পৃথিবীতে ল্যান্ড করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা শিশু টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। মানে তাকে নিয়ে নানা ধরনের টেস্ট শুরু হয়। পৃথিবীতে ল্যান্ড করবে কি না, করলে কবে করতে পারে এই টেস্ট, সেই টেস্ট কত যে আধুনিক যন্ত্রপাতি! আর ল্যান্ড করার পর তো কথাই নেই। শুধু টেস্ট আর টেস্ট। আসলে মানুষের জীবন কেবলই যাতনাময় নয়। জীবনকে টেস্টময় বললে খুব একটা ভুল হবে না। ল্যান্ড করা শিশু বড় হলে তাকে স্কুলে ভর্তি হতে হয়। আর এ জন্য দিতে হয় অ্যাডমিশন টেস্ট। স্কুলে যাওয়াটা শিশুদের জন্য প্রথম কয়েক দিন আনন্দময় হলেও কদিন পর স্কুলজীবনও হয়ে যায় যাতনাময়, মতান্তরে টেস্টময়। ক্লাস টেস্ট, উইকলি টেস্ট, মান্থলি টেস্ট আরও কত কিছু! অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার জন্য সব ধরনের টেস্টই থাকে স্কুলগুলোতে। শুধু টেস্ট থাকলেও না হয় মেনে নেওয়া যেত; কিন্তু দিনের পর যেমন রাত আসে, ভিলেন মারা শেষ হলে যেমন পুলিশ আসে, ঠিক তেমনি স্কুলের টেস্টগুলোর পর আসে রেজাল্ট! দুএকটা ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত রেজাল্টগুলো কখনোই মা-বাবার পছন্দ হয় না। আর তখন মা-বাবার হাতের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের পিঠের এক অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়। শিক্ষাই মেরুদণ্ড। তাই বাবা-মা বোধ হয় পিটিয়ে এই মেরুদণ্ড সোজা করার একটা চেষ্টা করেন। এটাও এক ধরনের টেস্ট। কার পিঠ কত শক্ত তা বোঝা যায় এই টেস্টে। এই টেস্টের কবল থেকে কারও মুক্তি নেই। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে দিতে হয় আরেক টেস্ট; সম্মান করে যাকে বলা হয় এসএসসি পরীক্ষা। কিন্তু এই পরীক্ষা দেওয়ার আগে আরও এক পরীক্ষা দিতে হয়। যে পরীক্ষার নামই টেস্ট পরীক্ষা। একজন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্য কি না তা যাচাই করা হয় এই টেস্ট পরীক্ষায়! আবার সেই টেস্ট পরীক্ষার আগে আছে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা! কোনো মানে হয়? পরীক্ষাই যদি নেবেন, একেবারে ফাইনাল একটা পরীক্ষা নিন, এত ভেজালের দরকার কী? বাংলা সিনেমায় একটু পর পর যেমন নাচ গান মারামারি আসে, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রেও কয়েক দিন পর পর আসে টেস্ট! এ জন্যই বাংলা সিনেমা এত শিক্ষামূলক ও জীবনমুখী!
স্কুল থেকে কলেজে গিয়েও টেস্টের কবল থেকে কারও মুক্তি নেই। কারণ কলেজেও আছে টেস্ট পরীক্ষা। কলেজ পাস করার পর আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন টেস্ট। তার আগে কোচিংয়ের মডেল টেস্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আবারও নানা রকম ক্লাস টেস্ট, উইকলি টেস্ট! চার বছর কোনোমতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উইকেটে টিকে থেকে মোটামুটি একটা স্কোর করার পর আবার চাকরির জন্য টেস্ট! সারা জীবন এত টেস্টের চাপ বহন করতে করতে শিক্ষার্থীদের অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। শরীরে বাসা বাঁধে নানা রকম রোগ-ব্যাধি। রোগ সারাতে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার কোনো কিছু চিন্তা না করেই একগাদা টেস্ট লিখে দেন। দেখে মনে হয় ডাক্তাররা টেস্ট ছাড়া আর কিছু লিখতে পারেন না। হাতের কাছে সাদা কাগজ পেলেই তাঁরা লিখতে শুরু করেন ব্লাড কালচার, ইলেকট্রোলাইট, ইউরিন কালচার...ইত্যাদি! বাংলাদেশে যত রকম টেস্ট হয়, পর্যায়ক্রমে প্রায় সবগুলোই আপনাকে করানো হবে। এদিক থেকে চিন্তা করলে বলা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনেকটা একই রকম। দু জায়গাতেই নানা রকম টেস্ট করানো হয়। শরীরে কোনো রোগ না থাকলেও টেস্টগুলোর বিল পরিশোধ করতে করতেই আপনার টাকা শেষ হয়ে যাবে। টাকা শেষ হলেই আরও টাকা আয়ের চাপে পড়বেন, চাপ থেকে হবে দুশ্চিন্তা আর দুশ্চিন্তা থেকেই জন্ম নেবে হার্টের রোগ, মনোরোগসহ নানা রকম সমস্যা! সে সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার আবার টেস্ট লিখে দেবেন। তত দিনে আরও নতুন নতুন প্রযুক্তির টেস্ট চলে আসবে। সেটার খরচ মেটাতে গিয়ে আবার টাকা খরচ, তারপর আয়ের চিন্তা, চাপ, দুশ্চিন্তা, আবার অসুখ! এ এক ভয়ংকর চক্র! এই চক্রের কাছে পানিচক্র কোনো ঘটনাই না। এত সব অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে আপনি যদি গলায় দড়িও দেন, তার পরও মুক্তি পাবেন না। এরপর শুরু হবে ফরেনসিক টেস্ট, ডিএনএ টেস্টসহ নানা রকম ঝামেলা! অর্থাৎ টেস্ট থেকে আপনার মুক্তি নেই। এ থেকেই বোঝা যায়, শুধু ধূমপান নয়, অতিরিক্তি টেস্টও মানুষের মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম! তবে এত এত টেস্টের মধ্যে একটা টেস্টই একটু বিনোদন দিতে পারে। সেটা হলো বাংলাদেশ যখন টেস্ট ক্রিকেটে ভালো খেলে। কিন্তু অন্যসব টেস্ট ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও বাংলাদেশ দল ধারাবাহিকভাবে টেস্টে ভালো খেলতে পারে না। আশপাশে এত সমস্যা থাকলে ভালো খেলবে কী করে? তবে কর্তৃপক্ষ যদি অপ্রয়োজনীয় টেস্টগুলোর ক্ষতি একটু টেস্ট করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিত, তাহলে এত সমস্যা থাকত না। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছে এই লেখা পৌঁছাবে কি না তাই বা কে জানে। কারণ এই লেখা ছাপা হওয়ার আগে নানা রকম টেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। দেখলেন তো, রস+আলোর সামান্য একটা লেখাই টেস্টের চক্র ভেদ করে বেরোতে পারে না, মানুষ কি এত সহজে পারবে?