২০১৭ সালে ECA রেডি। মাস্টার্স ইকুইভ্যালেন্সি পাওয়া গেলো।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে IELTS দিলাম। Saskatchewan Immigration Nominee Program (SINP) এর জন্য ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট এ Canadian Language Benchmark বা (CLB) ৮-ই হলো সর্বোচ্চ নাম্বার। সেই CLB ৮ মানে হলো রিডিং, রাইটিং, স্পিকিং-এ ৬.৫ করে পেলেই হবে, শুধু লিসেনিং-এ পেতে হবে ৭.৫। আমারও কপাল দেখেন, 'পড়া', 'লেখা', 'বলা' এই ৩টি মডিউল মোটামুটি পারলেও এই 'শোনা'তেই আমার যত দূর্বলতা! বন্ধুরাও আমাকে টিপস দিতো, যত বেশী প্র্যাকটিস করবে, শোনা তত ভালো হবে। বন্ধুরা এই টিপসটি অবশ্য আমাকে বাংলাতেই দিতো। শুধু ‘শ’ এর স্থলে ‘স’ ব্যাবহার করতো, এই আরকি!
যাই হোক, একবার পরীক্ষা দিয়েই SINP-র কাঙ্ক্ষিত CLB স্কোরও পাওয়া গেলো।
তারমানে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকেই আমি কানাডায় আবেদনের পূর্বশর্ত পূরণ করে বসে আছি। কিন্তু সময় করে বসে প্রোফাইলটি কেন যেন আর খোলা হচ্ছিলো না। তখন আমার অবস্থা যেন প্রথম প্রেমের আগের সেই সুন্দরী মেয়েটির মতন, অনেকেই তাকে চায়, হাতে অনেকগুলো অপশন, মনে মনে দুই-তিনজনের একটা শর্ট লিস্টও বানানো হয়েছে, কিন্তু একজনকে বেছে নেয়া একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
যেন প্রোফাইলটি খুললেই জাস্টিন ট্রডো আমাকে চার্টার্ড বিমান পাঠিয়ে ধরে-বেধে নিয়ে যাবেন!
তাই জানুয়ারি থেকে সবকিছু রেডি করে নিয়ে বসে থাকলেও ২০১৮ অক্টোবরের আগে আর প্রোফাইল খোলা হয়ে উঠলো না। বারবারই মনে হতো, দেখি আর কিছু দিন। ভালোই তো আছি!
যেকোনো মূল্যেই আমি কানাডা যেতে চাই কিনা? হ্যাঁ বা না, এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর কখনোই দিতে পারিনি। দেশে একটা নির্দিষ্ট ট্র্যাকে ছিলাম। আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশের গড়পড়তা মানুষের চেয়ে ভালো একটা বেতন পাচ্ছিলাম; সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে একদিন না একদিন বাংলাদেশের আর দশজন সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের যেটুকু স্বপ্ন, তার কাছাকাছি পৌছানোর যথেষ্ট সম্ভবনা ছিলো। দেশে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, ত্রিশ বছর সম্পর্কের একঝাঁক বন্ধু, এতদিনের অভ্যস্ততা এতকিছু ফেলে আসলেই নিজের কাছে কখনো স্পষ্ট ভাষায় একটা উত্তর দিতে পারিনি।
না পেরে সিদ্ধান্ত তুলে দিয়েছি সৃষ্টিকর্তার হাতে, হে আল্লাহ, যদি কানাডা আমার জন্য ভালো হয়, তাহলে কানাডা নিয়ে যেও। যদি বাংলাদেশই আমার জন্য ভালো হয়, তাহলে তাই হোক।
ভালোর কৃতিত্ব আমরা অন্য কাউকে না দিলেও মন্দর দোষ অন্য কাউকে দিতে পারলে আমাদের খারাপ লাগাপ কিছুটা উপষম হয়। আপনি প্রেম করে বিয়ে করে থাকলে বিষয়টা ভালো বুঝবেন। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী একটু মনোমালিন্য হতে বাধ্য। কিন্তু পরিবারের মতে বিয়ে করা ছেলেটি বা মেয়েটি এমন মুহুর্তে তার এই পোড়া কপালের দায় পরিবারের উপর চাপিয়ে দিয়ে খানিকটা নির্ভার হতে পারে, কিন্তু নিজের পছন্দে বিয়ে করা পাত্র বা পাত্রী মাত্রই স্বীকার করবেন, এহেন মুহুর্তে তাদের আপিল করারও কোনো সুযোগ নেই। বরং আপিল বিভাগ থেকেও আরেকটি নতুন মামলা খাবার সমূহ সম্ভবনা!
এই কানাডা জার্নির মাঝপথে আবার আট বছর চাকরির প্রিয় মার্কেন্টাইল ব্যাংক ছেড়ে নতুন প্রজন্মের মধুমতি ব্যাংকে যোগদান করলাম। নতুন ব্যাংকে যোগদান করা নিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষীরা পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামতই দিলেন। আমার মা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, যদি দেশ ছাড়তে চাই, তাহলে একটা গ্রেড বেশী দিক আর পাঁচটা গ্রেডই দিক, কী লাভ?
মায়ের কথাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এই কথাটা মধুমতি ব্যাংকের প্রাথমিক দিনগুলিতে মাঝে মাঝেই মনে পড়তো। তবে এ কথাও সত্য, আমার কানাডা আসার পেছনে মধুমতি ব্যাংকের অবদান অনেক। কানাডার ব্যাপারে আমার নিরপেক্ষ অবস্থানে প্রথম নাড়া দিলো এই ব্যাংক। তারা ৫০:৫০’র কাটাকে কানাডার দিকে ৬০:৪০ বা ৭০:৩০র দিকে ঠেলে দিলো। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ছিলো আমার কাছে পরিবারের মতন। আর মধুমতি শেখালো ৮-১০ বছরের পরিবার ছেড়ে আসলেই মানুষ মারা যায় না। প্রথমটির মতন হয়তো হয়না, কিন্তু ৫-৭ মাস কষ্ট করতে পারলে আরেকটা সম্পর্ক জন্ম নিতে থাকে। মধুমতি ব্যাংকের প্রথম ৮-১০ মাসের এসিড টেস্ট উতরে যাবার পরের সাড়ে তিনটি বছর আমার চাকরি জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা হয়েই থাকবে। সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই এজন্য আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা, বিশেষত আমাদের ট্রেড টিমের সিনিয়র-জুনিয়র সকলের প্রতি শ্রদ্ধা, স্নেহ এবং ভালোবাসা।
কানাডায় আসতে আগ্রহী কতজন মানুষ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র হাতে নিয়ে বসে বসে শুধু আবেদন করছি, করবো, প্রোফাইল খুলছি, খুলবো করতে করেতই ১০ মাস কাটিয়ে দেয় কে জানে। এ কারনেই মধুমতি ব্যাংকের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা আরও বেশী, কারন তাদের এসিড টেস্টের দিনগুলিই আমাকে দিয়ে কানাডার SINP-র প্রোফাইল খুলিয়ে নেয়! ২০১৮ সালের মে মাসে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ছেড়ে আসি। আর SINP-র প্রোফাইল খুলি ওই বছরের অক্টোবর মাসে।
প্রোফাইল খোলার সপ্তাহ দুয়েক পর প্রথম যে ড্র টি হয়, সেই ড্র তেই আমি Invitation To Apply (ITA) পাই!
ITA পাওয়ার পর মনে হলো, সৃষ্টিকর্তাও হয়তো চান আমি কানাডা যাই। সৃষ্টিকর্তার প্রতি আন্তিরক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার পর আরও একটু ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য এনে মনে মনে বললাম, তিনি যদি চান, তবে তার চাওয়াই আমার চাওয়া!
সাস্কাটুন, কানাডা
১৪.০৬.২০২৩