চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা । কয়েক মাস পরপর বা অল্প সময়ের ব্যবধানে দুই-তিনটি ঘটনা ঘটেছে। গত তিন বছর ধরে এ ধরণের ঘটনা ঘটছে পুলিশের দাবি আমার মতে এ ধরণের হামলার সূত্রপাত ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই হামলার ধরন ও কারণ এখনকার হামলাগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। একই বছর ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুসকে বিনোদপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এটিও ছিল একই রকম। এরপর প্রায় নয় বছরের বিরতি ছিল। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দারকে পল্লবীর বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মূলত এরপর থেকে চাপাতি দিয়ে হামলার বিষয়টি সামনে আসে। যাঁরা হত্যার শিকার রয়েছেন, তাঁরা ভিন্ন পেশার মানুষ হলেও হত্যাকারীরা তাদের ‘মতাদর্শ’ অনুযায়ী এঁদের লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে। হামলাকারীদের চাপাতির কোপে সর্বশেষ প্রাণ হারান ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা উএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী খন্দকার মাহবুব রাব্বী তনয়।
জুলহাজ মান্নান হত্যার দুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ১ আগস্ট সাভারে ব্লগার আশরাফুল আলমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই বছরের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির কাছে চাপাতির কোপে মারা যান বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়।ওই বছরের ৩০ এপ্রিল ঢাকার তেজগাঁওয়ে সড়কে একইভাবে অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান খুন হন। ১২ মে সিলেটে অফিসে যাওয়ার পথে খুন হন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। ৭ আগস্ট পূর্ব গোড়ানের বাসায় ঢুকে জুলহাজের মতো গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে হত্যা করা হয়। ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতির নিজ কার্যালয়ে খুন হন এর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপন। ৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে কুপিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। আর চলতি বছর ৬ এপ্রিল সূত্রাপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সন্ধ্যাকালীন শিক্ষার্থী নাজিমউদ্দিন সামাদকে।
হাজারো সাফল্য থাকলেও সরকার, গোয়েন্দা বাহিনী একটা নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে রয়েছে বলে মনে হয় সাম্প্রতিক কয়েকটি খুনের ঘটনায়। সক্ষমতা ব্যবহারেও গাফিলতি হচ্ছে কোন একটা যায়গায়। প্রতিটি খুনের পর রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে যেভাবে কথা হচ্ছে, তাতে করে খুনিরা আশকারা পাচ্ছে। ব্লগার অভিজিত রায় হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বলে আসছিল, সাত-আটজন সন্দেহভাজনকে তারা রিমান্ডে নিয়েছে। পরে শোনাগেল, প্রকৃত হত্যাকারী তিনজন। খুনিদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে প্রশাসনের এমন আশ্বাসের পর আবার শোনা যায় ওরা পালিয়ে গেছে।
এছাড়াও সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক বেশ কয়েকটি খুনের পর বললেন ১৮শ টার্গেটেড লোকজনকে সুরক্ষা দেওয়া কঠিন। পুলিশপ্রধান বলছেন নিজেদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিজেদের নিশ্চিত করতে। প্রশ্ন আসে তাহলে কি জনগন নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলবে । বরং এ ক্ষেত্রে পুলিশের উচিত যারা হুমকিতে আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। গুরুত্বপূর্ণ ফোন নম্বরগুলো দিয়ে রাখা। যাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় আছেন, তাঁদেরকে চলাফেরার সময় সহযোগিতা দেওয়া। ষোল কোটি মানুষের নিরাপত্তার জন্য গেড়ে তোলা এ বাহিনী অন্তত ১৮শ মানুষকে টার্গেট করা হয়েছে জানতে পারলে তারা কারা সে তথ্যও অবশ্যই পেয়েছে বলে ধারনা করি। তাছাড়া ১৮ শ জন সংখ্যাটা জানতে পারলে ৩৬ শ লোককে পুলিশ টার্গেট করলে সেখানেই ১৮শ লোক বেরিকেডে পড়বে অন্তত প্রশাসনের এ দক্ষতা ও তাদের রক্ষা করার সক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস রাখে জনতা।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ কেউ সমকামিতা নৈতিকতাবিরোধী হলেও তাঁদেরকে খুন করতে হবে বা করা যাবে বা সে ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া যাবে সে ধরণের বৈধতাও দেয়নি ধর্মীয় অনুশাসন। কলাবাগানে সমকামী ও হিজড়াদের অধিকার নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদক খুন হলেন। হত্যাকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। কেউ খুন হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, তারা কী লিখেছে খুঁজে দেখতে হবে উক্তিটি তখন বিমত সুলভ কিছু লিখলে লেখক হত্যা করলে কি আর করার এমন পশ্রয় ইঙ্গিত করে। ব্লগার হত্যা সহ সকল হত্যার বিচার হবে প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমনে উক্তি সাংঘর্ষিক বলেই মনে হয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর উক্তি মুক্তবুদ্ধির নামে পর্নো ঠিক নয়। মুক্তবুদ্ধির নামে মহানবী (সা.) ও ইসলাম সম্পর্কে নোংরা চিন্তা অনুমোদনযোগ্য নয়। এই কথাটা সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য।
একের পর এক কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে ভিন্নমতাবলম্বীদের। তবে স্পষ্ট বলা যায় সাম্প্রতিক এ ধরণের ত্যাকাণ্ডগুলো বৃহৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে। এগুলোকে সাধারণ অপরাধমূলক কাজ নয়। এর পেছনে আদর্শগত ও রাজনৈতিক, কারণ রয়েছে। হঠাৎ করেই এ ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে এমন নয় , অবশ্যই রয়েছে দীর্ঘ সূত্রতা। এ ধরণের জঙ্গি তৎপড়তার পেছনে আন্তর্জাতিক কারণও থাকতে পারে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় কী হয়েছে? কী হচ্ছে? আফগানিস্তানে রুশদের বিরুদ্ধে তালেবানদের উত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আল-কায়েদা, আইএসসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন নিজেদের জানান দিয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এখন এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু দেশে ইসলামের নামে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। অপরদিকে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল থাকার চুক্তিতে আবদ্ধ। এমনো হতে পারে এ চুক্তির জের হিসেবে তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস বাংলাদেশ ও ভারতকে তাদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে।
তবে সর্বশেষ বলা যায় বিচারহীনতার কারণে বন্ধ হচ্ছে না গুপ্তহত্যা। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে সব ধরণের অপরাধের জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্নের জন্য সংশ্লিষ্ট সর্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন । সেটা সরকারের কর্তব্যও বটে। আর দেশের বৃহৎ স্বার্থে কঠিন বাস্তবতার মধ্যে পরিপূর্ণ সততার সঙ্গে এ ধরণের বিশৃঙ্খল তৎপড়তা রুখতে আমাদের ধর্ম ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কথা না ভেবে সমাধানের পথ ভাবতেই হবে।