মহাজোটে মহা-বিপদ সংকেত
ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম:
আমরা কাগজে -কলমে গণতান্তিক রাষ্ট্র হলেও, গণতন্ত্র কখনও কখনও এখানে থাকে একেবারেই অনুপস্থিত। বাংলাদেশ সম্ভবত এখন সেই ক্রান্তিকালই অতিক্রম করছে। কারণ আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু কাজে স্বৈরাচারী। বিশ্বাসে বাকশাল আর চরিত্রে ফ্যাসিস্ট। আওয়ামী লীগ শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকতে ও দলীয় নেতাকর্মীদের অপকর্ম ঢাকতে ফ্যাসিস্ট নীতিকে একমাত্র বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছে। তার অন্যতম ফ্যাসিস্ট নীতি হলো, জেল-জুলুম-নির্যাতন আর মামলাবাজী। বিপরীত মতের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো। এ জন্য তারা ব্যবহার করছে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করতে কথায় কথায় রাষ্ট্রদোহিতার মামলা এ সরকারের অন্যতম হাতিয়ার। অবশ্য আওয়ামী লীগের এ চরিত্র অতীব পুরাতন। আওয়ামী লীগই বাংলাদেশে একমাত্র দল যারা বাকশালী চরিত্র থেকে এক ইঞ্চিও সরে দাঁড়ায়নি। আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হলেও আওয়ামী লীগের চরিত্রের খুব একটা উন্নতি ঘটেনি। তাদের আজকের কাযক্রম যেন পুরনো দিনের প্রতিধ্বনি-ই মাত্র।
আজো আওয়ামী লীগ সেই রাষ্ট্রদোহিতার পুরনো হাতিয়ার ব্যবহার করে বিরোধীদলকে দমন করে চলছে। আজ কথায় কথায় বিরোধীদলকে হামলা-মামলার সংস্কৃতি এক সময় স্বয়ং আওয়ামী লীগের জন্যই কাল হবে। একথা ক্ষমতার লাল ঘোড়ার দাপটে এখন আওয়ামী লীগের অনেকেই উপলব্ধি করতে পারছে না। বিশেষ করে ১/১১ পথ ধরে এগিয়ে চলছে মহাজোট সরকার। জরুরি সরকারের শাসন ছিল গ্রেফতার, মামলা রিমান্ডের নামে নির্যাতন, হিংসাত্মক প্রতিশোধ, আর দেশের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীদের হেয় প্রতিপন্ন করার মহোৎসব। আর এখন তো চলছে শুধু বিরোধী মত ও পথের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ সকল জনসাধারণের ওপর নির্যাতন। এটাই হলো জরুরি সরকার আর মহাজোট সরকারের মধ্যে পার্থক্য।
মওসুমী গণতন্ত্র মাঝে-মধ্যে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে মাত্র। বিশেষ করে কালে ভদ্রের এ গণতন্ত্রেরও সাক্ষাৎ মিলে নির্বাচনের সময়। এ সময় হলো আমাদের দেশের গণতন্ত্রের ভরা মওসুম। বিশেষ করে গণতান্ত্রিকতার নীতি অনুয়ায়ী শাসন করা গণতান্ত্রিক সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। এই নীতি থেকে সরে পড়লে সরকার রাষ্ট্রীয় যন্ত্র, আর ক্ষমতার দাপট, মিলে হয়ে উঠে স্বৈরাচারী। আর তখন সরকার আর স্বৈরাচার এই দু'য়ের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে বিরোধীদল, সংবাদপত্র, দেশের বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজের গঠনমূলক সমালোচনা। এই জন্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধীদল সরকারের একটি অন্যতম অঙ্গ।
কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার যেন এর কোনটিরই তোয়াক্কা করছে না। সরকারের সমালোচনায় এখন সরব মহাজোটের শরীকদলগুলো, নিজ দলের, কোন কোন এমপি, মন্ত্রী আর আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী, এবং সংবাদপত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগ কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে না। এ যেন সরকার পতনেরই আলামত! মহাজোটের জন্য মহা-বিপদ সংকেত। আর তা আওয়ামী লীগের জন্য না যত ক্ষতিকর তার থেকে বেশি ভয়ংকর দেশ ও জাতির জন্য। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ড্রাইভারের সিটে থাকে সরকার, আর দেশের সকল জনগণই গাড়ির যাত্রী। সুতরাং সকল ব্যাপারে সরকার ব্যর্থ হলে বিরোধীদল লাভবান হবে এটি কোনো দেশপ্রেমিক মানুষ মনে করতে পারে না। বরং জাতীয় ইস্যুতে সরকার ব্যর্থ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের বিরোধীদল আমজনতা সমানভাবে। হুমকির মুখে পড়বে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। সে সমস্ত ইস্যুর মধ্যে টিপাইমুখ বাঁধ, ডিসিসি বিভক্তিকরণ, পদ্মাসেতু নির্মাণ বন্ধ, তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে জাতিকে দ্বিধাবিভক্তির উদ্যোগ ও দেশবিরোধী একের পর এক চুক্তি ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগের কাছে বিরোধীদল দমন করাই যেন এক মহাসাফল্যেরও ব্যাপার। বিরোধীদল দমনে ব্যবহার করছে বিভিন্ন বাহিনীকে। যেখানে-সেখানে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা। এর অধিকাংশই বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের। দেশে এখন '৭২-'৭৪ আওয়ামী দুঃশাসনের ধ্বনি শুনা যাচ্ছে। দৈনিক পত্রিকার রিপোট অনুযায়ী ‘খুন, গুম, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির ঘটনা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। আইনশৃক্মখলাবাহিনীর পরিচয়ে যে কোনো সময় যে কাউকে তুলে নেয়া হয়। সরকারি হিসাবেই ক্ষমতাসীন এ সরকারের ২ বছর ১১ মাসে খুন হয়েছে ১২ হাজার। থানা-পুলিশে রেকর্ডভুক্ত হয়নি এমন সামাজিক খুনের ঘটনা আরও কয়েক হাজার। চলছে নিয়ন্ত্রণহীন চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। প্রকাশ্যে দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে জনপ্রিয় প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের নৃশংসভাবে হত্যা ও গুম করার ঘটনা ঘটছে। ফলে সাধারণ মানুষ এখন উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত। চলতি বছর ইউপি ও কয়েকটি উপজেলার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৫ জন জনপ্রতিনিধি, নির্বাচন প্রার্থী ও সমর্থককে হত্যা করা হয়। এ সময় ১০ হাজারেরও বেশি লোক আহত হয়। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২ বছর ১১ মাসে দেশে ১২ হাজারেরও বেশি হত্যাকান্ড ঘটেছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় খুন ৫৭০, বিএসএফের গুলীতে নিহত হয়েছে ১৮৫ জন। বিএসএফ অপহরণ করেছে ৫১ জনকে। এদিকে গত আড়াই বছরে শুধু রাজধানী ঢাকায় ৫ হাজার ৫৭৬টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতে উদ্ধার করা হয়েছে আরও প্রায় ৫ হাজার বেওয়ারিশ লাশ। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম ও বেসরকারি একাধিক সংস্থা এই লাশের দাফনকাজ সম্পন্ন করে। উদ্ধার করা লাশের অধিকাংশই নৃশংস খুনের শিকার। অনেক লাশের হাত কিংবা পা নেই, আবার কারও চোখ উপড়ানো, অনেক লাশের শরীর গুলীবিদ্ধ ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা কিংবা রেলে কাটাপড়া বেওয়ারিশ লাশও আছে। তবে নৃশংস খুনের শিকারই বেশি বলে সূত্র জানায়।
আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম সূত্রে জানা যায়, গত ৩ বছরে ঢাকায় বেওয়ারিশ হিসেবে মোট ৫ হাজার ৫৭৬টি লাশ তারা দাফন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে এ বছর ১ হাজার ৫৭৯ জন, ২০১০ সালে ১ হাজার ৭৮৩ জন ও ২০০৯ সালে ২ হাজার ১৫৬ জন। এছাড়াও গত ৩ বছরে ৩৪৪ জন গণপিটুনিতে হত্যার শিকার হয়েছেন। আইনশৃক্মখলাবাহিনী পুলিশ ও র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩৫ জন। এর বাইরেও ঘটেছে নৃশংস খুন, নারী নির্যাতনের ঘটনা।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী সরকারের ২ বছর ১১ মাসে ৪ সাংবাদিক নিহত, ২৮০ জন সাংবাদিক আহত, ৮৮ জন লাঞ্ছিত ও ৯৫ জন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ৪০ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা, ১ জন অপহৃত ও ২৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অধিকারের তথ্য অনুযায়ী রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫৬৫ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ২৮ হাজার ৮৮৮ জন। [সূত্র: আমার দেশ, ১৪ -১২-২০১১]
আগামীতে অন্য মতের কেউ ক্ষমতায় আসলে এসব বন্ধ হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় কি? তাহলে আমরা কি জাতি হিসেবে বর্বরতা আর হিংস্রতার প্রতিযোগিতায় এভাবেই এগুতে থাকবো? জেলগেট থেকে গ্রেফতার এ সরকারের নতুন আবিষ্কার। রাজনৈতিক দলের কেউই এখন জামিন পেয়ে অনায়াসে জেলগেটের বিশেষবাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে পারছে না। কিন্তু আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে ক্ষমতার পালাবদলে রিমান্ডের নামে নির্যাতন, রাজনীতিবিদদের ডান্ডাবেড়ী পরানো আজকে যেমনি বিরোধীদলের জন্য কষ্টকর। আগামী দিনে এপথ আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর নাও হতে পারে। কারণ এই সরকারই শেষ সরকার নয়।
দেশে এখন রিমান্ডের নামে চলছে নির্যাতন। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনী প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। মানুষের মতপ্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে খবর প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দল ও এর নেতাকর্মীদের আক্রমণ এবং বিচার বিভাগের হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর। আজ আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধীদল জনগণকে যতটুকু ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে তার নিয়ামক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করছে সত্য প্রকাশে দুরন্ত সাহসী মিডিয়া, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টগণ। এজন্য সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর আওয়ামী লীগ খড়গহস্ত। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, দৈনিক সংগ্রামের সম্মানিত সম্পাদক সিনিয়র সাংবাদিক জনাব আবুল আসাদ, সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক জনাব কামারুজ্জামান, শীর্ষ নিউজের সম্পাদক জনাব একরাম, সোনার বাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব তাসনিম আলমের মত সম্মানিত ব্যক্তিদের গ্রেফতার, রিমান্ড আর নির্যাতন। চ্যানেল ওয়ান বন্ধসহ সাংবাদিকগণ নির্যাতিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশন করায় ইতোমধ্যেই অনেক দৈনিক পত্রিকা ও মিডিয়া মামলার নামে হয়রানির শিকার হচ্ছে। কিন্তু জুলুম, নির্যাতনের প্রকোটতা যতই ভয়াবহ হোক, জীবন যতই সঙ্কটাপন্ন হোক, সাহসী উচ্চারণ যেন বন্ধ না হয়। এগিয়ে যাবার পথ যতই বন্ধুর হোক না কেন, সত্য কথা বলা যেন বন্ধ না হয়। এটাই হোক মহান বিজয় দিবসে তরুণ প্রজন্মের অঙ্গীকার।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:০৫