মনে আছে, তখন ভূত মাত্র নতুন চাকরিতে ঢুকেছে সমকাল ছেড়ে। কাজের খুব চাপ। এত চাপ যে কাজের জন্য অফিসেই থেকে যেতে হত প্রায় রাতে। এটা আমি প্রথম প্রথম পছন্দ করতাম না কিন্তু পরে যখন তার কাজ সম্পর্কে বুঝলাম, জানলাম তখন তার কাজকে আমিও রেস্পেক্ট করতাম তাই পরে পরে মেনে নিয়েছিলাম।
২০০৯, আমার প্রথম জন্মদিন তার সাথে। সেবার আমার বৃহস্পতিবার জন্মদিন পড়েছিল।
বুঝ হওয়ার পর থেকে এই দিনটি কাটতো আমার কান্না করে। কারণ যখন আম্মার(খালা) সাথে ছিলাম তখন আম্মু আসতো না কেক কাটার সময়। আম্মুর জন্য খারাপ লাগতো। আবার যখন আম্মুর কাছে আসলাম তখন খারাপ লাগতো আম্মার জন্য। কিছু না কিছু পারিবারিক সমস্যা লেগেই থাকত। সব আয়োজনই হত, কিন্তু মন থেকে হাসি খুশি থাকা, আনন্দ করা হত না।
যাইহোক, আমি জানতাম ঐ সময় কাজের খুব চাপ না থাকলেও অফিস ডে তে সে ছুটি নিতে পারবেনা আর আমাকে সময় দেয়াও সম্ভব না। কারণ শুক্রবার হল তার অফডে। আমার জন্মদিন হল বৃহস্পতিবারে আমিও তাই তাকে বলিনি কিছু।
মঙ্গলবার রাতে কথা বলছি। তখন জিজ্ঞেস করলাম, "কোথায় তুমি?"
সে বললো, "অফিসে"।
আমি শুনে অবাক কারন এখন তো কাজের ততটা চাপ নেই তাহলে অফিসে কেন? জিজ্ঞেসও করলাম।
সে বললো, "পরশুদিন বৃহস্পতিবার তোমার বার্থডে না? সে দিন তোমার সাথে থাকবো।
তাই ঐ দিনের কাজগুলো আজ সারারাতে করে রাখছি"।
আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। প্রচন্ড ভাল লাগায় ভরে গেল মন। কিছুটা খারাপও লাগছিল যে আমার জন্য বেচারা কষ্ট করছে।
২৮ মে সকালে কোচিং এর কথা বলে বাসা থেকে বেরুলাম। সেবার আমিও চাচ্ছিলাম মা-খালার আদরের বাড়াবাড়ি থেকে নিজেকে কিছুটা আলগা করে, নিজের দিনটি নিজের মত করে কাটা তে। জীবনে প্রথম পরিবারের বাইরে জন্মদিন কারো সাথে ভাগ করে নিতে যাচ্ছি। অন্যরকম উত্তেজনা, আনন্দ কাজ করছিল, সাথে ভয়, বাসায় মিথ্যে বলেছি বলে।
সে আমার জন্য শহীদ মিনারের সামনে অপেক্ষা করছিল। আমি রিকশা করে পুরান ঢাকা থেকে ওখানে গেলাম।
সেখানে যাওয়ার পর সে সি এন জি ডাকল। সে এন জি তে উঠব ঠিক তখন সে তার পকেট থেকে ছোট্ট আড়ং এর কমলা রঙের একটা ব্যাগ বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে নিলাম। এরপর সে এন জি তে উঠে একটা নোটবুক দিল। দিয়েই কি মনে করে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, "দাঁড়াও, এদিকে দাও, কিছু একটা লিখে দেই।"
আমি দিলাম। চলন্ত সি এন জি তে সে লিখে আমায় দিল। আমি খুলে দেখলাম প্রথম পাতায় লেখা, "খুব করে যত্ন নিও বউ"।
দেখে হাসলাম, লজ্জা পেলাম। কত আর বয়স তখন সবে এসএসসি শেষ করে কলেজ ভর্তি হয়েছি।
সে আমাকে দারুন একটা জায়গায় নিয়ে গেল। সে জানতো আমার এমন খোলামেলা জায়গা বেশ পছন্দ। সবুজ ঘাস, পানি, নিল আকাশ খুব ভাললাগে আমার। আমরা নৌকায় চড়লাম। নৌকায় উঠে বসে একটু পর সে আরেকটা পকেট থেকে সিল্ভারের মধ্যে ক্রিস্টাল স্টোন বসানো একটা নূপুর পরিয়ে দিল আমার ডান পায়ে। যা পেয়ে আমি আরও অবাক আর আমার চোখে পানি চলে এসেছিল।
পরিয়ে দিয়ে বললো, "বাহ! তোমার পায়ে পায়েল তো ভালই লাগে। সেই থেকে আমি নূপুর পরা শুরু করেছিলাম,যদিও এখন আর পরিনা। বাসায় এসে আড়ং এর ছোট্ট ব্যাগ টা খুলে দেখি ভেতরে লাল রঙ এর ছোট্ট একটা বক্স, তাতে সিল্ভারের মধ্যে স্টোন বসানো একটা ব্র্যাসলেট। এত্ত সুইট লেগেছিল গিফট টা।
সেই দিন টা আজীবন মনে থাকবে আমার। তাই তাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক কষ্টের মাঝেও কিছু সুখ পেয়েছি্লাম তার থেকে। এখনো অব্দি জীবনে ভাললাগার সব মুহূর্ত গুলো কেটেছে তার সাথে। সে আমার জীবনে প্রথম মানুষ যে আমায় ভাল রেখেছিল, ভালবাসতে শিখিয়েছিল, ভালবাসা কি বুঝিয়েছিল এবং সে ই প্রথম মানুষ কষ্ট কাকে বলে, কিভাবে তা গিলতে হয় সেই অভ্যেসও করিয়েছে।
সে বছরের পর থেকে আজ অব্দি আমার জন্মদিন আর পালন করা হয়না। ঈশ্বর চাননি এত যন্ত্রণা আর সমস্যা নিয়ে এই দিন পালিত হোক। সে গল্প না হয় অন্য কোনদিন বলা হবে
