সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে শুনলাম রাস্তার ওপাশের ছাতিম গাছে দুটি কাক সুতোয় আটকা পড়ে ঝুলে আছে। চোখে চশমা লাগিয়ে দেখতে পেলাম অসহায় কাক দুটোকে। কখন আটকা পড়েছে কে জানে। সকাল থেকে মুক্তির চেষ্টা করতে করতে দূর্বল হয়ে শরীর ছেড়ে দিয়ে ঝুলে আছে বাদুড়ের মতন।
নিজেরা মারামারি করতে করতেই হয়তো গাছের ডালে আটকে থাকা কোন বোকাট্টা ঘুড়ির সুতোর সাথে জড়িয়ে গিয়ে আর ছুটতে পারছে না। একজনের পাখা সুতোর সাথে পেচিয়ে গাছের ডালে ঝুলছে, আরেকজনের পা আটকে আর নড়তে পারছে না।
ছাতিম গাছটিও অনেক বড়। পাঁচ-সাত তলার সমান। গাছের নিচ থেকে, ছাদ থেকে বা পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে কাক দুটোকে উদ্ধার করার সম্ভবনাও ক্ষীণ।
এছাড়া কাক এদেশে এমন কোন পাখিও না যার জন্য জরুরী উদ্ধার অভিযান হবে। যে দেশে যে প্রাণীর প্রাচুর্য, সে দেশে তার প্রাণ মূল্যহীন। কাক আর মানুষের অভাব আছে, ঘোরতর শত্রুও আমাদের প্রাণের এই শহরকে সেই অপবাদ দিতে পারবে না।
ওদের অপরাপর কাক ভাইরা আসছে, উড়ে যাচ্ছে, কা-কা করছে, সুতো ধরে টানাটানি করছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু করতে পারছে না।
পারার তো কথাও না।
***
একদা একজন প্রথিতযশা নৃবিজ্ঞানীকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো--কোন নিদর্শনটিকে আপনারা মানবসভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে মনে করেন?
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, সেই নিদর্শন কোন প্রাচীন মুদ্রা, ইমারতের ধ্বংসাবশেষ বা তৈজিসপত্র নয়। প্রাচীনতম নিদর্শন তার মতে, কোন প্রাগৈতিহাসিক মানুষের পায়ের ভাঙা হাড় (Femur)।
তিনি দেখেছিলেন, সেই প্রাগৈতিহাসিক মানুষটির পায়ের হাড়টি কোনভাবে ভেঙেছিলো, আবার জোড়াও লেগেছিলো। নৃবিজ্ঞানীর মতে, সেটাই ছিলো মানবসভ্যতার সূচনা।
কেননা, শিকারী-সংগ্রাহকের সেউ জীবনে একটা ভাঙা পায়ের অর্থ হলো, নিশ্চিত মৃত্যু।
খাবারের জন্য ফলমূল সংগ্রহ করা, শিকার করা, হিংস্র প্রাণী থেকে পালিয়ে বাঁচা, নিজের পা ছাড়া কিছুই সম্ভব ছিলো না সেই জীবনে।
যেহেতু লোকটি তার হাড় ভাঙার পর সেটা জোড়া লাগা পর্যন্ত জীবিত ছিলেন, এর অর্থ হলো, 'অন্য কেউ' তার জন্য খাবার সংগ্রহ করেছেন, 'অন্য কেউ' তাকে রক্ষা করেছেন হিংস্র প্রাণী থেকে।
সেই 'অন্য কেউ'ই সূচনা করেছেন সভ্যতার। সেই ভাঙা ফিমারই সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন।
***
কাক সমাজে পাখায়-পায়ে ঘুড়ির সুতা পেচিয়ে বাদুর ঝোলা ঝুলতে থাকা স্বজাতিকে ভরণপোষণ বা শুশ্রূষা করার যেহেতু কেউ নেই, তাই জীবিত অবস্থায় আরও হয়তো বড়জোর একদিন ঝুলে থাকা, মৃত অবস্থায় পাঁচ-সাতদিন ঝুলে থাকার পর গায়েব হয়ে যাওয়াই হয়তো ওদের নিয়তি।
বি. দ্রঃ ছবিটি অন্তর্জাল থেকে নামানো।