সে অনেক কাল আগের কথা। আট-দশ মাস আগেরও হতে পারে, আবার আট-দশ বছর আগেরও হতে পারে।
একবিংশ শতাব্দীর কোন এক দিন অফিসে আমার মোবাইলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ভিনদেশী এক ভদ্রলোক। তিনি কোথা থেকে আমার ফোন নাম্বার পেয়েছেন জানিনা। শুধু কথায় কথায় জানলাম ভদ্রলোক পেশায় একজন ডাক্তার। বাড়ি আমাদের পার্শ্ববর্তী এক দেশে, কর্মসূত্রে থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশে। পেশায় ডাক্তার ভদ্রলোকটি নিজের মেয়েকেও ডাক্তারি পড়াতে চান।
মেয়েকে ডাক্তারি পড়ানো সংক্রান্ত কোন একটা কাজেই খুঁজতে খুঁজতে ডাক্তার সাহেব আমার মতন একজন ছা-পোষা ব্যাংকারকে খুঁজে বের করলেন।
আমার প্রতিষ্ঠানে স্বনামধন্য একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের একটা একাউন্ট আছে। অনেক বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীই সেখানে পড়তে আসে। আলোচ্য এই ভীনদেশী ডাক্তার সাহেব তার মেয়েকে উক্ত প্রতিষ্ঠানেই পড়াতে চান।
মেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে, মেয়েকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানোর জন্য বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় ভর্তি ফি-ও পাঠিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং অনভ্যস্ততার কারনেই হোক বা অন্য কোন কারনেই হোক, দুই-তিনটি দেশ আর পাঁচ-সাতটি ব্যাংক ঘুরে তার পাঠানো সেই ভর্তি ফি-র সর্বশেষ অবস্থান ভদ্রলোক আর সনাক্ত করতে পারছেন না।
ভর্তি ফি হাতে না পেয়ে মেডিকেল কলেজটিও ভর্তি নিশ্চিত করতে পারছে না।
এদিকে ভর্তির সময় অতিক্রান্ত হয় বলে।
ভদ্রলোকের উৎকন্ঠার মূল কারণ সেটাই।
আমার নিজের এবং আশেপাশের মানুষের মাঝে বাচ্চাকে ভালো একটা বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করানো নিয়েই যে পরিমাণ উত্তেজনা এবং উৎকন্ঠা দেখি, তাতে বিদেশি একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৮-২০ বছরের একটা মেয়ে সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার জন্য পড়াতে ইচ্ছুক একজন পিতার উৎকন্ঠা সহজেই অনুমেয়।
ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে ঘটনা যেটুকু জানার জানলাম। আরও ভালো সেবা পেতে পারে ভেবে ভদ্রলোক কে আমার উর্ধতন স্যারের সাথেও কথা বলিয়ে দিলাম। তারা আমার ফোনেই আরও কিছুক্ষণ কথা বলে পরস্পরের ফোন নাম্বার, ইমেইল আদান-প্রদান করে সেদিনের মতন ফোন রাখলেন।
স্যারের সাথে কথা বলিয়ে দেবার পরই আমার অবচেতন মন ঘটনাটিকে আমার টু ডু লিস্ট থেকে নিজে নিজেই সরিয়ে ফেলেছিলো। দুই-তিন দিন পর স্যার আমাকে ডেকে জানালেন, ভদ্রলোকের মেয়ের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে; এবং আমাকে একটা ইমেইল ফরোয়ার্ড করে বললেন, পড়ে দেখতে।
সেই মেইলটা আরও দশজনকে পড়ানোর জন্যই এত বড় একটা ভূমিকার অবতারণা। মেইলটা অন্যদের দেখানোর লোভ সামলাতে পারছিলাম না।
ই-মেইলটা ছিলো এই এই রকমঃ
Assalam o Alaikum warahmatullahi
Dear Respected Sir,
I really appreciate your prompt response, Let Allah bless you and your nation.
Good people like you build the customer’s trust in banking system.
Sure in future deposit i will strictly follow your instructions made.
Today morning college has confirmed the fees deposit and booked my kids Seat in MBBS.
You made a contribution in my child’s academic carrier.
Let Allah bless you, your family and kids.
JazakAllah
Best Regards
এতদিন আমার ধারণা ছিলো, মানুষের সৌজন্যবোধ হয়তো সীমিত, কিন্তু মানুষের অভদ্রতা অসীম।
কিন্তু ডাক্তার সাহেব প্রমাণ করে দিলেন, কিছু মানুষের অসৌজন্যবোধ যেমন অসীম, অজস্র মানুষের সৌজন্যবোধও তেমনি অসীম।
তারপরও একটা মানুষ একটা ব্যাংকিং সেবা পেয়ে গোটা জাতির জন্য শুভ কামনা জানাচ্ছেন, এমন ঘটনা অবশ্যই এ যুগে দুর্লভ।
***
আমার বেশ কিছু চারিত্রিক দুর্বলতার একটি হলো,
মানুষকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে যতটা সঙ্কোচ বোধ করি, তার চেয়ে অনেক বেশী সঙ্কোচ বোধ করি তাকে প্রকাশ্যে প্রসংশা করতে।
"I really appreciate your prompt response, May Allah bless you and your nation.
Good people like you build the customer’s trust in banking system."
উক্ত বাক্যদ্বয় যার উদ্দেশ্যে লেখা, সেই স্যারকে কখনোই সেভাবে বলা হয়ে ওঠেনি যে, উনার সম্পর্কে আমার ধারনাও ওই ভীনদেশী ডাক্তারের চেয়ে একটুও কম নয়।
ভালো কথা নাকি ওয়াইনের মতন--যত পুরনো হয় তত ভালো, তত দামী। সমুদ্রের গভীর থেকে বা মাটির নিচ থেকে দুইশত-পাঁচশত বা হাজার বছরের কোন একটা ওয়াইনের বোতল আবিষ্কৃত হলে ছোট করে হলেও সেই খবর বিশ্বের অনেক সংবাদ মাধ্যমেই আসে।
অনেক অনেক আগের সেই ঘটনার অবতারণা আজ এই কারণেই। আজ হয়তো বলা যায়--স্যার, আপনি যেখানেই থাকবেন, ভালো থাকবেন।