কি হতে পারে, একজন মহান লেখকের সাথে আরেকজন মহান লেখকের তুলনা কিভাবে করে যায় ? শেক্সপিয়ার আর মিল্টনের মাঝে কি তুলনা হয় ?
বঙ্কিম পরবর্তি যুগে সাহিত্যকে সহজতর করে এনেছিলো ইশ্বরচন্দ্র, তারপর আরো সহবোধ্যতা নিয়ে আসে রবীন্দ্রনাথ এবং তার সমকালীন লেখকেরা। আমরা তাদের কথা শ্রদ্ধা ভরে স্বরণ করি। তার পর সুনিল, সমরেশ আর শীর্ষেন্দুর কিছুটা পলিটিকাল ফ্লেভার থাকা সত্বেও অসাধারন গল্প বলার ঢং আমাদের হৃদয় ছুয়েছিলো। আর তারপর ? শুন্যস্থান পুরন করলেন আপনি। এত সহজে মানুষের মনের ভিতরের বোধ কে নাড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা আর কোন লেখকের মাঝে আমার চোখে পড়েনি। অন্তত এই জনরায় না। জানিনা এর পরের শুন্যস্থান কবে পুরন হবে। আবার কবে কেউ হিমু হবার স্বপ্ন দেখবে, শুভ্রের মত কাওকে চাইবে নিজের জীবনে। স্যার আপনার, আর কিছুদিন বেচে থাকার বড় দরকার ছিলো, একটা বড় রেভুলিউশন আসছে তরুন সমাজে, যা আপনি হয়তো তরান্বিত করতে পারতেন।
আমি ক্ষমাপ্রার্থি স্যার, এই কথা গুলো আগে বলিনি তাই।
স্যার,
একজন মিডিয়া সংশ্লিষ্ট পাঠক হিসেবে কিছু কথা বলি সাহস করে, যা এতদিন জমে ছিলো বুকের ভিতরে।
মনে সাম্যবাদের ইটোপিয়ায় থাককেও বেচে আছি কর্পোরেট ডিসটোপিয়ায়। অত্যন্ত লজ্জার সাথে বলতে হচ্ছে, সকল মৃত্যুপথযাত্রী সেলিব্রেটিকে মিডিয়ার কর্পোরেট খেলার অংশ হিসেবে মৃত্যুর আগে থেকেই খেলতে হয় এক অদ্ভুত খেলা। যে খেলায় তাদের কোন পজিশন নেই, অথচ আবর্তিত হয় তাদের ঘিরেই। মৃতুর আগে থেকেই সকল মিডিয়া সংগ্রহ করে রাখে তাদের লাইফের উপর করা ডকুমেন্টারি, টক শো, সাক্ষাৎকার, নাটক, ছবি ও নানান ক্লিপ্স। মৃত্যুর পর থেকে শুরু হয় আসল প্রহসন। বুকে কালো লাপড়ের ব্যাজ ধারন করে একদিকে চলে শোকের প্রিটেনশন, অন্যদিকে সেই সব সংগ্রিহিত কালেকশন প্রচার করে বাড়িয়ে নেয়া হয় টেলিভিশনের টিআরপি, খবরের কাগজের বাড়তি বিক্রয়। কে জানে, হয়তো মোবাইল কোম্পানিগুলা একটি এস এম এস ভিক্ষার মাধ্যমে আপনার নামে শ্রদ্ধাঞ্জলীর দোকান খুলে বসতে পারে এক টাকার বিনিময়ে।এমন হলেও অবাক হবোনা, কালকে থেকেই জিপি যদি বলে,
" আপ্নারা নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ কে শ্রদ্ধা জানাতে চাইলে এস লিখে টাইপ করুন ৬৯৬৯ নাম্বারে। আপনার শ্রদ্ধা পৌছে যাবে স্যারের কবরে। এই সুযোগ সিমীত সময়ের জন্য।"
মনুষত্ব আর কর্পোরেট খেলায় আমরা হারিয়ে যাই এক অন্দভুত দ্বান্দিকতায়।
ফেসবুক খুললেই একের পর এক স্ট্যাটাস , টেলিভিশন খুললেই আপনার রচিত নাটক, মুভি যা আমরা বস্তাপচা বলে আস্তাকুড়ে ফেলে রাখতাম আপনার বেচে থাকাকালীন সময়ে,পত্রিকা রেডিওতে সব নামীদামী সুশীল লেখক সমাজের সাক্ষাৎকার। "আহ, বড় ভালো লোক ছিলো"।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকাতে পারিনা স্যার। আমি যে এতদিন সুশীলতা করে এসেছি, আপ্নার বিরুদ্ধে কথাগুলো মেনে নিয়েছি , কিন্ত নিজের যুক্তি দেখাতে পারিনি। একজন সত্যিকার পাঠকের মৃত্যু হয়েছিলো মিডিয়া বানিজ্যিকিকরন আর ট্যাগিং এর ভয়ে।
আমি আসলে নিজের কাছেই ক্ষমাপ্রার্থি, নিজেকেই মাফ করতে না পারলে আপনার কাছে মাফ চাবো কোন মুখে ? তারপরেও আমি হিসেবে লজ্জিত, ব্যাথিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
যারা আপনাকে চারিত্রিক দিক থেকে বিচার করতে চায়, তাদের বলি, লেখক কে নয়, বিচার করুন তার লেখাকে, লেখার ক্ষমতাকে।প্রতিটা মানুষের ই কিছু সামাজিক স্ট্যাটাস থাকে । সেই স্ট্যাটাসে তাকে নির্দিষ্ট কিছু রোল প্লে করতে হয়। কেউ সেই স্টাটাসের রোল ঠিকমত প্লে করছেন কিনা সেটা দেখাই মুখ্য। লেখক স্টাটাসে হুমায়ুন আহমেদ যথেষ্ট ভালো ভাবেই তার রোল প্লে করেছেন। কাজেই আমাদের আর অন্য স্ট্যাটাসের দিকে না তাকালেও চলবে। আর যারা আপার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে, তাদের প্রতি আমার তেমন কিছু বলার নেই। "তুই রাজাকার" এর স্রষ্টা কে তারা নিশ্চই ভুলে যায়নি।
আমি জানি, স্যার সমালোচনা গ্রহন করার সাহস রাখতেন।
আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন স্যার। আপনি আমাদের পাঠক দের কাছে কখনোই মরেন নি, বরং বেচে থাকবেন সহস্রব্দি ধরে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকবে আপনার নাম।
ইতি,
একজন সাধারন পাঠক।
--------------------------------------------