আমি যেদিন থেকে অনামিকার খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি, সেদিন থেকে দেখেছি ওর জীবন থেকে অন্য সব ছেলে বন্ধুকে হারিয়ে যেতে!! অর্থ্যাৎ ওকে দেখে বুঝতাম যে আমার মত বন্ধু তার জীবনে সব ছেলে বন্ধুর অভাব পূরণ করে দিয়েছে!! আর ওর সাথে আমার বন্ধুত্ত্ব গভীর হয়েছে একটা বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে!!!
অনার্স লেভেলে আমারই ডিপার্টমেন্টের আমারই ইয়ারের একটা মেয়েটে এক তরফা ভাবে আমি ভালোবাসতাম!! :#> আর সেই মেয়ের বান্ধবী ছিল আমার এই বান্ধবী অনামিকা!! আর ঐ মেয়ের মোবাইল নম্বর সংগ্রহের জন্য অনামিকার কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে গিয়ে একসময় আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি!! এতটাই ভালো বন্ধু আমরা ছিলাম যে আমাদের যাবতীয় ব্যাপার আমরা একে অন্যের সাথে শেয়ার করতাম। তবে অনামিকার স্বভাবের একটা নেতিবাচক দিক ছিল যে, ও বড় বেশী সুবিধাবাদী ছিল!! অনামিকাকে "সুবিধাবাদী" খেতাবটা দিতেও আমাকে অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হয়েছে!! ওর চরিত্রের কিছু কিছু অংশ কয়েক বছর ধরে বিশ্লেষন করে ওকে "সুবিধাবাদী" খেতাবটা দিয়েছি!! এ ব্যাপারে আপাতত বিস্তারিত কিছু বলতে চাইনা!! ওর এই সুবিধাবাদী আচরণের কারণে অনামিকার সাথে মাঝে মাঝে আমার ছোট খাটো মনোমালিণ্য লেগেই থাকত!! কিন্তু আমরা দুজন এটাও জানতাম যে মনোমালিন্য হলেও সেটা বেশীক্ষন টিকবেনা!! আর আমি সবসময়ই কম্প্রোমাইজ করার জন্য নিজেকে সান্তনা দিতাম এই ভেবে যে, মেয়েরা একটু আকটু স্বার্থপর, সুবিধাবাদী হতেই পারে- এটা তেমন কোন ব্যাপার না!!
এভাবে অতিক্রান্ত হতে থাকে আমার অনার্স লেভেলের আরো কিছু সময়। এই সময়ের মধ্যে অনামিকার সাথে তার বয়-ফ্রেন্ডের ব্রেকআপ হয়ে যায়। সেই সময় মেন্টাল সাপোর্ট দেবার জন্য ওর পাশে একমাত্র আমিই ছিলাম। কারন ওর জন্য আমি ছাড়া আর কোনো ভালো বন্ধু ছিলনা। আর আমার প্রেম??!! কপালে না থাকলে যা হয়!! আমার পরাণ পাখি একসময় অন্যের সংসারে চলে যায়। যেহেতু আমিই মেয়েটাকে একতরফা ভাবে ভালোবাসতাম তাই কষ্ট টা সামলে উঠি খুব তাড়াতাড়ি। তাছাড়াও অনামিকাও আমাকে সেই সময়ে খুব ট্যাক্টফুলি মেন্টাল সাপোর্ট দিয়েছে!! যার কারণে আমি অনামিকার কাছে এখনো কৃতজ্ঞ!! আর এভাবেই আমরা একসময় খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি!!
অনামিকার আমার বাসায় যাতায়াত ছিল। আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে ওর ভালো সম্পর্ক ছিল। অনামিকা আমাদের বাসায় আসলে আমার পরিবারের সবাই মিলে ওকে নিয়ে আড্ডা দিতাম। এখানে কোনও গোপনীয়তা থাকতনা। একসময় অনামিকা আমার পরিবারের একটা অলিখিত অস্থায়ী সদস্য হয়ে উঠে। আর আমার বন্ধু হিসেবে অনামিকাকে আমার বাড়ীর সবাই খুব পছন্দ করত।
এভাবে আরো এক বছর চলে যায়। সম্পর্ক আরো গাঢ় হতে থাকে। কিন্তু সত্যি বলছি সেই সম্পর্কে প্রেম-ভালোবাসার কোন গন্ধ ছিলনা। অনামিকার ব্যাপারে আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে আমার দিক থেকে শুধুই ছিল বন্ধুত্ত্ব!!
অনামিকা ছিল আইটি জ্ঞানের দিক থেকে একবারে দুধের বাচ্চা। কিন্তু যেদিন ওর বাড়ীতে ওর ভাইয়ের ল্যাপটপে নেটের কানেকশন নেওয়া হয় সেদিন থেকেই কেমন জানি ওর আইটি এর ব্যাপারে জানার আগ্রহ বাড়ে। যদিও ওর প্রধান আগ্রহ ছিল ফেসবুক। কিন্তু ওর ভাইয়ের ল্যাপটপ ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারতনা। নেটের কানেক্টিভিটি তো অনামিকার জন্য আকাশের চাঁদ পাওয়ার মত। কিন্তু সেই চাঁদটাই আমার কল্যাণে হাতে পেয়ে গেল!!
আমার বাড়ীতে যেহেতু নেটের লাইন ছিল আর ওর ছিল আগ্রহ। তাই ওর আগ্রহ আর জেদের কাছে হার মেনে একদিন ওকে ফেসবুকের একাউন্ট খুলে দিই, ফেসবুকের টুকিটাকি ব্যাপার স্যাপার শিখিয়ে দিই। এবং অনামিকার মা'কে এই বলে কনভিন্স করি যে- নেটের জগতে বিচরণ করলে অনেক কিছুই শেখা যায়।
এভাবে একসময় ওর হাতে ওর ভাইয়ের ল্যাপটপ চলে আসে। মাঝে মাঝে আমরা দু'জন চ্যাটিং করি। আড্ডা দিই। নিজেদের কথা গুলো, আবেগ গুলো শেয়ার করি। কারন আমার খুব কাছের মেয়ে বন্ধু বলতে শুধু অনামিকাই ছিল।
সবকিছুই ভালো ভাবে চলছিল। কিন্তু একদিন রাতে হঠাৎ অনামিকা আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে ফেসবুকে প্রোপোজ করে ফেলে!! সত্যি বলছি, সেই দিন আমি ওর ইঙ্গিত পেয়ে কিছু হলেও নার্ভাস হয়ে যাই। :#> পরের দিনে ক্যাম্পাসে দেখা হলে সামনাসামনি এটা নিয়ে কথা বলি। ওকে বুঝাতে চেষ্টা করি- এটা একধরনের পাগলামী, এটার কোনও ভবিষ্যৎ নেই, এসবে জড়িয়ে পড়লে ভবিষ্যতে কষ্ট পাব, আমার চাইতে তার জীবনে সে আরো ভালো কাউকে খুঁজে পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ও যেন অপমানিত না হয় সেজন্য ওকে এভাবে বুঝাই যে- "আমি সন্মানিত যে তোমার মত কেউ একজন আমাকে ভালোবাসল। কিন্তু আমি এতটাই হতভাগা যে তোমার ভালোবাসা আমি উপলব্ধি করতে পারলাম না......ইত্যাদি ইত্যাদি"
অনামিকা যেহেতু আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল। তাই এরকম পরিস্থিতিকে খুবই ট্যাক্টফুলি হ্যান্ডল করার চেষ্টা করেছি। অনামিকার নিজের বাবা ছিলনা। তাই সে সৎ বাবার কাছে থাকত। আর তাই তার মনে ধারণা হয়েছিল যে, তার ভবিষ্যতের ব্যপারে তার সৎ বাবা মনে হয় উদাসীন (এ ব্যাপারটা আমি অনেক পরে বুঝতে পারি) এবং তার সৎ বাবা মনে হয় তার ক্যারিয়ার এবং সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করেনা। বরং এসব ব্যাপারে অনেক অমনোযোগী!!! এসব কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগত। আর তাই অনামিকার বিয়ের জন্য গোপনে গোপনে আমি নিজেই পাত্র খোজা শুরু করে দিই!! কারন ওর কষ্ট দেখলে, ওর চোখের পানি দেখলে নিজের মধ্যেই টান অনুভব করতাম ওর জন্য কিছু করার জন্য। তাছাড়া আরেকটা কারন ছিল যে, আমার মনে সবসময় একটা অপরাধবোধ কাজ করত যে, অনামিকাকে মনে হয় আমি অপমাণিত করেছি তার ভালোবাসা প্রত্যাখান করে!!
এভাবে চলতে থাকে আরো কিছুদিন। ততদিনে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক আরো গাঢ়। তবে সেখানে কেমন জানি আমার দিক থেকে প্রেম-ভালোবাসা কাজ করতনা। তবে বন্ধুত্বের মাঝে হালকা একটু উষ্ণতার ছোঁয়া অনুভব করতাম সবসময়। একসময় আমাদের মাঝে কেমন জানি মানসিক দূরত্ব কমে আসে। আমরা রাতের বেলা ফোনে আড্ডা দিতাম। সেই আড্ডাতে কেমন জানি দুষ্টমী টাইপের কথা বলা শুরু করলাম। তবে এখনকার এই ডিজুসীয় প্রেমের যুগে ফোন-সেক্স বলতে যা বুঝায়, তার ধারে কাছেও কিছু ছিলনা। তবে আমরা দুষ্টমী টাইপের কথা বার্তা খুব বলতাম- এটা বলতে পারি।
একসময় লক্ষ্য করি অনামিকার প্রতি আমার চাওয়া পাওয়া কেমন জানি আগের মত নেই। ও আমাকে আরো বেশী বেশী কেয়ার করুক- এটা আমি আশা করতে শুরু করি। আমি ভালোবাসি না তো কি হয়েছে, অনামিকা তো আমাকে ভালোবাসে- আমার এই মেন্টালিটির কারনে আমি ওর কাছ থেকে আরো কেয়ারিং এক্সপেক্ট করতে গিয়েই আসল ব্যাপারটা টের পেয়ে যাই। আসলে অনামিকা আমাকে যতটুকু মৌখিক ভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করে, বাস্তবে প্রকাশভঙ্গিতে তার ছিটেফোঁটাও নেই!!
আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি যে, আসলে আমি তার ভালোবাসার মানুষ নই। শুধুমাত্র কিছু অতিরিক্ত আবেগের কারণে এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনামিকা আমাকে বেছে নিয়েছিল। একসময় অনামিকা আমাকে বলে ফেলে যে, ও নাকি যাকে পছন্দ করবে তাকে বিয়ের পর ভালোবাসবে!! আমিও বুঝতে পারি, অনামিকার একমাত্র লক্ষ্য "বিয়ে করা"!! কারন তার হাতে ঐ মুহূর্তে আমার চেয়ে ভালো কোনও অপশন ছিলনা!! ব্যাপারটা যদিও কিছুদিন পরে টের পেয়ে যাই!! সে গল্পই এখন..............................
যেহেতু আগেই বলেছি ওর প্রতি আমার চাওয়া পাওয়ার মাঝে কোনও সামন্জস্য ছিলনা। তাই মাঝে মাঝে ওর সাথে আমার হালকা মনোমালিণ্য হত!! ওকে আমি দুষ্টমী করে ক্ষেপানোর চেষ্টা করতাম। যদিও সিরিয়াসলী ওর সাথে আমার কোন রকম ঝগড়া ছিলনা!! আর তাই আমরা ফেসবুকে মেসেজ আদান প্রদান করা নিয়ে মাঝে মাঝে হালকা মান অভিমানের খেলা খেলতাম।
একসময় লক্ষ্য করলাম- আমার প্রতি তার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ফোনেও তেমন যোগাযোগ করেনা। ফেসবুকেও আগের মত ঘন্টায় ঘন্টায় আর মেসেজ করেনা। ফেসবুকে তার একাউন্টের প্রাইভেসী সেটিংস্ও কেমন জানি দিন দিন আরো হার্ড হয়ে যাচ্ছে। তার ফ্রেন্ড লিষ্ট দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। তবে এসব দেখে আমার ভালোই লাগত। কারণ ভাবতাম শেষ পর্যন্ত ওর অনেক বন্ধু জুটছে, ও আগের মত আর লোনলী ফিল করবেনা!!
এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ একদিন দেখলাম, আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিষ্টে অনামিকা নেই!!! প্রথমে ভেবেছিলাম যে আমিই মনে হয় ভুল করে ওকে রিমুভ করেছি!! পরে বুঝতে পারি, আমি ব্লকড্!!!
এটা বুঝতে পেরে কেমন জানি আমার প্রচন্ড রাগ জমল। যেহেতু আমার বাড়ী থেকেই অনামিকাকে ফেসবুকে একাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম, তাই আমি পাসওয়ার্ড জানতাম। আর সেই পাসওয়ার্ড দিয়ে অনামিকার ফেসবুকে ঢুকতে গিয়েই দেখি পাসওয়ার্ডও চেন্জ করা হয়েছে!! অতঃপর মেইল আইডি দিয়ে ফেসবুকের পাসওয়ার্ডটা রিকভার করি। এবং মনে জমিয়ে রাখা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই!!!
লন্ডন প্রবাসী এক বাংলাদেশী ছেলের সাথে মাসখানেক ধরে অনামিকার গভীর প্রেম চলছে। রাত জেগে নেটে ভিডিও চ্যাটিং ও করা হচ্ছিল মাসখানেক ধরে!! সেই ঈঙ্গিতও পেলাম মেসেজ বক্সে। আর কিছু কিছু মেসেজ এবং তার রিপ্লাই অনামিকাকে নতুন রূপে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল!! ফেসবুকের একটা পার্সোনাল ফটো এলবাম শুধুমাত্র ঐ ছেলেটার জন্য তেরী করে প্রাইভেসী সেটিং ঠিক করা হয়েছে!! যেটা আমার চোখে কখনোই পড়েনি। আমাকে ব্লক করে রাখা হয়েছে, আমার দেওয়া মেসেজ গুলো সব রিমুভ করে দেওয়া হয়েছে.......................!! আমি আমার বন্ধুত্তের পুরস্কার পেয়ে গেলাম। রাগের বদলে মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম অনামিকার নতুন প্রেম সম্বন্ধে আমি যেন জানতে না পারি, তাই আমাকে ফেসবুকে ব্লক করে রাখা হয়েছে। নিজেকে হঠাৎ করে অপমানিত মনে হতে লাগল। বুঝতে পারলাম অনামিকা যেহেতু আমাকে এভয়েড করতে চাচ্ছে, তাই আমারও উচিত না আর আগ বাড়িয়ে তার সাথে যোগাযোগ করে তাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলানোর। আর তাই সেই দিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত অনামিকার সাথে আমি আর যোগাযোগ করিনি। অনামিকাও কেমন জানি পরে আর যোগাযোগ করেনি........।
***************************************************
আমি তেমন ভালো ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে কিছু লিখতে পারিনা। অনেক বড় একটা কাহিনী লিখে আপনাদের বিরক্ত করার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আমার মন বলছে এই লেখাটা অনেকেই এড়িয়ে যাবে। তারপরও যারা পড়লেন, তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।