মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের সাক্ষীকে জেরা
‘সাঈদীর নির্দেশে খুন’ হয়েও ৫ মাস বেঁচে ছিলেন ইব্রাহিম কুট্টি
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে বর্তমানে বিচার চলছে তার মধ্যে বহুল আলোচিত বিষয়টি হলো ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার অভিযোগ। মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাক আর্মি ১৯৭১ সালের ৮ মে পারেরহাট বাজারে ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে বলে দুইজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ দুইজন সাক্ষী নিজেদের ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী হিসেবে উপস'াপন করেছেন। কিন' গতকাল মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা আদালতে এই হত্যাকাণ্ডের মূল মামলার নথি উপস'াপন করে দেখিয়েছেন ইব্রাহিম কুট্টি পারেরহাট বাজারে ৮ মে নিহত হননি। তিনি তার শ্বশুরবাড়িতে থাকা অবস'ায় ১ অক্টোবর ১৯৭১ সালে নিহত হন। ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই পিরোজপুর আদালতে ১৩ জনকে আসামি করে এ হত্যা মামলা করেন। সে মামলায় ১৩ জন আসামির মধ্যে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম নেই।
অথচ দুইজন সাক্ষী ঘটনার চাক্ষুস বর্ণনা দিয়ে আদালতে বলেছেন, তারা দেখেছেন মাওলানা সাঈদী পারেরহাট বাজারে উর্দুতে পাক আর্মিদের সাথে কিছু কথা বলার পরই পাক আর্মি ইব্রাহিমকে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। তারা গুলির শব্দ ও চিৎকার শুনেছেন বলেও আদালতকে জানান। তারা ট্রাইব্যুনালে জানান, মাওলানা সাঈদীসহ রাজাকার ও পিস কমিটির নেতাদের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানের মাধ্যমে ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরা হয় এবং তাদেরই নির্দেশে পাক আর্মি তাকে হত্যা করে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়।
কিন' মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা গতকাল আদালতে যে তথ্যপ্রমাণ উপস'াপন করলেন তাতে দেখা যায়, সাক্ষীদের বর্ণিত হত্যাঘটনার পরও পাঁচ মাস বেঁচে ছিলেন ইব্রাহিম কুট্টি। আদালতে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের উপস'াপিত তথ্যপ্রমাণের সাথে সাক্ষীদের বর্ণনার কোনো মিল নেই। পিরোজপুর আদালতে ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম স্বামীর হত্যার বিচার চেয়ে যে মামলা করেছিলেন ১৯৭২ সালে, তার এজাহার আদালতে দাখিল করেছেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা। এজাহারে ১৩ জন আসামির নাম উল্লেখ রয়েছে। তাঁর শ্বশুরবাড়িতে হত্যা ঘটনার বিবরণ এবং ঘটনার তারিখ ১ অক্টোবর ১৯৭১ সাল লেখা রয়েছে। মামলার নম্বর ৯।
গত মঙ্গলবার আদালতে ষষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মানিক পসারী। গতকাল মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা তাকে জেরা করেন।
আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় মানিক পসারী ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার বিবরণ দিয়ে বলেন, ইব্রাহিম তাদের বাড়িতে কাজ করতেন। ১৯৭১ সালে ৮ মে পাক সেনাবাহিনী নিয়ে দেলোয়ার শিকদার বর্তমানে সাঈদী, সেকেন্দার শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, রেজাকার মবিন, হাকিম কারী, সোবহান মাওলানা এবং আরো অনেক রেজাকার তার বাড়িতে প্রবেশ করে। তিনি বলেন, তাদের আসতে দেখে আমি বাড়ির পাশে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকি এবং সব ঘটনা দেখতে থাকি। আমার বাড়িতে প্রবেশ করে আমার ফুফাতো ভাই মফিজ উদ্দিন (বাড়িতে কাজ করত) এবং অপর কাজের লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে আর্মিরা ধরে একই দড়িতে বাঁধে। তারপর ঘরে লুটপাট করে সোনাদানা নিয়ে যায় দেলু শিকদার, সেকেন্দার শিকদার ও মোসলেম মাওলানা। লুটের পর দেলোয়ার শিকদারের (একেই বর্তমান সাঈদী হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি) নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী ঘরে কেরোসিন ছিটায়। তারপর দেলোয়ার শিকদার ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। মফিজ ও ইব্রাহিম কুট্টিকে বেঁধে পারেরহাট নিয়ে যাওয়ার সময় আমি তাদের পেছনে পেছনে যেতে থাকি। তাকে পারেরহাট বাজারের মধ্যে ব্রিজের ও পারে নিয়ে গেলে আমি এ পারে বসে তাদের লক্ষ করি। দেলোয়ার হোসেন শিকদারকে আর্মির সাথে পরামর্শ করতে দেখি। তারপর দেলোয়ার হোসেন শিকদার, সেকেন্দার শিকদারের সাথে পরামর্শক্রমে পাক আর্মিরা ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে। ইব্রাহিম চিৎকার মারে। তারপর লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
ইব্রাহিম কুট্টিকে মাওলানা সাঈদীর নেতৃত্বে ধরা এবং তারই নির্দেশে হত্যার বিষয়ে এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর আদালতে সাক্ষ্য দেন চতুর্থ সাক্ষী সুলতান আহমদ হাওলাদার। তিনিও ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার বিষয়ে মানিক পসারীর মতো ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, মানিক পসারীর বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দেখি দানেশ আলী মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন শিকদার বর্তমান সাঈদী, মোসলেম মাওলানাসহ অনেক রাজাকার মানিক পসারীর কর্মচারী ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাজারের দিকে। আমি তাদের পিছু পিছু যেতে থাকি। বাজারের ব্রিজ পার হয়ে পশ্চিম দিকে যাবার পর আমি এ পারে বসে থাকি। উত্তর দিকে থানার ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পর দেলোয়ার হোসেন শিকদার বর্তমানে সাঈদী সাহেব পাক আর্মির সাথে কী যেন বলাবলি করছে- দেখতে পাই। তখনই বিকট গুলির শব্দ এবং চিৎকার শুনতে পাই। এরপর ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসার পর পরের দিন শুনতে পাই মানিক পসারীর বাড়ির কাজের লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে।
ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা বিষয়ে এ দুইজন সাক্ষীর বিবরণের সাথে কোনো মিল নেই গতকাল মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের উপস'াপিত তথ্যপ্রমাণের সাথে।
ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রীর মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে পিরোজপুরে যে হত্যা মামলা করেন তার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে- ইব্রাহিম কুট্টির বাড়ি বাদুরা। তিনি হিন্দুদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার কারণে পাক আর্মি ও রাজাকারদের রোষানলে পড়েন। সে কারণে জীবন বাঁচাতে তার স্বামী ইব্রাহিম কুট্টি তাকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি নলবুনিয়ায় চলে যান। অর্থাৎ ইব্রাহিম কুট্টি তার শ্বশুরবাড়ি যান স্ত্রীকে নিয়ে।
মমতাজ বেগম মামলার এজাহারে বলেন, তিনি তার স্বামীকে নিয়ে বাপের বাড়ি থাকা অবস'ায় ১ অক্টোবর ১৯৭১ সালে আসামিরা তার স্বামী ইব্রাহিম কুট্টি এবং ভাই সিরাজকে গুলি করে হত্যা করে।
মমতাজ বেগম তার স্বামীর হত্যা মামলায় যাদের আসামি করেছেন তারা হলেন- দানেশ মোল্লা, আতাহার আলী, আশ্রাব আলী, আব্দুল মান্নান, আইউব আলী, কালাম চৌধুরী, রুহুল আমিন, আব্দুল হাকিম মুন্সি, মমিন উদ্দিন, সেকান্দার আলী শিকদার, শামসুর রহমান এসআই ও মোসলেম মাওলানা। আসামিদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। যারা আসামি তাদের প্রায় সবাই কুখ্যাত রাজাকার এবং পিস কমিটির নেতা ছিল বলে স্বীকার করেছেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে আসা সাক্ষীরা।
ইব্রাহিম কুট্টি মানিক পসারীর বাড়িতে কাজ করলেও তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে কোথায় কী অবস'ায় আছে তার কিছুই জানেন না বলে জেরার সময় জানান মানিক পসারী। মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা জানান, ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম মামলার সময় আসামিদের বিষয়ে মানিক পসারীকে জানিয়েছেন এবং তার স্বামী কিভাবে নিহত হন তা-ও জানিয়েছেন। কিন' তা জানা সত্ত্বেও মানিক পসারী সত্য গোপন করে ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী ও তাদের সন্তান এবং মামলার আসামিদের না চেনার কথা বলেছেন। এ অভিযোগ সত্য নয় বলে জানান মানিক পসারী।
মানিক পসারী আদালতের জেরার সময় স্বীকার করেন তিনি কোনো মুক্তিযোদ্ধা নন। কিন' ২০১০ সালে পিরোজপুরের বর্তমান এমপি এ কে এম এ আউয়াল তাকে মুক্তিযোদ্ধা আখ্যায়িত করে ডিও লেটার দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন মানিক পসারী। ডিও লেটারে এমপি উল্লেখ করেন, ‘মানিক পসারী ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করিয়া আমার সাথে থাকিয়া সুন্দরবন এলাকায় বীরত্বের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ করিয়াছে। ’
মুক্তিযুদ্ধ না করা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে চাওয়া এবং ডিও লেটার গ্রহণ বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীর জেরায় মানিক পসারী বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াইছি দাওয়াইছি, তাই দিয়েছে।
সাক্ষী মানিক পসারী ২০০৯ সালে পিরোজপুর আদালতে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার অভিযোগ দিয়ে। গত মঙ্গলবার তিনি ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া সাক্ষ্যতে ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা, তাদের নিজ বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, সোনাদানা ভাগ করে নেয়ার অভিযোগ করেন। এ ছাড়া পাক আর্মির হাতে নারীদের ধর্ষণের উদ্দেশ্যে তুলে দেয়াসহ আরো অনেক অভিযোগ করেন।
গতকাল মানিক পসারীকে দিনব্যাপী জেরা করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম ও মনজুর আহমদ আনসারী। তাদের সহায়তা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আল আমিন, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, ফরিদ উদ্দিন, মুন্সী আহসান কবির প্রমুখ।
আইনজীবী : আলমগীর পসারী এবং আপনাদের একই বাড়ি?
সাক্ষী : পাশাপাশি।
আইনজীবী : আলমগীর পসারী আপনার ছোট না বড়?
সাক্ষী : অনেক ছোট। ৩০ বছরের ছোট। সৎভাই সে।
আইনজীবী : আপনার ১২ জন মা?
সাক্ষী : ৫-৬ জন ছিল।
আইনজীবী : আপনি বলেছেন, আপনাদের বাড়িতে পাঁচটি ঘর ছিল। এর মধ্যে একটি গোলাঘর এবং একটি কাছারিঘর। আপনাদের গোলায় কত মণ ধান আঁটত?
সাক্ষী : চার-পাঁচ শ’ মণ।
আইনজীবী : আপনাদের ঘরে উল্লেখযোগ্য আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল খাট।
সাক্ষী : চার-পাঁচটি খাট ছিল।
আইনজীবী : আপনি সংসারের মালিক হলেন কবে?
সাক্ষী : আমি ১৯৬৮ সালে বিয়ে করি। তখনই সংসারের মালিক হই এবং আলাদা হই। তবে খানাপিনা এক ঘরেই চলত। বাড়িঘরের মালিকও ছিলেন বাবা।
আইনজীবী : আপনার বাবা খুলনায় বাস করতেন।
সাক্ষী : খুলনায় বাবার সংসার ছিল। জমিজমা ভাই-ব্রাদার ছিল। মৃত্যুর আগে খুলনায় থাকতেন বাবা। তবে বাড়িরও খোঁজখবর নিতেন।
আইনজীবী : খুলনায় আপনার পিতার কত জমি আছে?
সাক্ষী : আনুমানিক ৪০-৪৫ বিঘা।
আইনজীবী : আপনার বাবা খুলনার বাড়িতে ১৯৯০ দশকে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছিলেন তা জানেন?
সাক্ষী : জানা নেই। (এরপর মানিক পসারী বলেন, কখনো হতে পারে না এটি। মিথ্যা বানোয়াট কথা এটি। )
আইনজীবী : পিরোজপুর এবং পারেরহাটের বিভিন্ন জায়গায় আপনাদের জমি ছিল?
সাক্ষী : ছিল। বাবা বেচাবিক্রি করে শেষ করে গেছেন। আমরা পোলাপান মানুষ। বাবা কবে কোথায় জমি রাখছে নাকি তা আমাদের সব বলে? মাইনষে খাইতেছে।
আইনজীবী : পিরোজপুরের গাজিপুরেও আপনাদের জমি ছিল?
সাক্ষী : ১৪-১৫ বিঘা ছিল। কাগজপত্র নাই। মাইনষে লুটপাট করে খায়। আমরা কী খামু?
আইনজীবী : কারা ভোগদখল করে খায়?
সাক্ষী : মালেক খলিফা, খালেক খলিফা তিন ভাইয়েরা খায়।
আইনজীবী : খালেক খলিফা কি বর্তমান এমপির ভাই?
সাক্ষী : সে খায় না। ভাই না।
আইনজীবী : আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?
সাক্ষী : করি নাই। বাড়িতে বসে করেছি।
আইনজীবী : আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এ মর্মে এমপি আপনাকে ডিও লেটার দিয়েছেন আপনার তদবিরের কারণে।
সাক্ষী : আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছি। তাদের খাওয়াইছি দাওয়াইছি। সে জন্য দেছে।
আইনজীবী : পিরোজপুর আদালতে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা করার পর ডিও লেটার পান?
সাক্ষী : স্মরণ নেই।
আইনজীবী : বর্তমান সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আপনি একজন সুবিধাভোগী?
সাক্ষী : আমার কিছু নাই বলে সরকার আমাকে দেছে।
আইনজীবী : ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত আপনি মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেননি এবং কোনো বক্তব্যও দেননি।
সাক্ষী: না।
আইনজীবী : এত দিন পর কেন মামলা করলেন সে বিষয়ে মামলায় কিছু আপনি উল্লেখ করেননি।
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : ওই মামলায় আপনার ফুফাতো ভাই মফিজ উদ্দিন যিনি আপনার বাড়িতে কাজ করতেন তার কোনো নামই উল্লেখ করেননি।
সাক্ষী : স্মরণ নেই। ওই মামলার তো কোনো হদিস পাইনি।
আইনজীবী : ওই মামলায় জবানবন্দী নেয়ার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা ছয়জন সাক্ষীকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠান।
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : ওই মামলার তদন্তের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা আপনার বাড়ি যান?
সাক্ষী: কেস ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে কথা বলার জন্য আসে একবার।
আইনজীবী : সাক্ষীদের জবানবন্দী রেকর্ডের জন্য যখন নিয়ে যাওয়া হয় তখন তদন্ত কর্মকর্তা আপনার সাথে পরামর্শ করেন?
সাক্ষী : আমি জানিও না শুনিও নাই।
আইনজীবী : তদন্ত কর্মকর্তা আপনার বাড়িতে গিয়ে আপনার কাছে আলামত চান। কিন' আপনি তা দিতে না পারায় এখন তার আপনার বাড়ি যাওয়ার বিষয়টি গোপন করছেন।
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : পিরোজপুরে মামলার পর আপনি ইটিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন?
সাক্ষী : স্মরণ নেই। কত লোক যায়।
আইনজীবী : ওই সাক্ষাৎকারে আপনি আপনার ঘর পোড়ার কোনো চিহ্ন নেই বলেছিলেন। এ জন্য এখন বিষয়টি গোপন করছেন।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : বর্তমান মামলায় আলামত জব্দ করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা কবে আপনার বাড়িতে যান?
সাক্ষী: ১৮/৮/২০০৯
আইনজীবী : আপনি জব্দ তালিকায় সই করেন?
সাক্ষী : বলেওনি করিওনি।
আইনজীবী : সেকেন্দার শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, হাকিম কারী- এদের ১৯৭১ সালের আগ থেকেই চিনতেন?
সাক্ষী : চিনতাম।
আইনজীবী : মোসলেম মাওলানাকে ১৯৭১ সালের আগে থেকেই চিনতেন?
সাক্ষী : আমাদের বাদুরা গ্রামের লোক। সেই হিসেবে চিনি।
আইনজীবী : রাজাকার মবিনকে ১৯৭১ সালের আগে থেকেই চিনতেন?
সাক্ষী : চিনতাম। গ্রামে চাষবাষ করত। মাদরাসায় পড়াত।
আইনজীবী : সোবহান মাওলানাকে চিনতেন?
সাক্ষী: সে তখন ছাত্র ছিল।
আইনজীবী : আপনার বাড়ি শঙ্করপাশা ইউনিয়নে।
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : ওই ইউনিয়নের পিস কমিটির সভাপতি একরাম খলিফাকে চিনতেন?
সাক্ষী : শঙ্করপাশায় কোনো পিস কমিটি ছিল না।
আইনজীবী : একরাম খলিফাকে চেনেন?
সাক্ষী : সে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিল একসময়।
আইনজীবী : ইব্রাহিম কুট্টি আপনার বাড়িতে কত দিন ধরে কাজ করত?
সাক্ষী : পাক আর্মি ধরে নেয়ার তিন চার বছর আগে থেকে কাজ করত।
আইনজীবী : তাকে যখন ধরে নিয়ে যায় তখন ইব্রাহিম কুট্টির কোনো আত্মীয়স্বজন আসেনি ওখানে?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : হত্যার পরেও কেউ আসেনি?
সাক্ষী : আমি দেখিনি।
আইনজীবী : তার লাশ কী হয় জানেন?
সাক্ষী : খালে ভাসিয়ে দেয়।
আইনজীবী : তা তো বুঝলাম। দাফন টাফন হয় কি না।
সাক্ষী : তা আমি জানি না।
আইনজীবী : যেখানে হত্যা করা হয় সেখানেই ফেলে দেয়া হয়?
সাক্ষী : হ্যাঁ, খালে ফেলে দেয়া হয়।
আইনজীবী : ওটা খাল ছিল? নদী নয়?
সাক্ষী : খাল ছিল।
আইনজীবী : ইব্রাহিম বিবাহিত ছিল?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : তার স্ত্রীর নাম মমতাজ বেগম?
সাক্ষী : তা আমি জানি না।
আইনজীবী : তার শ্বশুরবাড়ি?
সাক্ষী : শুনেছি নলবুনিয়া।
আইনজীবী : তার ছেলেমেয়ে ছিল?
সাক্ষী : ২-১ জন ছিল শুনেছি।
আইনজীবী : স্বাধীন হওয়ার পর তার স্ত্রী সন্তানের সাথে আপনার দেখাসাক্ষাৎ হয়?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : তারা বেঁচে আছে না মারা গেছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : ইব্রাহিম কুট্টির শ্যালকের নাম সাহেব আলী ওরফে সিরাজ জানেন?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : বারইখালি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক, দেলোয়ার হোসেন, আব্দুস সাত্তার, সেতারা বেগম, রানী, মকবুল শিকদার, তাহের আলী, মো: আলী এদের চেনেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : আতাহার আলী রাজাকার ছিল তাকে চেনেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : রাজাকার আশ্রাব আলীকে চেনেন?
সাক্ষী: না।
আইনজীবী : রাজাকার মমিন হাওলাদারকে চেনেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : রাজাকার আইউব আলীকে চেনেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : রাজাকার কালাম চৌকিদারকে চেনেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : রাজাকার রুহুল আমিনকে চেনেন?
সাক্ষী : চিনি।
আইনজীবী : এসআই শামসুর রহমানকে চেনেন?
সাক্ষী : না।
(এদের প্রত্যেকের পিতার নাম এবং গ্রামের নাম উল্লেখ করে জিজ্ঞসা করা হয়।)
আইনজীবী : এরা এবং দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার ও মোসলেম মাওলানাকে আসামি করে ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম পিরোজপুর আদালতে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় মমতাজ বেগমের ভাই সাহেব আলী ওরফে সিরাজকেও হত্যার কথা উল্লেখ করা হয়। সেই হত্যা মামলায় মমতাজ বেগম তার স্বামী ইব্রাহিম কুট্টি শ্বশুরবাড়িতে থাকা অবস'ায় ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর নিহত হন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলা নম্বর ৯। এ বিষয়টা জানা সত্ত্বেও আপনি সরকারি সুবিধা আদায়ের জন্য ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার দায় মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে করা মিথ্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন।
সাক্ষী : মিথ্যা। আমি কিছুই জানি না।
আইনজীবী : ওই মামলায় মমতাজ বেগমের মা সেতারা বেগমকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাও জানা সত্ত্বেও আপনি গোপন করেছেন।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : মমতাজ বেগমের দায়ের করা ইব্রাহিম হত্যা মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদেরও আপনি চেনেন এবং জেনেশুনে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন আপনি তাদের চেনেন না।
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী : একই কারণে ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম এবং তার সন্তানদের চেনা সত্ত্বেও বলেছেন চিনি না।
সাক্ষী : সত্য নয়।