somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভেজা কাক আমার মন

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একে তো শীতের সকাল, তার উপর বৃষ্টি।

কম্বলের নিচ থেকে এমনিতেই বের হতে মন চায় না তার উপ টিপ টিপ বৃষ্টি। আকাশ একটু গোমরা থাকলেই মনে হয়, ইশ, চানাচুর দিয়ে মুড়ি মেখে কোন একটা রোমান্টিক মুভি দেখতে দেখতে যদি এ জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যেত! কিন্তু জীবনের নিয়মটাই এরকম--যে যেটা চাইবে সে সেটা পাবে না। সেই পাবে যে চায় না। বাংলাদেশের কোন ভালো খেলা চলছে, অফিসে আমার কাজে মন বসে না, কিভাবে না যেন ছয়-চার গুলো মারছে বাঘা বাঙ্গালি। অথচ যারা বাসায় টিভির সামনে থাকেন দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তারা খেলা দেখেন না। তেমনি এই বৃষ্টিভেজা সকালে অফিসে যাওয়া। এতদিনে এটুকু বুঝে গেছি, আমি মাস শেষে যে টাকাটা পাই, তার একটা সামান্য অংশ পাই সারা মাস আমার কাজের বিনিময়ে। আর বেশী অংশটাই পাই মাসব্যপি সকালে ঘুম থেকে ওঠা, বৃষ্টিতে ভেজা, স্যারদের বকা খাওয়া, আরও বড় স্যারদের একটু তোয়াজ করার মতো নিজের স্বাধীনতা এবং অহং উৎসর্গের বিনিময়ে।

একটা কাপড় ভিজিয়ে প্যান্টের দু পায়ের কাছের শুকনো কাদা ঘষে মেজে পরিস্কার করে গতকালের প্যান্টটাই আজও পরলাম। এই কাদার দিনে নতুন একটা প্যান্টকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।

ভালো একটা বৃষ্টিতে রাস্তার কাদাও খানিকটা ধুয়ে যায়। কিন্তু দুদিনের এই টিপটিপ বৃষ্টিতে মাটি কাদা হচ্ছে কিন্তু কাদা ধুয়ে যাচ্ছে না। তার উপর দিয়ে গাড়ি চলছে অহর্নিশি। রাস্তার অবস্থা দেখে মনে হয় ধানের চারা রোপণ করার জন্য উপযুক্ত মাঠ। প্যান্টের কাদা যেটুকু মুছে এনেছিলাম, বুঝলাম ওটুকু পুরোটাই পন্ডশ্রম।

বাসা থেকে হেটে বাজার। বাজার থেকে ইলেকট্রিক ইজিবাইকে বনশ্রী। বনশ্রী থেকে আলিফে চড়ে এক নাম্বার। সেখান থেকে আবার কিছু হাটা পথ। অফিসের আট-দশ ঘন্টা কাজের চেয়ে এই আসা-যাওয়াই বেশী আয়েশসাধ্য। কবি গুরুর মতো আসা যাওয়ার পথের ধারে আমাদের গান গেয়ে দিন কাটাবার কোন জো নেই।

ইজিবাইকের পেছনের দুই-দুই চারজনের সীটে ওরা নেয় তিন-তিন ছয় জন। আর সামনে ড্রাইভারের দুই পাশে দুই জন। সব মিলে এতটুকুন গাড়িতে নয় জন মানুষ, গাড়ির চেয়ে যাত্রীর ওজন বেশী। পেছনে যে ছয় জন বসে তাদের নড়াচড়ার কোন উপায় নেই, ফোন আসলে পকেট থেকে মোবাইল বের করা যায় না। তাই টিপটিপ বৃষ্টি উপেক্ষা করে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসলাম।

বৃষ্টি একেবারেই কম। কিন্তু গাড়ির চালে দু’চার ফোটা জমে জমে এক ফোটা করে পড়ছে যে হাত দিয়ে একটা রড ধরে আটকে ছিলাম সেই হাতে । কোটের উপর দিয়েই টের পাচ্ছি। বনশ্রী যখন অটো থেকে নামলাম দেখি পানির ফোটা পড়া আমার কোটের সেই হাতাটা টার্মিনেটর টু-এর শোয়র্জনেগারের হাতের মতো হয়ে গেছে! যে একফোটা পানি পড়েছে হাতে তা গাড়ির চাল ধোয়া ধুলা-কাদা মিশ্রিত খাটি সরিষার তেলের চেয়েও খাটি একেকটি ফোটা। সেই কাদা কিছুটা শুকিয়ে টার্মিনেটরের মতো ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে।

দিনটা বুঝি পুরোটাই এমনি যাবে। ভাবতে ভাবতে বাসের টিকেট কেটে লাইনে দাড়ালাম। বৃষ্টিরও বেগ বুঝি কিছু বাড়লো। হাতের খাবারের ব্যাগটা মাথার উপর ধরে বৃষ্টির ফোটা রুখে দেবার একটা অপচেষ্টা করলাম। বৃষ্টির ফোটা এড়াতে না পারলেও কিন্তু চেষ্টা একেবারে বৃথা গেল না। পুর্ব জন্মের কোন পূণ্যের ফল পেলাম এই জন্মে, পেছন থেকে কোন এক দেবী আশীর্বাদ সরূপ তার ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে পরিস্কার বাংলায় বলল, ভাইয়া আপনি এই ছাতাটা নিতে পারেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা দুজন একই ছাতার নিচে। এত বড় একটা উপকার, সৌজন্য হলেও কিছু কথাবার্ত বলতে হয়। দেবী যেহেতু বাংলায় কথা বলেছিল, আমিও বাংলাতেই শুরু করলাম, কোথায় চাকরি করেন?

জানাল পড়ালেখা করে। আমি কেন চাকরির কথা বলেছিলাম বুঝতে পেরেই হয়তো কেন এখনও পড়ালেখা করে তার একটা ব্যাখ্যা দিতে চাইলেন। দুই বছর মেডিকেলের আশায় আশায় নষ্ট করাতেই আজ এই অবস্থা।

ব্র্যাকে পড়ে শুনেই একটা কমন প্রশ্ন করে বসলাম--বিবিএ?

গুলি এবারও মিস গেল। সে পড়ে ইএনএইচে। দুএকবার সরি সরি করে শুনেও যখন চিনতে পারলাম না তখন মুখ ফুটেই জিজ্ঞেস করলাম কোন নতুন সাবজেক্ট কিনা। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানের পরিধির বাইরেও প্রাইভেট ভার্সিটি গুলোতে অনেক বিষয়-আশয় আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের যেমন আছে গভিরতার গর্ব, প্রাইভেটে ওদের আছে উপস্থাপনার উচ্ছাস। আমাদের পাবলিক ভার্সিটিতে যেটা ’ইনট্রোডাকশন টু বিজনেস’ ওদের কাছে সেটা ’বাজ ওয়ান’, আমাদের কাছে যেটা ’বিজিনেস কমিউনিকেশন’ ওদের কাছে সেটা ’বাস কম’, এমন কি আমাদের আলী আহসান স্যার ওদের ওখানে ক্লাস নিতে গিয়ে হয়ে গেলেন ’ডাবল এ’!

সেই উপস্থাপনার উচ্ছাসেই সে জানালো ইএনএইচ হলো ইংলিশ এন্ড হিউম্যানিটিজ।

আমি আবারও ধন্দে পড়ে গেলাম। ইংলিশ এবং হিউম্যানিটিজ আজকাল আবার একসাথে পড়ায় নাকি? কয়দিন আর হলো ভার্সিটি ছেড়েছি এরই মাঝে পৃথিবী কত বদলে গেল-ধর্মী একটা হাহাকার করার আগেই মেয়েটি জানালো সে আসলে এই ইএনএইচ-এর ইএলটি'তে পড়ে। আবার ইএলটি?
একবার এলাবোরেশন জানতে চাওয়াতে লজ্জা কিছু কমেছে। তাই আবার জানতে চাইলাম ইএলটি?

ইংলিশ লিটারেচার। ও।

বাস চলে আসলো। আমরা ছাতা গুটিয়ে বাসে ওঠার জন্য প্রাণপণ করতে লাগলাম। কারণ আমরা থার্ড স্টপেজে দাড়ালেও বাস আগের দুই স্টপেজ থেকেই বাদুড় ঝোলা লোক নিয়ে আমাদের এখানে আসে। আর তার পর আমরা প্রকৃত সাম্যবাদীর মতো ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ ভুলে একেবারে কাধে কাধ লাগিয়ে দাড়িয়ে থাকি। এর পরও মাঝে মাঝে কোথাও থেকে শোনা যায়, ভাই একটু সরে দাড়ান। নিজের ক্ষেত্রেও হয়েছে দু’একবার। সবাই সাথে সাথেই উৎসুক চোখে তাকায় কে মেয়েদের গা ঘেষে দাড়ানোর চেষ্টা করে তা দেখার জন্যে। মেয়েটাও নিশ্চই নিরুপায় হয়েই ভরা বাসে এমন একটা কথা বলে। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি ছেলেটার তখন মনে হয় বাসভর্তি লোকজনের সেই দৃষ্টির চেয়ে বাসের নিচে পড়ে যাওয়াই শ্রেয়।

বাস কাছাকাছি চলে এসেছে। নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে এত ভিড়ে মেয়েটিকে আর দেখা যাচ্ছিল না।

ভার্সিটিতে থাকতে এক বন্ধু একটা ভার্সিটি ভর্তি কোচিং-এর ফ্রাঞ্চাইজি নিল। ওর নামে ভিজিটিং কার্ড ছাপালো। কোন মার্কেট বা অন্য কোথাও যেখানে প্রচুর ’দুষ্ট’ ছেলেমেয়ের সমাগম হয়, কিছুক্ষণ চোখে মুখে দৃষ্টি আকর্ষণের পর যাবার সময় দেখতাম ওদের টেবিলে বা পাশ দিয়ে যাওয়া রিক্সায় নিজের সেই গর্বিত ভিজিটিং কার্ডটা নিখুত দক্ষতায় পৌছে দিত বন্ধুটি। এবং তার চেয়ে বড় কথা, সাড়াও মিলত দু’একটার। সেদিন থেকেই আমার মনে মনে একটা বাসনা ছিল কবে আমার নিজের ভিজিটিং কার্ড হবে আর কোন মেয়েকে নিজের একটা কার্ড দিতে পারব।

আমার নিজের কার্ড হয়েছে বেশ বছর কয়েক হয়ে গেল। এখনও কোন মেয়েকে কার্ড দেয়া হয়নি।

নিজের কার্ড বিনিময়ের বেশ আগেই নিজের মন বিনিময় হয়ে গিয়েছিল। আমরা এখন এক সন্তানের গর্বিত পিতা-মাতাও। একজন পিতার হয়তো এগুলো সাজে না। তবে কেউ কেউ আবার বলে, বসন্তে এক আধটু বাধন হারা হওয়া নাকি এমনকি রাজার জন্যেও স্বাস্থ্যকর। অবশ্য সন্তানের কাছেই আমি পিতা। স্ত্রীর কাছে স্বামী। আর একজন অচেনা মেয়ের কাছে? কে জানে।

বাস এক নাম্বারে পৌছুলে আবার ধাক্কা ধাক্কি করে নেমে গেলাম। নামার আগে অবশ্য জাপানিদের মতো একটু মাথা ঝাকিয়ে দুর থেকেই বিদায় নিলাম। মেয়েটার নামটাও অবশ্য জানা হলো না।

বৃষ্টি ভেজা সকালে এক ছাতার নিচে দু’জনে--যে কোন নাটক সিনেমার জন্য যতই রোমান্টিক একটা দৃশ্যই হোক, বাস্তবতা হলো কোটের বাম হাতা পুরোটা এবং দুই পায়ে প্রায় হাটু পর্যন্ত কাদামাখা প্যান্ট নিয়ে সতের মিনিট লেট করে আমি অফিসে পৌছালাম।
.
১৯.০২.২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৩৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×