কুরবানিতে অংশ নেবো নাকি নেবো না, কীভাবে সবকিছু করা হয় কে জানে, নাকি দেশেই কুরবনি করা হবে এইসব নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু আমাদের একই বিল্ডিং-এর আরও দুই বাংলাদেশী ভাই সাথে থাকায় সাহস করে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্তি নিলাম।
অল্প অভিজ্ঞতায় যা দেখলাম, এখানে কুরবানির উপায় আছে দুটি। গ্রোসারি শপ, যেখানে হালাল মাংস বিক্রয় হয়, সেখানেও কুরবানির ‘প্যাকেজ’ আছে। ওরা কুরবানির পর সবকিছু রেডি করে আপনাকে জানাবে, আপনি শুধু কষ্ট করে শপ থেকে মাংস বাসায় নিয়ে যাবেন। কোথায় যোগাযোগ করতে হবে, কিভাগে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, পুরো পশুটি একাই কিনতে না চাইলে বাকি অংশীদার কোথায় পাবেন এত্তসব ঝুট-ঝামেলা বিহীন একেবারে ‘রেডি টু কুক’ কুরবানি প্যাকেজ।
আর দ্বিতীয় উপায় হলো, দু’চারজন পরিচিত মানুষ থাকলে দলবেধে কোনো পশুর খামারে গিয়ে কুরবানির পশু কিনে কুরবানির আয়োজন করা যায়। সাতজন মিলে আমরা দ্বিতীয় পথেই হাটলাম।
কুরবানির ২-৩ সপ্তাহ আগে স্থানীয় টেরি ফারমার এর খামারে গিয়ে একটা গরু পছন্দ করে এসেছিলাম। খামারে সেদিন ৩০-৪০ টা গরু ছিলো, বললো বেশীরভাগই বিক্রিত। ৫-৭ ছিলো অবিক্রিত। তারমধ্যে থেকে একটা পছন্দ করলাম। দাম ২৮০০ কানাডিয়ান ডলার চাইলো। দাম একটু কমানো যায় কিনা, প্রশ্ন করায় খামারি ভদ্রলোক রসিকতা করে বললো, ঠিক আছে, তুমি ১০০ ডলার কমে আমাকে ২৭০০ ইউএস ডলার দাও!
যাই হোক খামারি ভদ্রলোক শেষপর্যন্ত কানাডিয়ান ডলারেই ১০০ ডলার কম রেখেছিলেন। আমরা দুইশত ডলার বুকিং মানি দিয়ে গরুর কানে লাগানো ‘রেজিস্ট্রেশন নাম্বার নিয়ে এসেছিলাম। ঈদ পর্যন্ত গরু এখানেই থাকবে, কুরবানির পর মাংস কাটাকাটি করে একবারে হস্তান্তর করবে।
ঈদের দিন আমরা যথাসময়ে উপস্থিত হলাম। আগেই শুনেছিলাম, এখানে পশুকে সরাসরি জবাই করা হয়না, গুলি করে মারা হয়। পশুর কষ্টের কথা চিন্তা করে, নাকি আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে কুরবানি করা হয় পদ্ধতিতে জড়িত মানুষদের স্বাস্থ্যঝুকির কথা চিন্তা করে এমন সিদ্ধান্ত, সেটা আমি অবশ্য জানিনা।
আমরা খামারে পৌছাতে পৌছাতেই দেখা গেলো কারো একজনের গরুর সিরিয়াল। খামারির লোক বন্দুক হাতে তৈরি। আমিও মোবাইলের ক্যামেরা হাতে দৌড়ে গেলাম। বেড়া দেয়া নির্দিষ্ট যায়গার অনেক গুলো গরুর মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট গরুটিকে বেছে নিয়ে রাখাল যুবক গুলি ছুড়লো। বড়সর শরীর নিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পশুটি হুড়মুড় করে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। গুলি করার পর যার কুরবানি তিনি তার দলবলসহ গরু জবাই করার ছুড়ি নিয়ে সেই মৃতপ্রায় গরুটির গলায় ছুড়ি চালালেন।
এতদিনের অভিজ্ঞতায় গরুর গলায় ছুড়ি চালিয়ে কুরবানিতে অভ্যস্ত চোখে এই গুলি চালানো দেখে শরীর এবং মনটা কেমন যেন করে উঠলো।
এই পদ্ধতি কতখানি ইসলাম সম্মত তা সেই জ্ঞান অবশ্য আমার নেই। খামারে জড়ো হওয়া ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ, মধ্প্রাচ্য-আফ্রিকার প্রায় একশত মুসলিম ভাই এর এই পদ্ধতির উপর আস্থা দেখে মনে মনে স্বস্তি খুঁজে নিলাম। একজনকে আবার এও বলতে শোনা গেলো, গুলিটা যদি আল্লাহ আকবর বলে করা হতো তবে ছুড়ি না চালালেও নাকি চলতো। কারন কুরবানির শর্তগুলোর মধ্যে একটা নাকি, পশুর শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া, গুলিও নাকি এই শর্ত পূরণ করছে।
ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই কুরবানির পর বাসায় গরুর ভুড়ি নিয়ে আসার বেশ একটা চাপ ছিলো। ভাবখানা এমন যে, প্রয়োজনে মাংস না এনে ভুড়ি নিয়ে আসলেও চলবে! ঈদের দিন দেখা গেলো, একের পর এক কুরবানি হচ্ছে, কিন্তু গরুর ভুড়ি, মাথা আর হাটু থেকে নিচ পর্যন্ত ৪ টি পা খামারির ‘প্যাকেজের’ অন্তর্ভুক্ত নয়। কেউ এসব নিতে চাইলে তাকে নিজে প্রসেস করে নিতে হবে। এবং করে নিতে পারলে পা, মাথা বা ভুরি চাইলে অন্যদেরটাও নেয়া যাবে। কারন কেউ না নিলে ওরা হয়তো সেগুলো মাটিচাপা দিয়ে দেবে! ওদের প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত ছিলো, কুরবানির পর ওরা গরুর চামড়া ছাড়িয়ে, হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে দেবে আর হাড়গুলো মেশিনে ছোট টুকরো করে দেবে, মাংস ছোট ছোট টুকরো নিজেদেরই করে নিতে হবে। এই হলো প্রক্রিয়া।
আমাদের ৭ জনের দলের ৪ থেকে ৫ জনেরই এবারেরটা ছিলো এদেশে কুরবানির প্রথম অভিজ্ঞতা। তারপরও চৌদ্দ হাতের সম্মিলিত চেষ্টায় পুরো প্রক্রিয়া আমরা সুন্দরভাবেই করতে পেরেছিলাম।
শুধু বাসায় অপেক্ষমান বাচ্চাদের কাছে কুরবানিটা কেবল দোকান থেকে মাংস কিনে আনার মতন একটা ব্যাপারই হয়ে থাকলো। বাংলাদেশের কুরবানি উপলক্ষে আমার দুই পুত্রের ৩-৪ দিনের যে উচ্ছাস, হাট জমে ওঠার আগে থেকে হাটে যাবার পায়তারা, কোন রঙের গরু কেনা হবে, গরু পাগলা হবে নাকি শান্ত-শিষ্ট হবে তা নিয়ে পূর্বভাস দেয়া, গরুর জন্য মালা কেনা, বাসায় কলা খেয়ে কলার খোসা জমানো, নিজ হাতে গরুর মুখ পর্যন্ত একটু খড় বা ঘাস তুলে দেয়া, দিনে কিছুক্ষণ পরপ্র গরু গুণতে গ্যারেজে নামা বা রাস্তায় বের হওয়া, বারান্দায় বসে বসে ৪ তলা থেকে চেচিয় রাস্তা দিয়ে কিনে নিয়ে যাওয়া গরুর দাম জানতে চাওয়া…এসবের ছিটেফোটাও হলো না।
এগুলো অবশ্য একপাশে সরিয়ে রেখে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সৃষ্টিকর্তা কাউকে সবকিছু একসাথে দিয়ে দেন না।
যেটুকু দিয়েছেন, তার জন্য তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
সাস্কাটুন, কানাডা
৩০.০৬.২০২৩