জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশী আন্তর্জাতিক গোল কার এই প্রশ্নের উত্তরে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে পেলে-মুলার নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও খুব কম লোকই হয়তো বলবেন নারী ফুটবলার অ্যাবি ওয়ামবাখের কথা; একটানা সবচেয়ে বেশী ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের নাম বলতে গেলে মাথায় প্রথমেই মেসি-রোনালদোর নাম আসলেও চট করেই কারো মনে পড়ে না টানা ৫ বার ফিফার বর্ষসেরা নারী ফুটবলারের স্বীকৃতি পাওয়া ব্রাজিলের মার্তার নাম।
হয়তো প্রচার-প্রাচারণার অভাবই তাদেরকে আজও এই পাদপ্রদীপের আলো থেকে কিছুটা দুরেই রেখেছে। তবে পাদপ্রদীপের আলো যাই হোক না কেন মাঠের খেলার যোগ্যতা বা দক্ষতায় তারা মোটেই কম যান না পুরুষদের চেয়ে। জিদান, ফিগো, বেকহ্যামরা যখন তাদের সময়ে বিশ্ব ফুটবলের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, কাছাকাছি সময়েই তখন নারী ফুটবলের প্রতীক যুক্তরাষ্ট্রের মিয়া হ্যাম। তবে বেকহ্যামরা যা পারেননি তাই করে দেখিয়েছেন ম্যারিয়েল মার্গারেট ’মিয়া’ হ্যাম।
মিয়া হ্যাম দুবার করে জিতেছেন ফিফা প্রমীলা বিশ্বকাপ এবং অলিম্পিক স্বর্ণপদক। গত বছরই স্বদেশী অ্যাবি ওয়ামবাখ ভেঙ্গে দেবার আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন ছিলেন নারী-পুরুষ মিলিয়েই সবচেয়ে বেশী গোল করা ফুটবলার। ২০০১ সাল থেকে ফিফা বর্ষসেরা নারী পুরস্কার চালু হওয়ার পর প্রথম দুবছরই তা ঘরে তোলেন মিয়া হ্যাম। ফিফার জীবিত শীর্ষ ১২৫ ফুটবলারের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত মাত্র দুজন নারী ফুটবলারের একজন তিনি। আমেরিকার ন্যাশনার সকার হল অব ফেম এবং ওয়ার্ল্ড ফুটবল হল অব ফেমেও প্রথম নারী খেলোয়াড় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে তার নাম।
১৯৭২ সালের যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামায় জন্ম মিয়া হ্যামের। যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে পরে ঠিক হয়ে গেলেও বিখ্যাত ফুটবলার হবার জন্য জন্ম গ্রহণ করা মিয়া হ্যাম জন্ম নেন বাকা পায়ের পাতা নিয়ে। পরিবার বারবার ঠিকানা বদল করাতে মিয়া হ্যামও ঘুরে বেড়ান নানান যায়গায়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ইতালির ফ্লোরেন্সে যেয়ে ফুটবলের সাথে পরিচয় ঘটে হ্যামের। পরবর্তীতে পুরো পরিবারই খেলাটির সাথে জড়িয়ে যান।
অল্প বয়সেই হ্যাম ক্রিড়া প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৮৭ সালে জাতীয় দলে যোগ দিয়েই হ্যাম হয়ে যান জাতীয় দলের হয়ে খেলা সবচেয়ে কমবয়সী খেলোয়াড়। ১৯৮৯ সালে লেইক ব্রাডক মাধ্যমিক স্কুলকে জেতান রাজ্য শিরোপা। নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চার বার নর্থ ক্যারোলিনা টার হিলসকে জেতান ন্যাশনাল কলেজিয়েট এ্যাথলেটিক এ্যাসোসিয়েশনের প্রমীলা শিরোপা। হ্যামের খেলা ৯৫ টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র ১টিতেই পরাজিত হয় নর্থ ক্যারোলিনা!
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত ফিফা প্রমীলা বিশ্বকাপের প্রথম আসরেই বাজিমাত করে যুক্তরাষ্ট্র। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই মিয়া হ্যাম পান বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ। ১৯৯৫-এর দ্বিতীয় আসরে যুক্তরাষ্ট্রকে তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। মূলত ফরোয়ার্ডার হলেও এই আসরে ডেনমার্কের সাথে ম্যাচটিতে মূল গোলরক্ষক লাল কার্ড পেয়ে মাঠ ছাড়ার পর হ্যাম কিছু সময়ের জন্যে পালন করেন গোলপোস্ট সামলানোর দায়িত্বও! শিরোপা জিততে না পারলেও হ্যাম সেবার হন মোস্ট ভ্যালুয়েবল পে¬য়ার।
তবে ১৯৯৫ এর বিশ্বকাপ দুঃখ ভুলতে হ্যামরা বেছে নেন পরের বছরের অলিম্পিককেই। ১৯৯৬ এর আটলান্টা অলিম্পিকেই প্রথমবারের মতো অন্তর্ভূক্ত হয় প্রমীলা ফুটবল। বিশ্বকাপের মতোই অলিম্পিকেও প্রথম আসরেই স্বর্ণপদক জিতে নেন হ্যামরা। হ্যাম এর পর ১৯৯৯ সালে আরও একবার বিশ্বকাপ এবং ২০০৪ সালে অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয় করেন। বিশ্বকাপ এবং অলিম্পিক মিলে ৭ বার কোন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ৪ বার চ্যাম্পিয়ন, ১ বার রানার আপ এবং দুইবার তৃতীয় স্থান লাভ করা যুক্তরাষ্ট্র দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন মিয়া হ্যাম।
মাঠের এই সব সাফল্যই তাকে করে তোলে তার প্রজন্মের 'মোস্ট মার্কেটেবল ফিমেল পে¬য়ার’। ১৯৯৯ সালে যখন ১০৮ গোল করে বিশ্বরেকর্ড করেন সেবছরই নাইকি তাদের কর্পোরেট চত্তরের সবচেয়ে বড় ভবনটি মিয়া হ্যামের নামেই নামাঙ্কিত করেন। ছিলেন নাইকি, পেপসি, গ্যাটোরেড মতো প্রতিষ্ঠানের পণ্যদূত। হ্যাম এফসি বার্সেলোনারও শুভেচ্ছাদূত।
মিয়া হ্যাম এমন এক সময়ের ফুটবলার বিশ্ব যখনও নারীদের ফুটবলার হিসেবে দেখতে শেখেনি। তাদের হাত ধরেই শুরু হয়েছে প্রমীলা ফুটবলের বিশ্বায়ন। ২০০৪ অলিম্পিকের পর ৩২ বছর বয়সে যখন অবসরের ঘোষণা দেন ততদিনে হ্যামের নামের পাশে ১৫৮ গোলের বিশ্বরেকর্ড। ২০০৪-এ যখন অবসরে যান তিনি ততদিনে অনেক দেশেই গড়ে উঠেছে পেশাদার নারী ফুটবল লীগ, শুরু হয়ে গেছে প্রমীলা ফুটবল বিশ্বকাপ, অলিম্পিকে সগর্ব অংশগ্রহণ। অনেক কিশোরী-তরুণী ফুটবলার হবার স্বপ্ন দেখেছে মিয়া হ্যামকে দেখেই।
সর্বকালের সেরা নারী ফুটবলার হিসেবে মিয়া হ্যামকে স্বীকৃতি দিতে কারও কারও দ্বিধা থাকলেও একথা সত্য যে তার সামগ্রিক অর্জন, জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব পাল্টে দিয়েছে একুশ শতকের ফুটবলের প্রতিকৃতি, পুরুষতান্ত্রিক ফুটবলে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন নারীদের।